রিয়া ভট্টাচার্য, লেখিকা, খড়্গপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর:

আচ্ছা ভালোবাসা বলতে কি বোঝেন জনগণ? শাশ্বতকাল ধরে চলে আসা প্রকৃতি ও পুরুষের মেলবন্ধনের অন্য নাম?নাকি ভালোবাসা শব্দটির ব্যাপ্তি আরো গভীর,আরো প্রখর!! জন্ম থেকে নাড়ীর সূত্রে আমাদের প্রথম পরিচয় ভালোবাসার সঙ্গে,মা-বাবা-ভাই-বোন-আত্মীয়স্বজন এসব জুড়েই থাকে আমাদের শৈশব ও তাতে মিশে থাকা একখণ্ড ভালোবাসা।বড় হওয়ার সাথে সাথে আমাদের হৃদয়ের ভালোবাসার ঝুলিতে ভাগ বসায় বন্ধুবান্ধব--বই-খেলাধুলো-গান ইত্যাদি নানা ভালোলাগা এবং সবশেষে অবশ্যই---- মনের মানুষ।
আচ্ছা ভেবে দেখেছেন আপনার মনের মানুষটি যদি সমলিঙ্গের হয়,কি করবেন?কি হল ঠোঁটের আগায় ফুটে উঠছে ব্যঙ্গবাণী.....একটু পরেই মানুষটাকে দেখিয়ে গুজগুজ ফুসফুস শুরু করে দেবেন তাইতো?
সমকামী আন্দোলন আজকের নয়,অনেক লড়াইয়ের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাস হয়েছে সমকামী বিবাহ আইন,যার ফলে যেকোনো মানুষ তার সঙ্গীকে বিবাহ করতে পারেন,যেরকম একটি পুরুষ একটি মহিলাকে বিবাহ করে থাকেন ঠিক সেরকমই আর কি।তবে লজ্জার বিষয় আজও,এই একবিংশ শতাব্দীতেও ভারতে সমকামীতা দণ্ডনীয় অপরাধ। কেন? মানুষের মননবৃত্তি নিয়ন্ত্রনের অধিকার সমাজ বা আইনব্যবস্থাকে কে দিয়েছে?যে দেশের আইন ধর্ষণের মত নারকীয় অপরাধের যথাযথ শাস্তিদান করতে পারে না,বিচার বছরের পর বছর ধরে শম্বুকগতিতে চলে প্রহসনে পরিণত হয়,সে দেশে এই কালাপাহাড়ি আইন শুধু হাস্যকর নয়,চুড়ান্ত নিন্দনীয় ও ঘৃণ্য।
প্রতিটি মানুষেরই নিজস্ব জীবন বেছে নেওয়ার অধিকার আছে।একটি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ জীবনসঙ্গী হিসাবে কাকে বেছে নেবে তা নির্ধারণ করার অধিকার কিন্তু পরিবার,সমাজ বা রাষ্ট্রের নেই।আচ্ছা যদি একজন নারী-পুরুষের ভালোবাসা রাষ্ট্র বা সমাজের চোখে অবৈধ না হয় তবে দুজন পুরুষ অথবা দুজন নারী একে অপরকে ভালোবাসলে রাষ্ট্র যন্ত্রের সিংহাসন নড়ে ওঠে কেন?কেন একগাদা শ্লেষ,খিল্লি,ব্যঙ্গোক্তি উড়ে আসে তাদের দিকে?কেন তাদের জন্ম দিয়ে লালনপালন করে বড় করে তোলা মা-বাবাও সোসাইটির সামনে তাদের পরিচয় দিতে লজ্জা পান?যেনতেন প্রকারে তাকে বাধ্য করেন সমাজের বানানো সো কলড সোজাপথ মেনে চলতে?
এদেশে সমকামিতা আইন সংশোধনের উদ্দেশ্যে আন্দোলন চলছে বহুকাল ধরে,তবু গান্ধারী সেজে ন্যায়ের অভিনয় করে চলা রাষ্ট্রের ঘুম ভাঙেনি।আর সমাজ?সেতো আজও বিধবা মহিলা রঙিন শাড়ি পরলে টোন কাটে,বিপত্নীক প্রৌঢ় ব্যক্তি কাউকে ভালোবাসলে তার চুলকানি নিয়ে পাড়ার রক গরম করে,ধর্ষিতা মেয়েটির চরিত্র ও পোশাকের বিশ্লেষণ করতে বসে নিজে পেট বের করা শাড়ি পরে।সকলে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের দোহাই দেন,কিন্তু উত্থিত দণ্ডের আগায় সমস্ত নারীকুলকে ঝুঁকিয়ে যারা রাখেন,চরিত্রহনন করে প্রতিনিয়ত যারা আপনার অন্তঃকরণ কালিমালিপ্ত করে, দিনের শেষে একটু মন দিয়ে খুঁজে দেখবেন তাঁরাও এক-একজন নারী।ধর্ষিতা অসহায়ার জীবন নরকসম করে তোলেন এঁরাই,আবার রাস্তাঘাটে, ট্রামেবাসে,এমনকি আপনার নিজের বাড়িতেও আপনাকে সমাজদণ্ডের সামনে নতিস্বীকার করতে বাধ্য করে চলেন এঁরাই।আবার এঁরাই সমকামিতা নিয়ে ছোপ ধরা দাঁত বের করে খিল্লি করেন,সঙ্গী হন কিছু পুরুষও।স্বয়ং ঋতুপর্ণ ঘোষের মত ব্যক্তিও রেহাই পাননি এদের থেকে,ব্যক্তির কর্মের চেয়ে বড় হয়ে উঠেছে তার যৌন পরিচয়।
ডিয়ার জনগণ, নেটওয়ার্ক ফোর জি স্পিডে ছুটছে,দেশ ও দুনিয়া এখন এক ক্লিকেই হাতের মুঠোয়।এই সময়ে দাঁড়িয়ে একজন মানুষ গে,লেসবো নাকি নর্মাল এসব নিয়ে চিন্তা করা বা দাঁত বের করে খিল্লি করতে আসা নিতান্তই ছেলেমানুষি ও সংকীর্ণ মনের পরিচয়।পৃথিবী এগোচ্ছে, নিজের মানসিকতাও এগোন,নয়ত একসময় নিজেই খিল্লির পাত্র হবেন।মানুষকে তার ধর্ম,যৌনজীবন দিয়ে নয়,কর্ম দিয়ে বিচার করতে শিখুন,নয়ত আগামীতে আপনার সন্তানরা যদি আপনাকে ব্যাকডেটেড বলে সমাজে পরিচয় দিতে লজ্জা পায় নাকে কান্না কাঁদবেন না যেন। নিজে বাঁচুন,অপরকে শান্তিতে বাঁচতে দিন। (ক্রমশঃ)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours