আহসান হাবিব, লেখক, বাংলাদেশ:

আমার নিজের একটা ভাষা ছিল, ক্রমেই তা হারিয়ে যাচ্ছে । বলা যায় আমি প্রায় হারাতে বসেছি আমার প্রিয় মুখের ভাষাটি । অথচ এই ভাষাতেই কেটেছে শৈশব, কৈশোর এবং যৌবনের প্রারম্ভ । আজ মনে করতে পারি কি অবলীলায় আমি বলে গেছি আমার প্রিয় মুখের ভাষাটি, অথচ আজ সেই ভাষায় কথা বলতে আমার বাধে, এমনকি একটি সম্পূর্ণ বাক্য বলতে চাইলেও পারি না । প্রায় সিংহভাগ ভুলে বসে আছি শব্দ। কেন এমন হল?

আমি যখন উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ছাত্র হয়ে পড়লুম, আমার পাঠ্য থেকে বাংলা ভাষা বিদায় নিয়ে ফেললো । তখন কেবল বন্ধুদের সাথে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে টিকে থাকলো আমার বাংলা । কিন্তু কোন বাংলা ? লক্ষ্য করলাম আমি এতদিন যা পড়েছি সেসব আমার মুখের ভাষা নয়, সেসব বইয়ের ভাষা । বইয়ের ভাষা মানেই প্রমিত ভাষা। সমস্ত আঞ্চলিক ভাষার সার্বজনীন নির্যাস হচ্ছে এই প্রমিত বাংলা । তখন সব আঞ্চলিক ছেলেমেয়েরা কলেজে ভর্তি হয়েছে, তারাও আমার মত একে অপরের সঙ্গে চেষ্টা করছে প্রমিত বাংলায় কথা বলতে । ধীরে ধীরে আমার মুখের ভাষাটির জায়গা দখল করে নিচ্ছে একটি বানানো ভাষা- প্রমিত ভাষা । প্রমিত ভাষা শিখতে হয়, কিন্তু মুখের ভাষা যা জন্মেই আমার মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছে, তা শিখতে কোন পাঠশালায় যেতে হয়নি । সেই থেকে শুরু আমার নিজের ভাষা ভুলে যাওয়ার । মাঝে মাঝেই লক্ষ্য করতাম কথা বলার সময় বেরিয়ে পড়ছে আমার আজন্ম লালিত ধ্বনি, তখন দেখতাম বন্ধুদের মধ্যে একটা হাসির রেখা, চাপা অবজ্ঞা, সচেতন হয়ে উঠতাম সঙ্গে সঙ্গে । কি করে আঞ্চলিক ভাষা মুখের স্বাভাবিক ভঙ্গি থেকে দূর করতে হয়, সেই চেষ্টাও যোগ হতে শুরু করলো আমার উচ্চারণ ভঙ্গিমায় । আমার মুখের ভাষা পিছে হটতে হটতে এখন এমন এক অবস্থায় দাঁড়িয়েছি যে আগেই বলেছি একটি সম্পূর্ণ বাক্য বলতেও ভুল হয়ে পড়ে । অথচ প্রমিত বাংলায় কথা বলতে আমার একটুও বাধে না । এখন বরং আমি ঠিক কোন অঞ্চলের লোক, এটা অনেকেই ঠাহর করতে পারে না।

কেন আমার মুখের ভাষাটি বদলে গেল ? কিংবা বলা যায় আমি বদলে ফেলতে রাজি কিংবা বাধ্য হলাম ? সহজ এর উত্তর, অর্থনৈতিক কারণই এর পেছনে ক্রীড়ানক হিসেবে কাজ করেছে । আমি যদি ইংরেজি ভাষায় মেডিক্যাল শিক্ষা না গ্রহণ করি, তাহলে আমার সামাজিক মুল্য বৃদ্ধি পাবে না । আমার ভেতরে শিক্ষা যে পণ্যমুল্য তৈরি করবে, ভাষা একটা তার প্রধান উপাদান । বাংলা সেখানে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবে না, ফলে আমাকে ইংরেজি ভাষায় শিখতে হয়েছে । তাহলে ভাষার মধ্যেও লুকায়িত থাকে অর্থনৈতিক প্রপঞ্চ যা সামনে নিয়ে আসে । আমাদের যে ৫২ সৃষ্টি হয়েছে এটার উপরিতলে আছে ভাষার জাতীয়তাবোধ, অবকাঠামোয় ফল্গু ধারার মত বিদ্যমান অর্থনৈতিক ট্রিগার । ভাষা যে একটা আগ্রাসন এবং অর্থনীতি এর পেছনে ক্রিয়াশীল, বাঙালিরা বুঝতে পেরেছিল, লড়াই করে ছিনিয়ে এনেছিল ভাষার অধিকার । ভাষা যে একটা জনগোষ্ঠীকে স্বাধীনতার দিকে ঠেলে দেয়, আজকের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ তার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত।
প্রতিদিন ভাষা মরে যাচ্ছে কিংবা হারিয়ে যাচ্ছে। আমার হারিয়ে যাওয়ার গল্প এই অঞ্চলের প্রতিটি মানুষের গল্প । এটা যদি বাংলাভাষীদের একটা সাধারণ ঘটনা হয়, এর বাইরেই মৃত্যুর কারণ আছে । কেননা একটা স্বাধীন দেশে শুধু একই ভাষার লোক বাস করে না, করে নানা আদিবাসী যাদের প্রত্যেকের ভাষা আলাদা । দেখা যাচ্ছে এইসব আদীবাসীরা তাদের নিজেদের ভাষা ভুলে যাচ্ছে । ভুলে যেতে বাধ্য হচ্ছে অর্থনীতির চাপে । তথাকথিত সভ্যতার স্পর্শে আসতে তাদেরও শিখতে হচ্ছে প্রমিত ভাষা, প্রমিত ভাষা মানেই একটা বানানো ভাষা, বইয়ের ভাষা । এই শিক্ষা ছাড়া অন্য কোন পথ নাই, কারণ টিকে থাকতে হলে প্রতিযোগিতায় নামতে হয়, তখন যোগাযোগের ভাষা হয়ে দাঁড়ায় এই প্রমিত ভাষা । এটা যেমন ভাষা হারিয়ে যাওয়ার একটা ভেতরের সমস্যা, আবার বাইরের চাপেও ভাষা হারিয়ে যায় । যেমন আমরা আমাদের বাংলা ভাষাকে হারাতে বসেছি ইংরেজির চাপে । ক্রমেই পৃথিবী ছোট হয়ে আসছে, বাড়ছে নানা সংযোগ, এবং এই সংযোগের প্রধান সেতু হচ্ছে অর্থনীতি । আমাদের রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকতে হলে নিজেদের আন্তর্জাতিক যোগ্যতায় উত্তীর্ণ হতে হয় । আঞ্চলিক ভাষা যেমন প্রমিত ভাষার কাছে হার মানে, ঠিক তেমনি রাস্ত্রীয় ভাষা আন্তর্জাতিক ভাষার কাছে হার মানে, এটাকে হার বলার চাইতে অবধারিত প্রয়োজনও বলা যেতে পারে । কারণ এটা মানবজাতির টিকে থাকার প্রশ্নের সঙ্গে জড়িত । যদিও এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে রাজনীতি আর রাজনীতি মানেই ক্ষমতার প্রশ্ন । তাই ভাষা একটি ক্ষমতার নাম।

এই যে বাংলা ভাষার জন্য মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে, রক্তের বিনিময়ে পাওয়া সেই ভাষা কেন সর্বস্তরে প্রচলিত হয়ে উঠছে না ? স্বাধীনতার প্রায় ৫০ বছর পরেও কেন উচ্চ শিক্ষার মাধ্যম বাংলা হয়ে উঠছে না ? কেন একটা সামান্য দোকানের নাম লিখতে বিদেশী ভাষা ব্যবহার করতে হচ্ছে ? একটাই কারণ, অর্থনৈতিকভাবে অগ্রসর হতে না পারা । শুধু যে অর্থনীতির প্রভাব তাই নয়, এই সাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে ধর্মের একটা বিশাল প্রভাব আছে । এই দেশের সাম্প্রদায়িক মানুষ মনে করে বাংলার চেয়ে আরবী একটি পবিত্র ভাষা এমনকি এই ধারার লোকেরা উর্দুকেও বাংলার চেয়ে বেশি পছন্দ করে । হালে হিন্দি আমাদের ঘাড়ে এসে চাপ দিচ্ছে । পশ্চিম বাংলার প্রচুর লোকের মুখে এখন হিন্দির আগ্রাসনের কথা শুনতে পাই এবং মাঝে মাঝে এর স্বপক্ষে আন্দোলনের ছবি দেখি। কি এর কারণ ? কারণ বাংলা ভাষীদের সরিয়ে ব্যবসা বানিজ্য যাদের দখলে চলে যাচ্ছে তাদের মুখের ভাষা হিন্দি । ফলে হিন্দির কাছে বাংলা ভাষা পিছু হটছে । সারা পৃথিবীতেই এই লড়াই চলছে যার শিকার হচ্ছে ভাষা । নিজের ভাষা রক্ষা করতে আদিবাসীরা বনের গভীরে ঢুকে যাচ্ছে, তবু রক্ষা পাচ্ছে না আধুনিক সভ্যতার কাছে । ভাষা মরে চলেছে, চলেছে হারিয়ে।

কে ঠেকাবে ভাষার মৃত্যু কিংবা হারিয়ে যাওয়া ? না, কেউ নাই, এটাই মানব প্রজাতির জার্নি এবং নানাবিধ মৃত্যুর সাথে ভাষার মৃত্যুও অবধারিত।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours