শ্রাবণী দাশগুপ্ত, লেখিকা, কলকাতা:

আগে রেডিওতে রাত্রে ‘সমীক্ষা’ বলে অনুষ্ঠান থাকত। এখনও নিশ্চয়ই থাকে। আমার রেডিও নেই তাই জানিনা। আমার টিভি আছে, আমি দেখি। আলগোছে খবর দেখি, টুকটাক অন্য প্রোগ্রাম দেখার জন্যে চ্যানেল পাল্টাই, খারাপ লাগলে হাসাহাসি করি, সমালোচনা করি, – এই পর্যন্ত। মনে হয়, ছোটোমতো নিশ্চিন্ত ঘেরাটোপে আছি। আমার পিঠ দেওয়ালে ঠেকে নেই। আমার সবচেয়ে কাছের মানুষদের জন্যে, আমার নির্বাক ক্ষুদে পোষ্যটির ভালোমন্দের ব্যাপারে সর্বদা আমার মনের কোথাও একটু উদ্বেগ থাকেই। এরা মোটামুটি কুশলে আছে জানলে বেশ ফুরফুরে আনন্দে থাকি।

‘আমরা প্রত্যেকেই’ বলতে পারিনা, কিন্তু আমাদের অধিকাংশ তাই। সংসার ও বহির্ভূত কর্মক্ষেত্রের দিনগত রুটিন ঝঞ্ঝাট, যাতায়াতের ধকল, এসবের পরে যতটুকু সময় বাঁচানো যায় সন্তানের বেড়ে ওঠায় সহযোগিতা বা পারিবারিক পরিমণ্ডলে অথবা সম্পূর্ণ নিজের মতো আরামে আপোষে কাটানো - এই কাম্য থাকে। এসকল একেবারে স্বাভাবিক চাওয়া এবং ততোধিক সত্য।

আমি মধ্যমেধার অতি সাধারণ নাগরিক। সঠিক ভাষায় বলি, যেমন বলা হত ‘নিম্ন মধ্যবিত্ত’, সেই অনুকরণে ‘নিম্ন মধ্যমেধা’। একদা দেশীয় রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে আমার বাবা এবং শ্বশুরমশাই যুক্ত থাকলেও আমি সেদিকে ঘেঁষিনি কখনো। অতএব রাজনীতির মারপ্যাঁচ বুঝিনা; অতএব চলতি অর্থনীতিতে আগ্রহ নেই, ধর্মাধর্ম এসব নিয়ে মাথা ঘামানো নেই। সময়ে অসময়ে বিদগ্ধ বক্তব্য শুনি/পড়ি – এই পর্যন্ত।
‘আমি’ এখানে একটা উদাহরণমাত্র, আর কিচ্ছু না।

আমরা মিডিয়া দেখি, পড়ি বা শুনি। প্রায় প্রত্যেকদিন অযাচিত, অভাবিত ভয়ঙ্কর কিছু না কিছু ঘটে, ঘটতে থাকে পৃথিবীতে, প্যান এশিয়া, প্যান ইণ্ডিয়া, ‘প্যান’ পশ্চিমবঙ্গে! প্রথম দুটিক্ষেত্র নিয়ে হয়ত তেমন বিক্রিয়া হল না, প্রতিক্রিয়া জাগল না, কিন্তু অন্য দুটি! যেখানে আমার অস্তিত্বের সওয়াল!

ঘটে যাওয়ার মুহূর্তে তুমুল দাবানল বা ভূমিকম্পের আওয়াজ শোনা যায়না বটে, কিন্তু শোনামাত্র আগুণের ফুলকি ও তার আঁচ অথবা মাটিকাঁপার আভাস সেন্সিটিভিটি এফোঁড়-ওফোঁড় করে। কিন্তু কতদিন? একসপ্তাহ, দুমাস, বড়ো জোর ছমাস! ধামাচাপা দেওয়া ঘটনা ভুলতে বসি। সাময়িক আবেগ থিতিয়ে যায়, জোড়াতালির ব্যক্তিজীবনের প্রাত্যহিক থোড়-বড়ি-খাড়ার পাঁচমিশেলীতে মুখ লুকোয়। পালটা আগুণ জ্বালার উৎসাহ ঝিমিয়ে পড়ে টের পাইনা। মুষড়ে ছাই হয়ে যায়।
(প্রত্যেকের কথা বলছিনা)।

এদেশে এদেশে/এরাজ্যে রাজা আসে যায়, দিন বদলের স্বপ্ন দেখায়, দিন বদলায় না। আমরা অতি সাধারন, সাধারণতর বা সাধারণতমরা ক্রমশঃ অভ্যস্ত হতে থাকি। ভাবি কী আর করার আছে, এভাবেই চলতে হবে!
বড়োজোর বড়ো গলা করে বলতে পারি, স্বাধীন দেশ আমাদের অধিকার দিয়েছে – ভোটের অধিকার, দাবীর অধিকার, প্রতিবাদের অধিকার। ভোটাধিকার হাতে নিয়ে ভাবি, কাকে? অল আর ‘সোল্ড আউট’!!! ব্যক্তিপূজক, দলপূজকরা অন্যদলের ভূরিভূরি খুঁত দেখায়। সেই চিরন্তন চালুনি আর ছুঁচের চলতি প্রবাদবাক্য! যারা দলপূজা করিনা, ব্যক্তিপূজক নই তারা পা থেকে মাথা অবধি কন্‌ফ্যুজড! বলতে ইচ্ছে করে, ছাপান্ন ইঞ্চি ছাতির বিশাল নেতাই আসুন, মাফলার, হাওয়াই চপ্পল, ফেজটুপি বা আর যিনিই আসুন – পুজো না নিয়ে, লম্বা-চওড়া শ্লোগান না উড়িয়ে, সমতলে দাঁড়িয়ে দেখার ক্ষমতা রাখুন।

এটা নির্দ্বিধায় ইউটোপিয়ান চিন্তা! নামেই যুক্তরাষ্ট্র – পরস্পরবিরোধী অন্তহীন সমস্যা মাকড়সার জাল হয়ে জনতা জনার্দনের নাকে-মুখে জট পাকিয়ে আছে। ‘নিঃস্বার্থ’ নেতা-নেত্রী বুক বাজিয়ে, গলা ফাটিয়ে, টেবিল চাপড়ে দলের বৃহত্ব প্রচার করেন। পেছনের অঢেল পয়সাঢালা কিং-মেকাররা নীরব থাকেন। আমরা বোকারা নোংরা পানাপুকুরের মাছ হয়ে একজন অন্যজনকে ঠুকরে খোবলাতে থাকি। সমাধান আসেনা, অন্তত স্বাধীনতার সত্তর বছর পর পর্যন্ত আসেনি। অপেক্ষা করে করে একদিন মরে যাব। মরে গেছেন আমাদের বাপ-ঠাকুর্দা আর স্বপ্ন পুড়ে ছাই হয়েছে তাঁদের সঙ্গে।

কত সময়ে ভাবি, আসলে রাজা হওয়ার, নেতা হওয়ার অনেক জ্বালা! সিন্দবাদের মতো প্রকাণ্ড গন্ধমাদন ঘাড়ে করে কী প্রচণ্ড স্যাক্রিফাইসিং লাইফ – অহর্নিশ মানুষের জন্যে ভেবে ভেবে আধমরা হওয়া। আশ্চর্য দেখি, এঁরা তেলে-জলে-শাঁসে খোলতাই হন! ক্ষমতা ধরে রাখার জন্যে কাতর হয়ে পড়েন। কী অদ্ভুত!

বেজায় ভয় পাই, ক্রমশঃ ভয় পেতে পেতে পেছনে সরতে থাকি। বাইরে অরাজকতার আশঙ্কায় নড়বড়ে ঘরোয়া তাঁবুতে নিজেকে আগলাই। বাহ্যত কোনো বহিঃশত্রু নেই, ঔপনিবেশিক শক্তি সত্তর বছর হল দেশকে শাসন করে না। তবু নিজের দেশে স্বস্তিতে থাকতে পারি কই? ব্রিটিশ শাসনের সময়ে সরকারবিরোধী আন্দোলন হলেই টুঁটি টিপে মারত সরকার। তখনকার মানুষ কি সকলে বেশি সাহসী ছিল? কে জানে?
মিডিয়ার মতো নারদের ভূমিকা আর কেউ নিতে পারেনা। ইদানিং লাগামছাড়া লাগানি-ভাঙানিতে মন দিয়েছে। দিনেদুপুরে সুর পালটায়। জানতে চাই যদি, মিডিয়া তুমি কার? সত্যি বললে বলত, যে পয়সা ঠেকায় তার। ক’দশক আগে সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন এবং কন্টেম্পোরারি আরো বঙ্গ-অবঙ্গ পরিচালক ছিলেন, যারা আড়ে-ঠারে, সোজাসুজি প্রতিবাদ করতেন সেলুলয়েডে। সে সময়ে মানুষ হয়ত ভাবত, বড়োসড়ো বদলের আশা করত। সমাজের বাস্তব চেহারা উঠে আসত পাতি থিয়েটারে চলা বিনোদনভিত্তিক ‘পাতি বই’গুলোতেও।

কোন্‌ ম্যাজিকে এত শক্তিশালী মিডিয়াম চুপ, ওসবের কাছে-ধারে ঘেঁষেনা। দুচারখানা যদি বা ওরকম হয়, চলেনা। এখন এক্সপেরিমেন্টাল মুভি রান্না হয় নানান্‌ উপকরণে। তার সঙ্গে চলমান জীবনের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক কতটা, আমার মোটা মাথায় ঢোকেনা।
টেলিভিশন সোপ অপেরা রঙচঙে কিম্ভুত অলীক দুনিয়ার প্রতিনিধি – এবিষয়ে আলোচনা মানে মেজাজ খারাপ হওয়া। অথচ জন্মলগ্নের পরে টেলিভিশন কিন্তু মানুষের কাছাকাছি ছিল।

অতএব চলতে থাকুক আমাদের দিন। ঘটনা ঘটতে থাকুক একের পর এক। আরুষি তলোয়ার, রক্তাক্ত নির্ভয়া, রোহিত ভামুলা, আরও কত অসংখ্য পাতার পর পাতা অজস্র জমে থাকা সমাধানহীনতা। প্রতিবাদী বিদ্বদ্‌জনেরা খুন কিম্বা এ্যারেস্ট হয়ে যান। আমরা ভয় পাই। ধর্মাচরণ নামের অত্যধিক স্পর্শকাতর প্রাণীটির সঙ্গে রাজনীতি নামের ফেউ জুড়ে গিয়ে কিম্ভূত টিয়ামুখো গিরগিটি হয়ে আতঙ্ক ছড়াক। পিঠ আড়াল করতে করতে চলি। গাঁইগুঁই করেও আচমকা ধেয়ে আসা আর্থনীতিক পরিবর্তন সইয়ে নিই। টাকার দাম পড়ে যায়, তেলের দাম আকাশ ছোঁয়।
 
মাথায় ব্রিজ ভেঙে পড়ে মানুষ মরে, দোকান পুড়ে যায়, কতজন অবিচারের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করে, গুলি লেগে ছাত্র মরে, ছাত্রী ধর্ষিত হয়। বিচার চেয়ে প্রতিবাদ, আলোচনা – বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ ছাড়া বিশেষ কিছু দেখা যায়না। ফ্ল্যাটে ফ্ল্যাটে ছয়লাপ শহর নিস্পন্দ হার্টলেস হয়ে যাক, কাটা হোক নিরীহ মুখবোজা গাছেদের। অন্যরাজ্যের মানুষ, অন্যরাজ্যের ভাষার আধিপত্য চুপ করে মেনে নিতে থাকি। ছোট্ট বলয়ে কুচি-কুচি ঢেউ ওঠে। অসম্ভব দমবন্ধ লাগে। দমকা বাতাস সব উড়িয়ে সাফ করে সম্পূর্ণ অন্য কিছু আনবে – নাঃ আশা করি না।

তখন ফেসবুক নামের ‘মহাশয়’ অত্যাধুনিক ফোরামে বুঝে, না বুঝে, জেনে বা আধা জেনে প্রাণ ভরে প্রতিক্রিয়া দেখাই। গায়ের ঝাল ঝাড়ি। দেশোদ্ধার করি। অদৃশ্য মানুষের সঙ্গে ফালতু তর্ক করি, গালাগাল দিই পেট খুলে। ভার্চুয়ালি ছুরি-চাকু ওঠাই। আবার দুক্ষু করি, মিনমিনে দুয়েক ছত্র লিখে প্রতিবাদ জানাই। জ্বালাময়ী পোস্টানোর আগে আড়চোখে  চেক্‌ করি, বিপদে পড়ব নাতো? এগুলো কার কাছে পৌঁছবে, তা তো জানিনা। 
আমি এরকম। এভাবেই পিঠ বাঁচাই, পরিবার ঘিরে রাখি, নিজস্ব দরজা(লজ্‌ঝরে) বন্ধ করে রাখি। পালিয়ে থাকি... আর কিছু করিনা।
(এই লেখাটাও সত্যি বলতে কী – গায়ের ঝাল ঝাড়া, ব্যাস্‌!!!!!)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours