সুদীপা চৌধুরী, লেখিকা ও অধ্যাপিকা, দুর্গাপুর:

আমার মাতৃভাষা বাংলা , কিছু প্রশ্ন প্রকৃতি জুড়ে যখন রাশি রাশি অশোক , পলাশ রাঙা হাসির মাতন ছড়ায়, তখন রঙের উৎসব দোলযাত্রার আগে-পিছে আরেকটি দিনকে বাঙালি স্মরণ করে পরম মমতায় । সেদিনটি হল একুশে ফেব্রুয়ারি ---আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।
এই দিনটির গায়ে  উনিশশো বাহান্ন সালে ছয়টি তাজা তরুণ প্রাণের রক্তের দাগ লেগে ছিল। উনিশশো সাতচল্লিশ সালে দ্বিধাবিভক্ত ভারতের মধ্য থেকেই জন্ম নেয় পাকিস্তান রাষ্ট্র । পূর্ব পাকিস্তানের বাসিন্দা ছিলেন বাংলাভাষী মানুষজন। কিন্তু সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত পাকিস্তানে , সরকারি ভাষা রূপে উর্দূ ভাষাকেই প্রাধান্য দেওয়ার প্রস্তাবে বিক্ষুব্ধ ছাত্রসমাজ ও জনতা আন্দোলন শুরু করে উনিশশো সাতচল্লিশের  শেষভাগ থেকেই। হর উনিশশো বাহান্ন সালে আন্দোলন চরমে পৌঁছায়। সরকারি দমন-পীড়ন নীতির প্রতিবাদে ও মাতৃভাষা বাংলাকে অন্যতম সরকারি ভাষা রূপে ঘোষণার দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজের ছাত্র শিক্ষকদের বিক্ষোভ প্রবল হয়ে উঠলে , সরকারি নির্দেশে পুলিশ গুলি চালায়, মারা যায় সালাম, রফিক, বরকত, জব্বারসহ ছয়জন।
এই হত্যাকাণ্ডের ফলে সারা দেশজুড়ে ধর্মঘট ও বিক্ষোভ চলতে থাকে, অবশেষে উনিশশো চুয়ান্ন সালের সাত মে, গণপরিষদে মুসলিম লীগের সমর্থনে বাংলা ভাষা পাকিস্তানের দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা লাভ করে।  উনিশশো ছাপান্ন সালের উনত্রিশ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদ সংবিধান প্রণয়নের সময় ঘোষণা করে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু ও বাংলা।
১৭ নভেম্বর ১৯৯৯ আন্তর্জাতিক শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে এর ফলে এই দিনটিতে সমস্ত বিশ্ববাসী, নিজের মাতৃভাষাকে শ্রদ্ধা জানানোর অবকাশ পায়।
বাংলাদেশ ১৯৫৩ সাল থেকেই একুশে ফেব্রুয়ারি দিনটি শহীদ দিবসের মর্যাদা পেয়েছে কিন্তু সমগ্র বিশ্বে ১৯৯৯ সালের পর থেকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন কে কেন্দ্র করে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন হতে দেখা যায় । যেহেতু পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ অধিবাসীর মাতৃভাষা বাংলা, সেহেতু এখানের মানুষজন অত্যন্ত সমাদরের সাথে,একুশে ফেব্রুয়ারি দিনটিকে পালন করে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে বাহান্নর ভাষা আন্দোলন ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন হলেও এর রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক তাৎপর্য ছিল অনেক গভীরে প্রোথিত। কারণ এই আন্দোলনের গভীরে নিহিত ছিল ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে বাঙালির আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রবল ইচ্ছা। এর সঙ্গে জড়িত হয়েছিল বাঙালির স্বাধিকার চেতনা।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই, আজ আমাদের পশ্চিমবঙ্গে একুশে ফেব্রুয়ারি পালনের যে জোয়ার দেখা যায় তারমধ্যে সত্যিকারের ভাষা কেন্দ্রিক আবেগ কতটা বর্তমান।
আজ বেশিরভাগ সম্পন্ন বাঙালি নিজেদের ছেলেমেয়েদের ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয় পড়াতে আগ্রহী। এর প্রধান কারণটাই হচ্ছে চাকরির বাজারে অথবা উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ভারতবর্ষে ইংরেজি ভাষার প্রচলনই বেশি।
আমরা যদি আজ পশ্চিমবঙ্গে প্রচলিত বাংলা ভাষা সম্পর্কে পর্যালোচনা করতে বসি তাহলে দেখব যে, এখনকার প্রজন্ম প্রায়ই সঠিকভাবে বাংলা ভাষা ব্যবহারের পক্ষপাতী নয় । এর কতিপয় কারণ বর্তমান। প্রথমত, ইংরেজি মাধ্যমে পড়া ছাত্র ছাত্রী বাংলা ভাষায় লেখার অভ্যাস কম থাকায় বাংলা বাক্য গঠন, সেই সঙ্গে বাংলা শব্দ ব্যাবহারে ততটা পারদর্শী হয় না। সেইসঙ্গে, বিদ্যালয়ে শিক্ষক ও বন্ধুদের সাথে অন্যান্য প্রাদেশিক ভাষা ও ইংরেজি ভাষায় কথোপকথন করতে থাকায় তাদের ব্যবহৃত মাতৃভাষা বাংলায় অন্যান্য ভাষার শব্দ ঢুকে পড়ে। অনেক ক্ষেত্রে তাদের অভিভাবকেরা বাংলা ভাষায় তাদের সঙ্গে কথা বলতে অনাগ্রহী হন। ফলে মাতৃভাষায়  সঠিক ও বিশুদ্ধ ভাবে কথা বলাটা তাদের কাছে সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় আর কথা বলতে না পারলে বিশুদ্ধভাবে লেখাটাও সম্ভব হয়ে ওঠে না।
অন্যদিকে যদি বাংলা মাধ্যমের বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের সম্পর্কে পর্যালোচনা করি তাহলে দেখব, প্রায় ক্ষেত্রেই তারা পাঠ্য বই ছাড়া বাইরের বই বা সাহিত্য পাঠে অনাগ্রহী। ফলে, তাদের ভাঁড়ারে বাংলা ভাষার শব্দ সংখ্যার পরিমাণ খুবই কম থাকে। ফলে সুন্দরভাবে বাংলা ভাষার প্রয়োগ তারা তেমনভাবে করে উঠতে পারে না।
আজকাল বিভিন্ন বিনোদনের মাধ্যম,যেমন, টেলিভিশন, সিনেমা ও ইন্টারনেট দুনিয়ায়, হিন্দি ভাষায় বহুল প্রচলন, ছাত্র যুব সমাজকে আকর্ষণ করছে গভীরভাবে।তাই তাদের কথোপকথনে, মাতৃভাষার সঙ্গে,হিন্দি , ইংরেজি শব্দ অনুপ্রবিষ্ট হচ্ছে অনায়াসেই। আজকাল, বাক্যগঠন ভঙ্গীতেও এই প্রভাব অত্যন্ত প্রকট।
আবার দেখা যায়, পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তে যে সমস্ত উপভাষাগুলি  প্রচলিত রয়েছে, মান্য লেখ্য বাংলা থেকে দূরত্ব তার অনেকটাই বেশি। এই সমস্ত ভাষায় যে সমস্ত ছাত্র-ছাত্রীরা কথা বলতে অভ্যস্ত, পরীক্ষার খাতায় লেখার সময় তারা সেই ভাষা ব্যবহার করতে পারে না। ফলে, বাংলা ভাষার যে মূলস্রোত তা বহুল প্রচলিত লোকশব্দ জনিত সম্পদ থেকে বঞ্চিত হয়ে পড়ছে ক্রমশই। এবং সেই সমস্ত অঞ্চলের ছাত্রছাত্রীরা হীনমন্যতায় ভুগছে ও মান্য বাংলা সঙ্গে নিজেদের চিন্তাভাবনা জগতের যোগাযোগ গড়ে তুলতে পারছে না।নিজেদের ভাবনাচিন্তা কে যথাযথভাবে প্রকাশেও সমর্থ হচ্ছে না।
আজকাল অবশ্য বিভিন্ন উপভাষা ও সমাজ ভাষা নিয়ে বাংলা সাহিত্য কাজ করে চলেছে এবং ক্রমশ সমৃদ্ধ হয়ে উঠছে। কিন্তু মুশকিল হলো এই যে, সাহিত্য চর্চা আজকাল খুব অল্প মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ।আপামর বাঙালি যে মাতৃভাষায় কথা বলে ,তার সমস্ত সমস্যা সম্পর্কে সচেতন নন বরং হিন্দি ইংরেজি ও বাংলা শব্দের মিশেলে যেমন তেমন করে মনের ভাব প্রকাশের তারা ক্রমশ স্বচ্ছন্দ বোধ করছেন।
একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের ক্ষেত্রে কিছু কবিতা ও গানের চর্চা বিশেষত শহরাঞ্চলে হয়ে থাকে কিন্তু সামগ্রিক ছাত্র সমাজের কাছে তার প্রভাব খুব সামান্য।আজ, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করার সময় পশ্চিমবঙ্গে কথ্য ও লেখ্য বাংলা ভাষা বিশুদ্ধরূপে ব্যবহারের ক্ষেত্রে ছাত্র সমাজ ও যুব সমাজকে কিভাবে আগ্রহী করে তোলা যেতে পারে সে বিষয়ে পর্যালোচনার সময় উপস্থিত। সাহিত্যিক ,বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক ,অধ্যাপক ও প্রশাসক সকলে মিলে বসে ভাবতে হবে, কিভাবে বহুভাষিক ভারতবর্ষে প্রতিটি প্রদেশের মানুষের ব্যবহৃত মাতৃভাষাকে বিশুদ্ধরূপে চর্চা করা যেতে পারে এবং সংশ্লিষ্ট ভাষাগুলিকে দিনে দিনে আরও সমৃদ্ধ কিভাবে করা যেতে পারে । না হলে  মজে যাওয়া নদীর মত হারিয়ে যেতে পারে ভাষাগুলি। আমাদের অহংকারের ভাষা, সমৃদ্ধ ভাষা, মাতৃভাষা বাংলাকে আমরা সেভাবে হারিয়ে যেতে দিতে পারি না। (ক্রমশঃ)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours