সন্দীপ চক্রবর্তী, প্রবীণ সাংবাদিক, কলকাতা:

বাইবেল বা কোরান যে অর্থে ধর্মগ্রন্থ, সেই অর্থে কি গীতাকে ধর্মগ্রন্থ বলা যায়? সম্ভবত যায় না। কারণ হিন্দু ধর্মে কোনও প্রফেট বা মসিহা নেই। হিন্দু ধর্ম বা হিন্দুত্ব ভারতবর্ষের মানুষের জীবনযাপনের নির্যাস। গীতাও তাই বাইবেল বা কোরানের মতো কোনও বিশেষ উপাসনা পদ্ধতির কথা বলে না। কোনও রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডাও আমরা গীতায় পাই না। বরং গীতা সত্য এবং ন্যায়ের কথা বলে। আরও স্পষ্ট করে বললে গীতা জ্ঞান, কর্ম ও ভক্তিনির্ভর জীবনশৈলী এবং জীবনদর্শনের কথা বলে। 
  ভারতের দেশীয় লোকাচারে বিশ্বাসী মানুষকে নতুন করে গীতামাহাত্ম্য বোঝানোর দরকার পড়ে না। কিন্তু সমস্যা বাধে কমিউনিস্টদের নিয়ে। কারণ যে-সুদীর্ঘ মগজ ধোলাইয়ের পর একজন কমিউনিস্টের জন্ম হয় তারপর স্বাভিমান বলে কোনও বস্তু তার আর অবশিষ্ট থাকে না। এবারের বইমেলায় কমিউনিস্টদের এমনই এক স্বাভিমান-বর্জিত দলদাসত্বের নমুনা দেখা গেছে। এসএফআই এবং আরও কয়েকটি অতি বাম ছাত্র সংগঠনের যুবক-যুবতীরা বিশ্ব হিন্দু পরিষদের স্টলে গিয়ে হনুমান চালিশা বিতরণে বাধা দিয়েছেন এবং গীতায় পা রেখে সিএএ-বিরোধী স্লোগান দিয়েছেন। তাদের যুক্তি, বইমেলার ধর্মনিরপেক্ষ আবহে হনুমান চালিশা বিতরণ করা যায় না। কিন্তু গীতায় পা রেখে স্লোগান দিলে কোন ধর্মনিরপেক্ষতা সাধিত হয় সেটা তারা বলেননি। এটাও তারা বলেননি, ধর্মনিরপেক্ষতা লঙ্ঘিত হয়—ঠিক এই যুক্তিতেই কেন তারা বইমেলায় কোরান এবং বাইবেল বিতরণে বাধা দেননি। গীতা আক্ষরিক অর্থে হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ নয়, জীবনবেদ—কিন্তু বাইবেল এবং কোরান আক্ষরিক অর্থেই খ্রিস্টান ও মুসলমানদের ধর্মগ্রন্থ। ধর্মগ্রন্থ যে ধর্মেরই হোক, তার অবমাননা কিংবা উদ্দেশ্য স্বচ্ছ হলে বিতরণে বাধা কাঙ্ক্ষিত নয়। কিন্তু প্রশ্ন হল, তা হলে সিএএ-বিরোধী বিক্ষোভ দেখানোর জন্য হিন্দুদের কাছে ধর্মগ্রন্থেরও অধিক গীতাকে অবমাননা করা হল কেন? হনুমান চালিশা বিতরণেই বা বাধা দেওয়া হল কেন? প্রশাসন অবশ্য কোনও ঝুকি নেয়নি। মহান বিপ্লবীদের সঙ্গে তাল ঠুকেই হনুমান চালিশা বিতরণ বন্ধ করে দিয়েছে। সেইসঙ্গে পুলিশকর্তারা হুমকি দিয়ে গেছেন যদি আবার হনুমান চালিশা বিতরণ করতে দেখা যায় তা হলে তারা বিশ্বহিন্দু পরিষদের স্টলটিও বন্ধ করে দেবেন।
 নরম বাম এবং গরম বাম বিপ্লবীদের এই বৃহন্নলাবৃত্তির সম্ভাব্য কারণ আমরা পরে অনুসন্ধান করব। তার আগে জানা দরকার হনুমান চালিশা বিতরণে বাধা দেওয়ায় বামেদের বিরুদ্ধে সেদিন সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল। বিশেষ করে সেইসব মানুষের প্রতিক্রিয়া নিশ্চয়ই খুব উপভোগ্য হবে যারা ঘটনার সময় বিশ্বহিন্দু পরিষদের স্টলে উপস্থিত ছিলেন। এ ব্যাপারে কথা বলেছিলাম বিশ্বহিন্দু পরিষদের প্রদেশ ধর্মাচার্য সম্পর্ক প্রমুখ শ্রী বিশ্বজিত দাসের সঙ্গে। তিনি জানিয়েছেন, বামেরা তাদের পরিকল্পিত অপারেশন শুরু করা মাত্র স্টলে উপস্থিত ক্রেতাদের মধ্যে এক অদ্ভুত দেশাত্মবোধ লক্ষ্য করা গিয়েছিল। বিশ্বহিন্দু পরিষদের কার্যকর্তারা কিছু করার আগেই তারা দলবদ্ধ ভাবে বাইরে গিয়ে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে মোকাবিলা করেন। এদের মধ্যে অনেক মহিলাও ছিলেন। সাধারণ মানুষের প্রতিরোধের সামনে বীরপুঙ্গবেরা পিছু হটে। তবে পালিয়ে না গিয়ে দূর থেকে স্লোগান দিতে থাকে, আরএসএসের চামড়া গুটিয়ে দেব আমরা! বিশ্বজিতবাবু আরও জানিয়েছেন, প্রতি বছরই কয়েকটি বামপন্থী ছাত্র সংগঠন বিশ্ব হিন্দু পরিষদের স্টলের সামনে এসে নানারকম অশান্তি করে। এবারও ওদের কর্মসূচি আগে থাকতে ঠিক করা ছিল। বিকেল থেকেই বইমেলার সাত নম্বর গেটের কাছে জড়ো হচ্ছিল ওরা। মেলায় ভিড় বাড়তেই স্টলের সামনে এসে শুরু করে দিল স্লোগানবাজি। দশ বছর ধরে বিশ্বহিন্দু পরিষদ বইমেলায় অংশগ্রহণ করছে। কোনও বারই তারা এই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হেনস্থার বিরুদ্ধে সরকারিভাবে কোনও অভি্যোগ করেনি। বুঝিয়েসুঝিয়ে বিক্ষোভকারীদের নিরস্ত করার চেষ্টা করেছে। কারণ যে-কোনও সুসভ্য সংগঠনের মতো তারাও বইমেলাকে রাজনীতির আখড়া বানাতে চান না।
 প্রশ্ন হল বইমেলাকে রাজনীতির আখড়া বানাতে চায় কারা? অবশ্যই তারা এখন যাদের পিছনে খাদ আর সামনে বাঘ। পশ্চিমবঙ্গে বামেদের ভোট ৮ শতাংশে এসে নেমেছে এবং তাদের ভোটের সিংহভাগ গেছে বিজেপির দিকে। সেইজন্য হিন্দুত্ববাদী বিজেপির সমমনস্ক সংগঠন বিশ্বহিন্দু পরিষদের স্টলে সুপরিকল্পিত ভাবে হামলা করেছে বামপন্থীরা। এর অন্যতম উদ্দেশ্য জাতীয়তাবাদী আদর্শে উদবুদ্ধ হিন্দুদের মনে ভয় ধরানো এবং একটি বিশেষ সম্প্রদায়কে বার্তা দেওয়া যে, দ্যাখো আমরা তোমাদের সঙ্গে আছি। হিন্দুরা ভয় পেলে বিচ্ছিন্ন হবে আর ওই বিশেষ সম্প্রদায়টি সাহস পেলে সংঘবদ্ধ হবে। বামেদের সঙ্গে ওই বিশেষ সম্প্রদায়টির সখ্য নতুন নয়। কাশ্মীরে শেখ আবদুল্লা যখন ন্যাশনাল কনফারেন্স পার্টি গঠন করেন তখন কমিউনিস্টরাই ছিল তার প্রধান সঙ্গী। পরবর্তী কালে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের ওপর ভয়াবহ অত্যাচারেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন কমিউনিস্টরা। ভুলে গেলে চলবে না, জিন্নার দেশভাগের দাবিকে সমর্থন করেছিল কমিউনিস্টরা। স্লোগান দিয়েছিল, পাকিস্তান মানতে হবে তবে ভারত স্বাধীন হবে। ১৯৪৬ সালে গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংয়ের কয়েকমাস আগে মনুমেন্টের পাদদেশে ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে-র সমর্থনে যে-সভা হয়েছিল তাতে জিন্নার পাশে মঞ্চ আলো করে বসেছিলেন কমরেড জ্যোতি বসু। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পর রাজাকার বাহিনীর কুখ্যাত মুসলমান গুন্ডারা যখন পশ্চিমবঙ্গে পালিয়ে এল তখন তাদের কলকাতার রাজাবাজারে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল কমিউনিস্টরা। ১৯৮০ সালে কলকাতা পুলিশের ডিসি বিনোদ মেহতার হত্যাকান্ডে এই ভোল পালটানো রাজাকারদের হাত ছিল বলে অনেকে অনুমান করেন । ২০০০ সালে রাজাবাজারের এই গুন্ডারা যখন তসলিমা নাসরিনের মুণ্ডচ্ছেদের ফতোয়া জারি করল তখন সংস্কৃতিমনস্ক কমিউনিস্ট মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ভয়ে গুটিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি বলতে পারেননি কলকাতা ভারতের সাংস্কৃতিক রাজধানী। এ শহর কোনও লেখককে নির্বাসিত করতে পারে না। বলতে পারেননি কারণ ভোটের জন্য বুদ্ধদেববাবুর ওই মুসলমান গুন্ডাদের দরকার ছিল। তাই তারা বারবার হিন্দুদের অপমান করেছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবকে মৃগী রোগী বলেছেন। স্বামীজীকে ‘চাকরি পাননি তাই সন্ন্যাসী হয়েছিলেন’ বলে কটাক্ষ করেছেন।
 সুতরাং বুদ্ধদেববাবুদেরই উত্তরপুরুষ এখনকার কমিউনিস্টরা যে ভোটের জন্য আরও এককাঠি ওপরে গিয়ে গীতাকে পদদলিত করবেন তাতে আর আশ্চর্য কী! বড়ো তো শুধু গাছ হয় না, আগাছাও হয়। আগাছা খুব বেড়ে গেলে সুগৃহিণী তা কেটে দেন। বদলে যাওয়া ভারতের মানুষ যে গৃহিণীপনায় বেশ দক্ষ হয়ে উঠেছেন তার প্রমাণ ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের পশ্চিমববঙ্গ। আর ২০২০-এর বিধানসভা নির্বাচনের দিল্লি। দুটি জায়গাতেই বামপন্থীরা জনসমর্থন হারাতে হারাতে বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতিতে পরিণত হয়েছেন। গীতার অবমাননা তাদের ভালোমন্দ কিছু একটা করে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার মরীয়া প্রয়াস ছাড়া আর কিছুই নয়। তবে এই প্রয়াস যদি অদূর ভবিষ্যতে বুমেরাং হয়ে যায়, যদি তারা বিলুপ্তপ্রায় থেকে বিলুপ্ত প্রজাতিতে পরিণত হন এবং যদি বিশ্বের বহু দেশের মতো ভারতেও কমিউনিজমের ফসিল দেখার জন্য জাদুঘরে বিশেষ প্রদর্শনীর ব্যবস্থা থাকে তা হলে তাতে অবাক হবার কিছু নেই। ভাবীকালের ভারতীয়রা ঠিকই বুঝতে পারবে ইসলামি শাসকদের মতো কমিউনিস্টরাও এ দেশের হাজার হাজার বছরের আইডেন্টিটি ধ্বংস করতে চেয়েছিল, দেশটাকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে কলোনাইজ করতে চেয়েছিল—তাই কালের নিয়মে তারা নিজেরাই লুপ্ত হয়ে গেছে।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours