কাজল ভট্টাচার্য, সিনিয়র জার্নালিষ্ট, কলকাতা:

এক যে ছিলো কবি।
শিল্পীর সঙ্গে কবির আলাপ ফেসবুকের পাতায়।

কবি দক্ষিণাবাসী বংললনা। যৌবনাত্তীর্ণা। তবে সাজুগুজুতে এক্কেবারে আগুন। সেই আগুন ছিলো তাঁর কবিতার প্রতিটি শব্দে, অক্ষরে। চোখ শরীর মন সব এক্কেবারে ঝাঁ-ঝাঁ করে উঠতো। যেন বিচুটি পাতায় জড়ানো একেকটি কলি। নগ্নতায় জারানো। যৌনতার বিস্ফোরণ কবিতায়। কবি নাকি তাঁর কবিতার ছত্রে-ছত্রেই লুকিয়ে থাকেন।
তবে সেদিন শিল্পী দেখেছিলেন, সেই আগুনে কবির অন্য একরূপ।

- "আপনার পোস্ট করা ছবিটা কি নিতে পারি?"
দুম করে একদিন শিল্পীকে এই প্রস্তাবটা ইনবক্সে ছুঁড়ে দিয়েছিলেন কবি। ভাবনাচিন্তা না করেই শিল্পীও বলে দিলেন- নিন। শিল্পীর পোস্ট করা এক অয়েল পেন্টিং দিয়ে, তাঁর কবিতার বইয়ের কভার করতে চেয়েছিলেন কবি। দক্ষিণার কথা তিনি আদৌ জিজ্ঞেস করেছিলেন কিনা, আজ একবছর পরে শিল্পীর আর মনে নেই। তবে দুটো শর্তের কথা মনে পড়ে। এক, ভালো প্রিন্টার বা পাবলিশার্স থেকে কভার ছাপাতে হবে। দুই, শিল্পীকে পাঁচ কপি বই দিতে হবে মূল্য ছাড়াই। সানন্দে রাজি কবি।

বইয়ের প্রচ্ছদ ছাপা হতেই, কবি শিল্পীর কাছে পোস্ট করলেন। সুন্দর ঝকঝকে কাজ। বেশ লাগলো। তাকে সেকথা জানালেনও শিল্পী। প্রথম শর্তপূরণ ভালোয় ভালোয় মিটলো।

কলকাতা বইমেলায় আত্মপ্রকাশ করলো সেই বই। তবে ওতো নাম-কা-ওয়াস্তে। আসল তো বইয়ের ফেসবুক রিলিজ। আর সেই রিলিজ হতেই কবিতায় কমেন্টের ঢল নামলো। কবির ভক্তকূলের সংখ্যা নেহাত মন্দ ছিলো না।
মহিলা পাঠকরা আরেকজন মহিলাকবির হাত থেকে বেরিয়ে আসা ওই খোলাখুলি যৌনতার বয়ান বাবদ তাঁকে সম্ভাষণ জানাতেন। নগ্ন নারীশরীর, তার বহুমুখী বর্নণা, উপমা। নারীদেহের খাঁজেখোঁজে সুপ্ত যৌনতার সশব্দ বিস্ফোরণ। তারমধ্যেই কবি অনুরাগী নারীরা খুঁজে পেতেন নারীমুক্তির দাম্ভিক ঘোষণা। আর পুরুষভক্তরা তো রগরগে যৌন উষ্ণতায় শরীর সেঁকে, ভাবে আবেগে গদগদ। ধন্য ধন্য করতেন সেই কবির।

মেলার প্রথমেই কবি আসতে পারছেন না, জানিয়ে দিয়েছিলেন শিল্পীকে। সেই সঙ্গে দিনক্ষণ স্থল সব বলে, কবি সাদর আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন চলে আসতে। হাজির হলেন শিল্পী সেইমতো। পোশাকআশাক দেখেই কবিকে ঠিক চিনে ফেলতে পারবেন, শিল্পীর সেই ভরসা ছিলো। কারণ ঠিক ওই ধরনের খোলামেলা বাহারী পোশাক, কলকাতা বা বাংলার মাঝবয়সী কোনও মহিলাকবির গায়ে চড়াতে দেখা যেতো না।

স্টলের নাম্বার খুঁজতে খুঁজতে শিল্পী ঠিকঠাক জায়গায় পৌঁছে গেলেন। দেখা হলো অনেক চেনামুখের সঙ্গে। ফেসবুকে অবশ্য তাঁদের সঙ্গে হামেশাই নিয়ম করে দেখা হতো। দু চারজনের সঙ্গে পরিচয়ও হয়েছিলো। কিন্তু যাঁরজন্য আসা সে কই? স্টলে তো অন্য এক মহিলা। যাকে কোনদিন কোথাও দেখেছেন বলে মনে করতে পারলেন না শিল্পী।

কবিরা তো কবিতার বই বেচেন সে যেভাবেই হোক। তাতে অবশ্য দোষের কিছু থাকতে পারে না। কারোও ঘাড় ধরে তাঁরা বই কিনতে বাধ্য করেন না। কিন্তু প্রশ্ন অন্য জায়গায়।
অন্য যে কোনও বইয়ের মতোই কবিতার বইয়েও মলাট গুরুত্বপূর্ণ। আগে দর্শনধারী পরে গুণবিচারী। আর এই দর্শনধারীর কাজটাই নিপুনভাবে সারেন অঙ্কনশিল্পী। কবিতা বা বইয়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কভার ডিজাইন করেন।
কিন্তু এই কভারছবি বেশিভাগ কবিরাই ফোকটে চান কেন?
একেবারে কাঠখোট্টা বাজারী ভাষায় বলতে, কবিতা লেখার ইনভেস্ট একটুকরো কাগজ। সঙ্গে একটা পেন অথবা পেনসিল। মোবাইল হাতে আসায় সে পাটও চুকেছে। অধিকাংশ কবিকেই এখন দেখা যায়, মঞ্চে মোবাইল দেখে কবিতা পড়তে।
কোনও শিল্পী কিন্তু অতো সহজে কাজ সারতে পারে না। তার ছবি আঁকার আয়োজন ব্যাপক। কাগজ তাও হাজার রকমের। শিল্পী তার পছন্দ মতো বেছে নেয়। এরপর পেনসিল ইরেজার রং তুলি। সৃষ্টিশীলতা বা মননে কবি, শিল্পী কেউই কম যায় না। দুজনের পৌঁছবার ঠিকানাও হয়ত এক। কিন্তু কবির পথ অনেক সোজা আর নির্ঝঞ্জাট। শিল্পী পৌঁছয় অনেক ঘুরপথে। সময়সাপেক্ষ তার যাত্রাপথ। মাত্র কয়েকটা তুলির টানে কবির মনের কথার সারাংশ তুলে ধরা। তাও পাঠকের কাছে দৃষ্টিনন্দন ভাবে।
এরপরেও শিল্পী ফোকটে অথবা নামমাত্র টাকায় ছবি আঁকে। কেন? কেউ আঁকে স্বভাবদোষে। শুধুই নাম ফাটানোর জন্য। আবার অনেকে যা পায় তাই সই। আর ঠিক এই সুযোগটাই নেয় কবি সাহিত্যিক কূল। নিজের বই ছাপাতে টাকা খসাতে একপায়ে খাড়া। প্রকাশক ঝুঁকি নিয়ে এই শখের কবি লেখকদের বই ছাপায়, করেন নাকি এরকম বিশ্বাস?
ডিলটা হয় এরকম। লেখকের পকেট কেটে বার করা ছাপার টাকা বাবদ প্রকাশকরা কবি বা লেখকের হাতে তুলে দেয় কিছু বই। ওই বই বিক্রি করেই কবির পকেট খসানো টাকা তুলে নিতে বলেন প্রকাশক। আড়ালের এই খেলা চেপে যান কবি লেখকরা। ভাবখানা এমন, প্রকাশক তাঁর বই ছাপাতে উন্মুখ হয়ে বসেছিলেন।
তা বলে, সবাইকে এক সারীতে বসিয়ে দেওয়া চলবে না। ব্যতিক্রমিরাও আছেন তাঁদের আত্মগর্ব নিয়ে।

আমি যে কবির গল্প শোনাতে বসেছি তার আড়ালের গল্পটা অবশ্য শিল্পীর জানা ছিলো না। তবে তাঁর বই হাতে আসতে এক দেখাতেই বুঝতে পেরেছিলেন, বই ছাপাতে কবি কিপটেমির ধার ধারেননি। উদারহস্ত। আর ঠিক সেখানেই শুরু ক্লাইম্যাক্সের।

"অমুক দিন তমুক সময়ে চলে আসুন এত নাম্বার স্টলে।" কলকাতার প্রচ্ছদ শিল্পীকে হোয়াপে জানিয়ে ছিলেন সেই দক্ষিণপ্রবাসী বাঙালি কবি। কথামতো ঠিকঠাক জায়গায় হাজিরা দিলেন শিল্পী। সেই বই থরে থরে সাজানো টেবিলে। কিন্তু বই আছে কবি নেই। কাউন্টারে বসে থাকা ভদ্রমহিলা জানিয়ে দিলেন, কবির আসতে খানিক দেরি হবে।
অগত্যা অপেক্ষার প্রহর গোনা শিল্পীর। একসময় ধৈর্য্যচ্যূতি। ফের কাউন্টারের ভদ্রমহিলার কাছে ছোটায় তিনি জানালেন, শিল্পীর অপেক্ষা করার কথা কবিকে জানানো হয়েছে। এবার কাউন্টারের ওই মহিলার কাছেই তাঁর প্রাপ্য বইয়ের কথা জানালেন শিল্পী। লাভ হলো না। ফিরে গেলেন শিল্পী।

পরদিন ফের সেই স্টলে ছুটে গেলেন শিল্পী। "তিনি আসছেন।" জানালো কাউন্টারে বসা কালকের সেই মহিলা। "কাল তো দিদি আপনার জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছিলেন।" ব্যাপারখানা এরকম, শিল্পীর দোষেই যেন কবির সঙ্গে দেখা হলো না।
- "আমার কপির কথা কিছু বলে যাননি?" জানতে চাইলেন শিল্পী।
- "নাতো। আমাকে কিছু বলেননি।" কাউন্টারের মহিলা জানালেন।

একদিনের পুরনো ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। অবশেষে পকেট খসিয়ে দুশো টাকা খরচ করে, দু'কপি বই কিনে ফেললেন সেই বইয়েরই প্রচ্ছদ শিল্পী। নিজের আঁকা প্রচ্ছদ বলে কথা।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours