কাজল ভট্টাচার্য, সিনিয়র জার্নালিষ্ট, কলকাতাঃ

এই তো কিছুদিন আগের কথা, বাচ্চাদের মুখস্থ হয়ে গেছিল এক নতুন সাপের নাম-
জাপানি সাপ।

টিভির পর্দায় থেকে-থেকেই ভেসে উঠত এক যৌনশক্তি বর্ধক তেলের বিজ্ঞাপন। জাপানি তেল। আর প্রতিবার চ্যানেলের অ্যাকাউন্টে জমা পড়ত মোটা অঙ্কের কড়ি। বেশ ঘটা করে সাপুড়ের বিন আর সাপের ছোবলের মতো যৌনতার ছোবল।

সেই ছোবল পড়ত শিশুমনেও। তারা অ্যানিমেল প্ল্যানেটের কেউটে দেখলেও বলে উঠত-
"মা মা, ওই দেখ সেই জাপানি সাপ।"
বাংলার এই চ্যানেলগুলিই আবার ফিবছর বিচার করতে বসে, বাঙালিদের মধ্যে সেরা কোনজনা। দ্বিচারিতার এক শেষ।
এখানেই শেষ না। সেরা ঐতিহাসিক বাঙালীদের সৃষ্টিকে রীতিমতো বিকৃত করা বিজ্ঞাপন প্রচার করে লাভের কড়ি ঘরে তোলাতো জলভাত। না আবেগ। না বিবেক। আসলে আবেগ না থাকলে বিবেকও থাকে না।

জাপানি সাপের ছোবল খাওয়া সেই বাচ্চাদের মুখেই শোনা গেছিলো-
"এমন দামে এমন বাড়ি পাবে নাকো আর"
বিজ্ঞাপনের আর এক চমক।

নতুন এই গানের গীতিকার ছিলো কোনও এক বিজ্ঞাপন সংস্থা। বাংলার এক প্রোমোটারি সংস্থার জন্য তারা মনমতো শব্দ বসিয়েছিল দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের সুরে। দ্বিজেন্দ্রগীতিকে বিকৃত করে মুনাফা লোটার এই স্পর্ধা হয় কিভাবে?

বাংলা বাঙালির সংস্কৃতিতে এই গানটা নিছক সুসঙ্গীত না, জড়িয়ে রয়েছে বাংলা বাঙালির আবেগ। সেন্টিমেন্ট।
রয়েছে এক গৌরবময় ইতিহাস।
"এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি"

1905 সাল। বঙ্গভঙ্গের পর উত্তাল গোটা ভারতবর্ষ। কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায় 'বঙ্গবন্দনা' করেছিলেন এই গান লিখে। সালটা ছিল 1909।

অনায়াসে ছিনতাই হয়ে গেল সেই ঐতিহাসিক পটভূমিকায় লেখা এক দ্বিজেন্দ্রগীতি। সেই বিকৃত দ্রিজেন্দ্রগান কানে ঢোকেনি কোনও বিদ্বজনের? আর ঢুকতোই বা কিভাবে, প্রমোটর চক্রের যা দাপাদাপি রাজ্যজুড়ে।
জেহাদিদের কোনও মোমবাতি মিছিলও বেরোয়নি।
শীতের দুপুরে পিঠে রোদ সেঁকতে-সেঁকতে অ্যাকাডেমি চত্বরে কোনও প্রতিবাদী ছবি আঁকতেও বসেনি।
'বিশ্ববাংলা'র প্রবক্তারা সবাই চুপ ছিলেন।
বাংলার দুর্দিন ঘোচাতে একসময় জোর ধরেছিলো 'নবজাগরণ'। উদ্যোক্তা বা পৃষ্ঠপোষকতা যাই বলুন না কেন, হাল ধরেছিল এক সংবাদপত্র কর্তৃপক্ষ। সঙ্গে রাজ্যের অনেক জ্ঞানীগুণীজন। বেশ জেলায় জেলায় ঘুরে চলতো বাংলার প্রচার। বহুমুখী উন্নয়নের আলাপ আলোচনা প্রস্তাবনা।
প্রতুলবাবু গাইতেন "আমি বাংলায় গান গাই"। ততদিনে অবশ্য বাংলা গানের স্বর্নযুগ শেষ। আধুনিক শিল্পীরা জীবনমুখী গান এনে ফের বাংলা গানের জীবনদান করতে চাইলেন। প্রথমচোটেই চমক। তবে তা এক গন্ডির মধ্যেই বাঁধা পড়লো। সর্বজনীন হতে পারলো না।
বাস্তবে বাংলার হালটা ওই সুয়োরানির মতোই। পকেটগরম বাঙালির টার্গেট ইংলিশ মিডিয়াম। পকেট গড়ের মাঠ বাঙালির জন্য বাংলা মিডিয়াম। সরকারি প্রাইমারী স্কুল। গেলেই দুপুরের একপেট খাওয়া। মিড ডে মিল। অনেকে যায় পড়তে। বাদবাকীরা যায় খাওয়ার গন্ধে।

এরপরেই আচমকা বাজারে হানা দিলো 'বাংলাপক্ষ'। শুরুতেই জেহাদি। রাজ্যের সর্বস্তরে বাংলার মর্যাদা চাই। মাল্টিস্টোরিডের পাহারাদার, ব্যাঙ্কের দারোয়ান, মেট্রো স্টেশনের সুরক্ষাকর্মীরা টার্গেট। তাঁদের বাংলা বলিয়েই ছাড়বেন। আবার কখনও কোনও অবাঙালি যাত্রীকে চেপে ধরা, কেন বাংলার নিন্দা করছেন? মারমুখী বাংলাপক্ষের বংজেহাদিরা। ভুল করেও এঁরা বড়বাজার বা রাজাবাজারে পা ফেলেন না কেন? কারণ সেখানে খাপ খুললেই বিপদ।

এই বাংলাপক্ষই আবার বিপদ ডেকে আনছে নাতো বাঙালির? পাশের রাজ্য ঝাড়খন্ড। প্রচুর বাঙালির বাস। সেখানে যদি অবাঙালিরা স্থানীয় বাঙালিদের ওপর শোধ তোলেন? একসময় ঠিক এই ধাঁচেরই আরেক সংগঠনের উদয় হয়েছিল ধুমকেতুর মতো। 'আমরা বাঙালি'। রাতারাতি ঢেঁড়া মেরে কেটে দেওয়া হতো হিন্দি ইংরেজিতে লেখা নাম। তারই যেন সংশোধিত রূপ আজকের বাংলাপক্ষ। তবে এই বাংলাপক্ষ কি সত্যিই বঙ্গপ্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে? নাকি আড়ালে অন্যকিছু খেলা চলছে? বঙ্গপ্রেমের গান গেয়ে বাঙালি ভজানো। কিন্তু তারপর?

"দুটি সংগঠনকে ভোট দেবেন না।" হঠাতই এমন এক খণ্ডদৃশ্য চোখে পড়লো সোশ্যাল মেডিয়ায়। যাদবপুর ছাত্র সংসদ নির্বাচনের প্রেক্ষিতে জানানো হলো বাংলাপক্ষের তরফে। প্রথমটি এবিভিপি, দ্বিতীয়টি সিএপি। আরও জানানো হলো, ? প্রথম সংগঠনটির টিকি বাঁধা বিজেপির কাছে। দ্বিতীয়টির বামপন্থীদের কাছে। এই দুই সংগঠনই নাকি বাংলাভাষা, সংস্কৃতিবিরোধী। স্বাভাবিকভাবেই মনে প্রশ্ন ওঠে, বাংলাপক্ষের নির্ভেজাল অরাজনৈতিক চরিত্র নিয়ে। নাকি বাংলা ভাষার ওকালতির সঙ্গে আড়ালে তাল মিলিয়ে চলছে রাজনীতির খেলাও?

তবু এরইমধ্যে চাপে পড়ে বেশকিছু জায়গায় সরকারি, বেসরকারি বোর্ডে বাংলা হরফ চোখে পড়ছে। তবে সেই হরফ পড়বে কে?
বাংলার আগামী প্রজন্মের এক সিংহভাগই এখন ইংলিশ মিডিয়াম। বাজারের বাজেটে কাটছাঁট করে স্কুলের বাজেটে বরাদ্দ বেড়েছে। মা বাবারা তাঁদের সন্তানের মুখে আধো উচ্চারণে ডগি, পটি শুনে আনন্দে শিহরিত হন। সেই সন্তানও বুলি ফুটলেই বুক চিতিয়ে বলে, "বাংলাটা আমার ঠিক আসে না।"

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours