চৈতালী সেনগুপ্ত, লেখিকা, কলকাতা:

             আজ ২১ শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।আজ সারা বিশ্বে এই দিনটি পালিত হলেও  এর সূত্রপাত ঘটেছিল বাংলাদেশে। এই দিনটি পালনের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে বেশ কিছু মানুষের আত্মত্যাগের ইতিহাস । একটু সংক্ষেপে বিষয়টা বলি : 
       ১৯৫২ সালের এই দিনটিতে পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকা শহরে বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। ১৪৪ ধারা অমান্য করে রাজপথে নামে কিছু তরুণ।এই আন্দোলনকে প্রতিহত করতে পাকিস্তানী সরকারি বাহিনী নির্বিচারে গুলি চালায়, ‌শহীদ হন আবুল বরকত, আব্দুল জব্বার,আব্দুস সালাম এবং আরো অনেকে। এই ঘটনার প্রতিবার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজের হোস্টেল প্রাঙ্গণে সমবেত হন মানুষ। পরের দিন ২২শে ফেব্রুয়ারি সাধারণ মানুষ রাজপথে নামেন।২৩শে ফেব্রুয়ারি রাতারাতি হোস্টেল প্রাঙ্গণে শহীদদের প্রতি সম্মান জানিয়ে নির্মিত হয় স্মৃতিস্তম্ভ। ২৬ শে ফেব্রুয়ারি সরকারের পক্ষ থেকে সেই স্তম্ভকে  ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। এই ঘটনাটি একটি গভীর ক্ষতের মত সমগ্র বিশ্বে সাড়া ফেলে।
       ১৯৯৯ সালে ১৭ই নভেম্বর ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে ইউনিসকোর ৩০তম অধিবেশনে ২১শে ফেব্রুয়ারি দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে পালনের ঘোষণার প্রস্তাব পাস করা হয়। এরপর থেকে ২০০০সাল থেকে এই দিনটিকে ১৮৮ টি দেশ মাতৃভাষা দিবস হিসাবে পালন করা হয়।
         সেদিক থেকে দেখলে এই দিনটি তাৎপর্য যাই হোক গুরুত্ব কজনে বোঝেন বলা কঠিন। বলতে লজ্জা করে, আর সব ভাষাভাষী মানুষ থেকেও বাঙালীদের বাংলা ভোলার রোগ আছে। এই বাংলার থেকে শুরু তে ভাষা আন্দোলন, এই বাংলায় তার অবমাননা সবথেকে বেশি। আমি বন্দুকটা অন্যের ঘাড়ে সবসময় না রেখে নিজেকেও দোষের অংশিদার ভাবি সবার আগে।  আমরা খুব সাধারণ ভাবে মানুষ হয়েও ছেলেমেয়েদের বেলায় যদিও চেয়েছিলাম ওরা বাংলা ইংরেজি দুইই শিখুক, কিন্তু পালন করতে পারিনি।ওরা বাংলা শেখে প্রথম শ্রেণী থেকে। বেসরকারি বিদ্যালয়গুলিতে বাংলায় কথা বলা নিষেধ। আমরা প্রতিবাদ করিনা অথচ ভাষা দিবস পালন করি। খুব কম গুরুত্ব দিয়ে বাংলা পড়ানো হয়, যা খুশি বানান লিখতে পারলেই নম্বর দেওয়া হয়, নিজেদের অজান্তে বাচ্চাদের মনে বাংলাকে কম গুরুত্ব দেওয়ার বীজ ঢুকিয়ে দেই। আমরা ভাষা দিবস পালন করি। ভাগ্যিস পালন করি, একটা দিন তো একটু বাংলা বাংলা করি। আমরা আমাদের উত্তরসূরিদের .....ওরে খেতে আয় বলি না, বলি honey have your lunch. বাংলার তারিখ সাল মনে রাখি না। ঘরে বাইরে বাংলা কথা বলতে বেশি পছন্দ করি না। কোথাও কোথাও বাংলায় কথা বললে সামনের মানুষটি এমন অদ্ভুত রকম  ভাবে তাকায় যেন এইমাত্র নেপচুন গ্রহ থেকে কোন অবতার এসে পড়েছে। আমরা লজ্জা বোধ করি অথচ আমরা এই একটা দিন ভাষা আন্দোলন , ভাষা আন্দোলন বলে খুব চিৎকার করি।
        আমরা জন্ম থেকে কলকাতা বা বাংলায় থেকে একটু দেশের বাইরে পা দিয়েছি কি, বাংলায় আদৌ কোনদিন কথা বলিনি এরকম ভাবে দেখাতে থাকি অথবা একটা লাইন বলতে তিনবার হোঁচট খেয়ে আকাশে চোখ তুলে ভাব দেখাই ,সঠিক বাংলাটা বলতে পারছিনা। হঠাৎ কলকাতায় ফিরে, দাদা কে হঠাৎ করে ভাইয়া ডাকি। আমরা নিজেদের শুদ্ধিকরণ করিনা।  আমরা বাঙালি। আবার এমনও দেখেছি যারা জন্ম থেকে বাইরে থেকেছেন, পড়াশুনা করেছেন তারা নিজেরাই বাঙালিদের বলে থাকেন, বাঙালি মানেই নাকি 'বোকা বোকা' রবীন্দ্র সংগীত গায়। এই এতো চালাক চালাক মানুষ গুলোর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এক মহাসমুদ্র সমান জ্ঞানের ছিঁটে ফোঁটা জ্ঞান কপালে জোটে না হয়তো, তারা জানে না বাংলা শুরু মাত্র রবীন্দ্রনাথে সীমাবদ্ধ নয়, নজরুল, সুকান্ত, জীবনানন্দ, জসিমউদ্দিন,মাইকেল মধুসূদন, বিভূতিভূষণ, শরৎচন্দ্র, সুকুমার রায়, ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর, সুভাষ চন্দ্র বসু, ক্ষুদিরাম,সূর্যসেন, বিবেকানন্দ, রাজা রামমোহন আরও কত। তারা জানে না বাংলা মানে আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু,  সত্যজিৎ রায়,উত্তমকুমার, সুচিত্রা সেন, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, সৌরভ গাঙ্গুলি, দিব্যেন্দু বড়ুয়া আরও অনেকে।
         আমরা "মাথায় ছোট বহরে বড় বাঙালি সন্তান" নিজেদের  উগ্রতা টিটকারি মারতে জানিনা। আজ আসুন না আমরা বরং নিজেদের দুর্বলতা গুলো নিয়ে একটু সচেতন হই। নিজেদের সংশোধন করে আবার একবার বিশ্বের দরবারে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করতে পারি।  ২০০২ সালে সিয়েরা লিওনের দ্বিতীয় সরকারি ভাষা হিসেবে বাংলাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ২০১৯ সালে ইংল্যান্ডে বাংলা ভাষাকে ২য় বহুল প্রচলিত ভাষার সম্মান দেওয়া হয়েছে। এখনও কি আমরা  আমাদের মানসিকতার এতোটুকু উন্নতি আশা করতে পারিনা? দায়িত্ব সবার আছে। একটু সহযোগিতা প্রয়োজন।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours