শিবাশীষ বসু, ফিচার রাইটার, উত্তরপ্রদেশ:

রবীন্দ্রনাথের পরামর্শ মেনে লিখে চললেন প্রমথনাথ। প্রথম অধ্যায় 'পরমাণুলোক'-এর লেখা শেষ করে রবীন্দ্রনাথের কাছে আগেই পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল। এবার পর পর লেখা হল নক্ষত্রলোক, সৌরজগৎ, গ্রহলোক, ভূলোক এবং উপসংহার ইত্যাদি অধ্যায়। "মনে আছে দু-ঘন্টায় এক পৃষ্ঠার বেশি এগোতে পারা গেল না, অনভ্যস্ত নূতন পথে চলতে বারবার আড়ষ্টতা এসেছে, আবার নূতন উদ্যমে চলতে হয়েছে।" লেখার পাশাপাশি চলতে লাগলো রবীন্দ্রনাথের সংশোধন।

কদিন বাদে গুরুদেব ডেকে পাঠিয়ে বললেন, "বিশ্বরচনা বইটার যে-কলেবর হতে চলেছে তাতে তার অঙ্গচ্ছেদ করা তিনি আবশ্যক বলে মনে করেন। দুটো আলাদা বই হলেই ভালো হয়।" (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৫৯) রবীন্দ্রনাথ স্থির করলেন, দুটো বইয়ের নাম হবে - 'বিশ্বপরিচয়' ও 'পৃথ্বীপরিচয়''। আদেশ হল বিষয়বস্তুও পুনর্বিন্যাস করবার।

গরমের ছুটিতে গুরুদেব আলমোড়া যাবেন। তার আগে প্রমথনাথের উপর আদেশ হল, 'বিশ্বপরিচয়'-এর সমস্ত পান্ডুলিপি সম্পুর্ণ করে দ্রুত ওঁর হাতে তুলে দিতে হবে। আলমোড়ায় নিভৃতে "বিশ্বপ্রকৃতির সান্নিধ্যে" বসে উনি গ্রন্থের পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের কাজটি সমাধা করবেন। ফিরে এসে বইখানি ছাপাবার ব্যবস্থা হবে বিশ্বভারতী প্রেসে। "বিশ্ব-পরিচয়-এর শেষ অধ্যায় লিখে দিয়ে এলাম গুরুদেবের হাতে। এটা সংশোধিত হয়ে ফিরে এলে তৈরি করতে হবে নতুন করে সমগ্র পাণ্ডুলিপি সুন্দর নির্ভুলভাবে লিখে, তারপর তা তুলে দিতে হবে ওঁর হাতে, আলমোড়া যাবার আগে - এই হলো গুরুদেবের নির্দেশ।" দীপঙ্কর চট্টোপাধ্যায় লিখছেন, "এই অবস্থাতেও কিন্তু প্রমথনাথের করা খসড়া এবং রবীন্দ্রনাথ কতৃক তার সংশোধন, কাজের এই ধারা বজায় থেকেছে।"

এর পরই আরম্ভ হল, নাটকের পরবর্তী পর্যায়।

গুরুদেবের আলমোড়া যাওয়ার আগের দিন বিকালে তাঁর নির্দেশমত গ্রন্থের চুড়ান্ত পাণ্ডুলিপি তৈরী করে রবীন্দ্রনাথকে দিতে যাওয়ার জন্য প্রমথনাথ বাড়ি থেকে বার হতেই দেখেন ডঃ ধীরেন্দ্রমোহন সেন দরজার সামনে। তিনি বললেন, "আপনার বইয়ের 'ম্যানাসক্রিপট' নিয়ে গুরুদেবের কাছে যাচ্ছেন বুঝি, আমাকেও ডেকেছেন, চলুন না একসঙ্গে যাই।" পাঠকপাঠিকগণ, ডঃ সেনের বক্তব্যের "আপনার বইয়ের" - এই শব্দবন্ধটি নজর করবেন কিন্তু।
যাইহোক, দুজনে একসঙ্গেই রবীন্দ্রনাথের কাছে গেলেন।
খুবই আগ্রহের সঙ্গে গুরুদেব পাণ্ডুলিপিটি গ্রহণ করলেন। বললেন যে, আলমোড়ায় নিভৃতে বসে ভাষার দিকটা আরও মাজাঘষা করবার সময় পাবেন। একথা সেকথার পর "ডক্টর সেন হঠাৎ ওঁকে বললেন, 'বিশ্ব-পরিচয় নিয়ে আপনি যে পরিশ্রম করেছেন, তাতে বইটার যুক্ত-গ্রন্থকার হওয়া উচিৎ - রবীন্দ্রনাথ-প্রমথনাথ।' গুরুদেব সঙ্গে সঙ্গে বললেন, 'সে কি রে, বইটার বিষয়বস্তু রচনার কাজ তো প্রমথই করেছে, আমি শুধু ভাষার দিকটা দেখে দিয়েছি। গ্রন্থকার তো প্রমথনাথ হওয়াই উচিত, তবে আমার নামের সঙ্গে যদি প্রমথ যুক্ত করতে চায়, তাহলে প্রমথনাথ-রবীন্দ্রনাথ হওয়াই ঠিক হবে'।" আশীষ লাহিড়ীর মতে, "আইনস্টাইন-বোস-এর বদলে বোস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যান নাম দেওয়ার বহু-প্রচারিত কাহিনীটি রবীন্দ্রনাথের সম্ভবত অজানা ছিল না।"

এইসব কথাবার্তার ধরণ দেখে প্রমথনাথের মনে হল, বিশ্বপরিচয় বইটার লেখকের নাম নিয়ে কোথায় যেন একটা সংশয় জেগেছে। নিঃসন্দেহে এটা প্রমথবাবুর জন্য বড় রকমের ধাক্কা ছিল। তিনি তো গোড়া থেকেই ভেবেছিলেন যে তাঁর নামেই বইটা হবে। বইয়ের সব তথ্যও তো তাঁরই যোগাড় করা। মূল খসড়াটিও তাঁর। এরপরেও রবীন্দ্রনাথ যেহেতু ভাষার সবকিছু ঢেলে সাজিয়েছেন, সেহেতু যুক্ত-গ্রন্থকার নামে পরিচিত হলেও হয়তো খুব বেশি হারাবার নেই বলেই ভাবলেন প্রমথনাথ। দীপঙ্কর বাবু লিখছেন, "বলা বাহুল্য, প্রমথনাথ ঠিকই বুঝেছিলেন। কয়েক বছর ধরে প্রমথনাথের পুস্তক রচনার যে অভিনব উদ্যমটি চলে আসছিল, এতদিনে রবীন্দ্রনাথ তার অসঙ্গতিটা বুঝতে পারেন। কিন্তু এতদিনের প্রতিশ্রুতির বন্ধন সহসা ছিন্ন করতে প‍ারছিলেন না। তাই এই ছোট্ট নাটিকাটির অবতারণা।" (পৃষ্ঠা ২৮৫, রবীন্দ্রনাথ ও বিজ্ঞান, দীপঙ্কর চট্টোপাধ্যায়, আনন্দ পাবলিশার্স)

ডঃ সেনের অযাচিতভাবে প্রমথনাথের বাড়ি আসা, একসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কাছে যেতে চাওয়ার প্রস্তাব করা এবং এইভাবে শেষ মুহুর্তে যু্গ্ম গ্রন্থকারের নাম প্রস্তাব করা - সবটাই কি তাহলে গট-আপ?

য‍াইহোক, বহু পরিশ্রমে যে সংশোধিত পাণ্ডুলিপিটি তৈরী হল, ১৯৩৭ সালের গ্রীষ্মে আলমোড়া গিয়ে রবীন্দ্রনাথ তা মাজাঘষা করলেন।

এর বেশ কিছুদিন পর হল নাটকের আসল ক্লাইম্যাক্স !

(চলবে)

তথ্যসূত্র :
বিশ্বপরিচয়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ
রবীন্দ্রনাথ ও বিজ্ঞান, দীপঙ্কর চট্টোপাধ্যায়, আনন্দ পাবলিশার্স
রবি ঠাকুর, রাহাজানি এবং রবীন্দ্র পুজারীবৃন্দ, অভিজিত রায় ফরিদ আহমেদ, মুক্তমনা ডট কম
রবীন্দ্রনাথ : মানুষের ধর্ম মানুষের বিজ্ঞান, আশীষ লাহিড়ী, অবভাস
আনন্দরূপম, সঞ্জীব মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত, সাহিত্য সংসদ

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours