কাজল ভট্টাচার্য, সিনিয়র জার্নালিষ্ট, কলকাতা:

- মোদি সরকারের নাগরিক বিল মানছি না। মানবো - না।
- কেন?
- গাঁধিজির সেকুলার ভারতের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়।
- বেশ।

নির্ভয়াকাণ্ডের চার আসামীর ফাঁসির বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলছেন না কেন? গাঁধিজি তো যে কোনও প্রাণদণ্ডের বিরোধী ছিলেন। এবেলায় কি গাঁধির মতাদর্শের খেলাপ হচ্ছে না?
কী বলেন গাঁধি পদবিধারী রাহুল, সনিয়া, প্রিয়াঙ্কা? নাগরিক বিলের বিরোধিতায় গাঁধিজি আচমকাই যেন বড্ড প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছেন যাবতীয় ডান, বাম, পদ্মশিবির বিরোধীদের কাছে।
গোটাটাই ভোটব্যাঙ্ক রাজনীতি নয় তো?

নাগরিক বিলের বিরোধিতায় দেশটা গাঁধির। নির্ভয়াকাণ্ডের আসামীদের ফাঁসির দাবিতে দেশটা গাঁধির থাকছে না কেন?

"Those under a death sentence should not be hanged but also that they should not be kept in prison."
শুধু ফাঁসিতে ঝোলানো বন্ধ করলেই হবে না, কয়েদি করে রাখাও চলবে না। প্রসঙ্গ, পরাধীন ভারতবর্ষে প্রাণদণ্ডের আদেশ। আসামী ভারতের অগ্নিযুগের তিন বীর সেনানী ভগত সিং, সুখদেও, রাজগুরু।
সে সময়ে ঝড় উঠেছিল গাঁধিজির ভূমিকা নিয়ে। তবে সে অন্য প্রসঙ্গ। মোদ্দা কথা, সেদিন প্রাণদণ্ডের বিরুদ্ধে এলাহাবাদে সরাসরি ওই দাবি তুলেছিলেন গাঁধিজি।
দিনটা ছিলো ১৯৩১ সালের ৩১ জানুয়ারি। তাহলে কি শুধু স্বাধীনতা সংগ্রামীদের হয়ে সওয়াল করতেই প্রাণদণ্ড মকুবে সোচ্চার হয়েছিলেন বাপু?

না। তাঁর এই মত ছিলো প্রতিটি অপরাধীর জন্যই। পরের বক্তব্যটা দেখলেই তা পরিষ্কার হবে।
 ১৯৩১ সালের ৭ মার্চ। দিল্লির এক জনসভায় গাঁধিজি ফের বলেছিলেন- "I cannot in all conscience agree to anyone being sent to gallows..."
কোনও অজুহাতেই গাঁধিজি কাউকে ফাঁসিকাঠে পাঠাতে রাজি ছিলেন না।

নির্ভয়াকাণ্ডের চার আসামী।
তাদের মৃত্যু উৎসবের আয়োজন শুরু হয়েছিলো বছরের গোড়াতেই। বাইশে জানুয়ারি সকাল সাত ঘটিকায়। ঠান্ডা মাথায় মেরে ফেলার কথা ছিলো চার ধর্ষককে। আইন আদালতের গেঁড়োতে ঝুলে গেলো সেই ফাঁসির ফতোয়া। আরও কয়েকটা দিনের জীবন বরাদ্দ হলো ধর্ষকদের। হতাশ গোটা দেশ। দেশের আইন- কানুন নিয়ে সরাসরি মুখ খুললেন নির্ভয়ার মা- বাবা। পাশে তাঁদের সহস্র সমব্যাথী। কিন্তু ঘটনা যখন ব্যক্তিগত, তখন মতটাও ব্যক্তিগত। খুন কা বদলা খুন। হিংসার বদলে হিংসা। সেখানে ব্রাত্য বাপু।

"সবকো সম্মতি দে ভগবান !"
ভগবান যে সবাইকে সম্মতি দেননি তা পরিষ্কার। গাঁধিজিকে নিয়ে আমরা যতোই নাচানাচি করি না কেন, তাঁর উল্টো সুর গাইতেও আমাদের দেরি হয় না।
শেষকথা, আমাদের ইচ্ছাপূরণ।

সেদিন গোটা দেশ ফুঁসছিলো গাঁধিহত্যার ঘটনায়। নাথুরাম গডসের ফাঁসির দাবিতে সেদিনও আজকের নির্ভয়াকাণ্ডের মতোই, রাস্তায় নেমেছিলেন মানুষ। কিন্তু তখনও অবিচল জাতির জনকের দুই পুত্র রামদাস আর মণিলাল। না, কোনও ফাঁসি নয়। তাঁরা ক্ষমা করে দিতে বললেন তাঁদের পিতৃহন্তাকারী নাথুরাম গডসেকে। এমনই মতাদর্শের জোর!
গোনা শুরু হয়ে গেছিলো চার ধর্ষকের জীবনের কাউন্টডাউন। কয়েকটা দিনের ফারাক। তারপরেই বাইশে জানুয়ারির সকালে উড়ে যাওয়ার কথা ছিলো চার প্রাণপাখির। ঘোর অমঙ্গলের সেই খবর পৌছে গেছিলো চার অপরাধীর ঘরে।
মেয়ের নৃশংস হত্যার পর, একদিন যে জ্বালায় জ্বলেছিলেন নির্ভয়ার মা- বাবা, ফাঁসির দিনক্ষণ ঘোষনার পর থেকেই সে জ্বালায় অবধারিত ভাবেই জ্বলেছিলো ধর্ষকদের চার চারটা পরিবারের। একের বদলা চার। তবেই না শাস্তি। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই ধর্ষকদের। দাবি তুলেছিল গাঁধির ভারতবর্ষ।
গাঁধির স্বপ্নের স্বাধীন ভারতবর্ষ ঠিক কেমন হবে, তা নিয়ে ভারী সুন্দর কথা বলেছিলেন এক গাঁধি অনুরাগী। তাঁর নাম জুগতরাম দাভে। তিনি বলেন, "গডসেকে ফাঁসি না দিয়ে সূচনা হোক প্রাণদণ্ডহীন স্বাধীন ভারতের।" গাঁধিজির একনিষ্ঠ শিষ্য মহাদেব দেশাইয়ের ছেলে নারায়ণ দেশাই গাঁধিজির জীবনকথায় দাভের ওই মত জানিয়েছিলেন।

কিন্তু প্রাণদণ্ড কি আদৌ কোনও শাস্তি, নাকি প্রতিশোধ?
শাস্তি দেওয়া হয় সংশোধনের জন্য। আমাদের কারাগারগুলিও বহুদিন আগেই নাম পাল্টে সংশোধনাগার। নামবদলের এই সিদ্ধান্তে যেন প্রতিফলিত হয়েছিল গাঁধিজির মতাদর্শের। কিন্তু এ কেমন শাস্তি যেখানে সংশোধনের কোনও সুযোগ থাকে না?
প্রাণ দেওয়ার ক্ষমতা যখন নেই, তখন প্রাণ কেড়ে নেওয়ার অধিকারও থাকতে পারে কি? এমন নানা সওয়াল জবাবের ঝড় উঠেছে নানা সময়ে বিভিন্ন স্তরে।

বিশ্বের অনেক দেশই প্রাণদণ্ড দেওয়ার রাস্তা থেকে সরে এসছে। এমনটাই দাবি অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সমীক্ষায়। জানানো হয়েছে, অন্তত একশো ছ'টি দেশ ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে ফাঁসির দড়ি। ২০১৮ সালের ওই সমীক্ষায়, অন্য আরও একশো বিয়াল্লিশটা দেশে ফাঁসির আইন থাকলেও, কোনও অপরাধীকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয় না।
যে দেশগুলিতে আজও ফাঁসিতে ঝোলানো হয়, সেখানেও কমে আসছে প্রাণদণ্ডের সংখ্যা। কুড়িটি দেশে মোট নশো তিরানব্বইজনকে ফাঁসিকাঠে তোলা হয় ২০১৭ সালে। পরের বছর তা কমে দাঁড়ায় ছশো নব্বইয়ে।
তবে ব্যতিক্রম আমাদের প্রতিবেশী দেশ চীন। সেখানে ঠিক কতজনের প্রাণদণ্ড হয়, তা জানার কোনও উপায় থাকে না।
যে দেশগুলিতে আজও ফাঁসি হয় তারমধ্যে আছে, ইরান, ইরাক, সৌদি আরব আর ভিয়েতনাম। গোটা দুনিয়ায় যে একশোজনকে ফাঁসিতে লটকানো হয়েছে, তারমধ্যে আটাত্তরজনই ওই চার দেশের।

গাঁধিজির দেশে প্রাণ কেড়ে নেওয়ার পথ অবশ্য আজও দুর্গম। আদালত মোটেই সেই রাস্তায় পা বাড়াতে চায় না। আবার আদালত চাইলেও আইন তার পথ রুখে দাঁড়ায়। রাস্তা সন্ধান ফাঁসির রশি থেকে পালানোর। আদালতও যথেষ্ট সহিষ্ণু। অপরাধীর জন্য সব রাস্তা খোলা রাখে। সবরাস্তা বন্ধ হলে, তবেই চরম দণ্ড। ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট। যথেষ্ট মানবিক ব্যবস্থা। তবু প্রশ্ন থেকেই যায়। যেরকম প্রশ্ন থেকে গেছে আর এক ধর্ষক ধনঞ্জয়ের ফাঁসি নিয়ে। কাল আরও একটি ফাঁসি নিয়ে প্রশ্ন উঠবে না, সেকথা হলপ করে কে বলতে পারে?

ফাঁসি বলতে গেলে অবধারিত নির্ভয়াকাণ্ডের চার ধর্ষকের। অপরাধীদের আইনজীবী তাঁর নিজের কাজটা করে চলেছেন। মক্কেলদের বাঁচাতে চাইছেন ফাঁসির দড়ি থেকে। সুযোগ নিচ্ছেন আইনি মারপ্যাঁচের। আর ঠিক তখনই জেলের সেলে প্রাণভয়ে কুঁকড়ে প্রমাদ গুণছে নিষ্ঠুর অপরাধীরা।

একবার ফাঁসির দিন ঠিক হয়, রক্তচাপ বেড়ে যায় আসামীদের। কান ভোঁভোঁ। মাথা কাজ করে না। সে মুহূর্তে আসামীও বুঝতে পারে মৃত্যু কত ভয়ঙ্কর। তার কাছে মৃত্যু আসে বলে কয়ে। প্রতি মুহূর্তে দিনের পর দিন না মরেও, মৃত্যুর সঙ্গে সহবাস।
মৃত্যুর চেয়েও অনেকবেশি যন্ত্রণার মৃত্যুভয়। লিভারে টান পড়লেই ফাঁসুরের দড়িতে ঝুলে পড়া। কয়েক মুহূর্তের ছটপট। তারপরেই সব অনুভূতি শেষ। জ্বালা যন্ত্রণার ইতি। মৃত্যুর শীতলতায় পরিসমাপ্তি।

সেদিন যন্ত্রণায় কাতরে উঠেছিল নির্ভয়াও। শুধু ধর্ষণেই রক্তাক্ত না, নারীখাদকের বিকৃত অত্যাচারে। শুধু খুন করাই উদ্দেশ্য ছিলো না। যন্ত্রণা দিয়ে তিলে তিলে নির্ভয়াকে মারা হয়েছিল। বিকৃত উল্লাসে মেতেছিল ধর্ষকরা। সেই ঘৃণ্য অপরাধের শাস্তি মৃত্যু।
কেন?
গাঁধিজির মতো ঠিক অতটা উদার হয়ে, অপরাধীদের কয়েদখানার বাইরে আনার কথা বলতে পারবো না। কিন্তু, ধর্ষকদের মৃত্যু আতঙ্ককে দীর্ঘায়ত করলে কেমন হয়? প্রতি মুহূর্তে মৃত্যু। বাদবাকী জীবন কাটুক কারাগারের(সংশোধনাগার না) নিকষ কালোয়। আজীবন ভোগ করুক মৃত্যুযন্ত্রণা।

ফাঁসি বরাদ্দ থাকুক একমাত্র তাদের জন্যই, যারা দেশের সার্বভৌমত্বকে চ্যালেঞ্জ জানায়। নইলে, খুন কা বদলা খুন কখনোই নয়। ফাঁসি দিয়ে যে অপরাধীদের দমানো যায় না, তা বহু প্রমাণিত।

শাস্তির অজুহাতে, গাঁধির দেশটা গডসেতে না ভরে যায়।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours