দেবর্ষি মজুমদার, লেখক, বীরভূম:

মাঘ মেলায় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আসেন নি তা নয়। তবে রাজ্যপাল কোন দিন আসেন নি।  ২০১৭ সালে ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার এই মাঘ মেলায় এসে আক্ষেপ করে প্রথম কথা  বলেছিলেন,  ‘আমার অনেক আগে এখানে আসা উচিত ছিল। তাঁর দ্বিতীয় আক্ষেপ ছিল,  রবীন্দ্রনাথের কৃষিমেলার উদ্দেশ্যে দেশের একাংশ বুঝতে পারছে না। আবার কেউ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বুঝতে চাইছেন না। তাই তাঁর এই কৃষিভাবনা গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে না” আত্মসমালোচনা করে বলেছিলেন, এরকম কৃষিভিত্তিক মেলা আমাদের রাজ্যেও হয়। তবে কবিগুরুর শ্রীনিকেতনে মাঘ মেলার বৈশিষ্টই আলাদা। বিশ্বের মধ্যে অন্যতম অভিনব’। সেটাও ছিল আক্ষেপ। কিন্তু কোথাও রাজনীতির কথা বলেন নি। স্থানমাহাত্ম বজায় রাখতে রাজনীতি দূরে রেখেছিলেন। সেই প্রথা ভাঙল এবার। মাঘ মেলার শত বর্ষের দুবছর আগে। এবার কি হল?

বিশ্বভারতীর রেক্টর হিসেবে জগদীপ ধনকঢ শ্রীনিকেতনের ফেস্কো মঞ্চে প্রদীপ প্রজ্বলনের মাধ্যমে মাঘ মেলার উদ্বোধন করলেন। তারপর প্রদশর্নী ঘুরে ঘুরে দেখলেন। কিন্তু ভাষণ দিতে গিয়ে তিনি বিতর্ক বাধালেন।

রাজ্যপালের প্রথম বিতর্কঃ

নাম না করে মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে রাজ্যপাল তথা বিশ্বভারতীর মঞ্চ ব্যবহার করে রেক্টর বললেন, উন্নয়ন নিয়ে রাজনীতি করা উচিৎ নয়। ২ জানুয়ারী ১২ হাজার ক্রোর  অর্থ ৬ হাজার কৃষক পরিবারকে দেওয়া হয়েছে। আমার মন কিছুটা দুঃখী।  বাংলায় ৭০ লক্ষ কৃষক আছে। তাদের অধিকার আছে। তাদের এই অর্থ পাওয়া উচিৎ ছিল। এই অর্থ সোজা ব্যাঙ্কে যায়। এখানে কারো কোন বিজ্ঞাপন হয় না।  সরাসরি কৃষকের ব্যাঙ্ক একাউন্টে ট্রান্সফার।  চার হাজার ক্রোর থেকে বেশি টাকা এখানকার কৃষকরা পেতেন।  গোটা দেশের চাষীরা এই হক পাচ্ছেন, কিন্তু পশ্চিমবাংলার কৃষকরা এই হক না পাওয়ায় আমার মনকষ্ট। আজকের দিন। যে কৃষকের চিন্তা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর করেছেন, ১৯২২ সালে মেলার শুরু করেন। তাই এখানে এই প্রসঙ্গে বলা আমি উচিৎ মনে করি।  সেই ভাবনা থেকেই বলছি।  পরিষ্কার মনে বলছি, আত্মচিন্তন করা দরকার। চার হাজার ক্রোরের বেশি এই অর্থ কৃষক না পেলে, অর্থ ব্যবস্থার উপর তার চাপ পড়ে। কোন কারণ নেই। একশ শতাংশ কৃষকের অধিকার। দেশের কৃষকরা এই অধিকার পাচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের কৃষকদের এক পয়সা মেলে নি। কে আসছে এদের মাঝে? অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরেও একই বার্তা দিয়ে বলেন,  আমি হাত জোড় করে প্রার্থনা করছি, যে তথ্য কেন্দ্র সরকারকে দেওয়া জরুরি সেটা দিয়ে দিন। যাতে করে কৃষকদের হকের টাকা তাঁদের একাউন্টে জমা পড়ে।
রাজ্যপালের দ্বিতীয় বিতর্কঃ

কেন্দ্রীয় প্রকল্পের প্রচারের জায়গা হিসেবে বেছে নিলেন বিশ্বভারতীকেই। বললেন, কৃষক পরিবারের ছেলে হিসেবে জানি, ভারতের প্রধান মন্ত্রী কৃষকদের জন্য প্রচুর কাজ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী কিষাণ সম্মান নিধি এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। প্রতি বছর ৬ হাজার টাকা  মিলবে। ৪৩ হাজার ক্রোর দেওয়া হয়েছে। ৮ হাজার কিষাণ পরিবারকে এই টাকা দেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্রপতি সংসদের যৌথ অধিবেশনে সে কথা  বলেছেন।

রাজ্যপালের তৃতীয় বিতর্কঃ

৭ই ফেব্রুয়ারী বিধানসভার অধিবেশনে তিনি যে অভিভাষণ পাঠ করবেন তাতে তোতাপাখি হবেন না, তা তা ঠারে বোঝাতে সেই বিশ্বভারতীকেই ব্যবহার করলেন। তবে কি করবেন, সেই অস্ত্র তাঁর আস্তিনেই লুকিয়ে রাখলেন। কি বললেন তিনি? --  সরকারের অধিকার আছে, রাজ্যপালের ভাষনের মধ্যে নিজস্ব নীতি ব্যক্ত করতে পারে।  ক্যাবিনেট সেই বক্তব্য পাশ করে থাকে।  আমিও আমার প্রস্তাব দিতে পারি। আমি সেই অভিভাষণ পাঠ করব। কিন্তু আমি আমার প্রস্তাব দেব। সেটা আমি মিডিয়াকে বলবো না। আমি রাজ্যের প্রতিটি নাগরিককে নিশ্চিতরূপে বলবো, আমি আমার পদের মর্যাদা রক্ষা করবো সংবিধানকে মেনেই। তাই তাঁদের প্রস্তুত অভিভাষন আমি পাঠ করব, কিন্তু তাতে আমার টিপ্পনি থাকবে।

সব শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেক্টর হিসেবে তিনি ছাত্রছাত্রীদের উপদেশ দিলেন, যেটা তাঁর স্বাধিকারের মধ্যেই পড়ে।  বিশ্ববিদ্যালয়ে  স্বপন দাশগুপ্তের “সি এ এ” কেন্দ্রীয় আইন সমর্থনে বক্তৃতার দিন ছাত্র রাজনীতিতে বিশ্বভারতী উত্তাল হয়। ছাত্রদের অভিযোগ ছিল, উভয় মতের বক্তা রাখা হয় নি। তারা বিক্ষোভ দেখায়। সেই প্রসঙ্গে এদিন রেক্টর বলেন,   আমি সবাইকে হাতজোড় করে বলবো , সব লোক এক মতের নাও হতে পারে।  সবার মত আলাদা আলাদা হতে পারে।  আপনার মত আমার থেকে আলাদা হওয়ার অর্থ এই নয় যে, আমি আপনার শত্রু। আমার মনে সহনশীলতা থাকা উচিৎ।  আমি অপরের মতকে স্বীকার করি। অন্যের মতকে বোঝার চেষ্টা করা উচিৎ। এটাই ভারতীয় সংস্কৃতি। দেখা যায়, অন্যের মত অধিকাংশ ক্ষেত্রে সহমত হয়। সুতরাং ঐক্যমতে আসা হোক। বিশ্বভারতীর থেকে বড় স্থান আর কিছু হয় না। এখানে আসহমত হলেও মর্যাদার সাথে সেটা প্রকাশ করার শিক্ষা নেওয়া উচিৎ।  কোন অসহিষ্ণুতা না থাকে, এই জায়গা মহান জায়গা। কেউ তার ধারণা ব্যক্ত করে, তার উপর কেউ বিরোধ করে, এটা মানা যায় না।  ভারতের সংবিধান আনেক মৌলিক অধিকার দেয়। তার মধ্যে এক হল মত প্রকাশের অধিকার।  তার অর্থ আমার নিজস্ব দৃষ্টি ভঙ্গি আছে। তার সাথে কেউ সহমত নাও হতে পারে।  পরস্পরের কথা শুনবো। কেউ আমার মতের বিরুদ্ধে ব্যক্ত করে, আর আমি তাকে বলে দেব তুমি ভুল,  এটা ঠিক নয়।

নিজের ভাষণের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেক্টর বলেন, ষষ্ট শ্রেণীতে চার কিমি পায়ে হেঁটে স্কুলে যেতাম। স্কলার শিপ পাওয়ার পর অন্য স্কুলে যায়।  বিদ্যুৎ, সড়ক কিছু ছিল না। বিশ্বভারতীর উপাচার্যকে আমি অনুরোধ করেছি,  ২০২২ সালে এই এই মাঘ মেলার শত বর্ষপূর্ণ হবে। ২০২১  সালের ফেব্রুয়ারী থেকে পুরো বছর ধরে ভালো কাজ হবে। বৈজ্ঞানিকরা বলবেন, কিভাবে কৃষকের হিত হবে। গবেষনা হবে। তাঁরা বলবেন, কিভাবে কিষাণ কিভাবে সৃজনশীলতার মধ্যে এগিয়ে যাবেন।  যাতে করে ২০২২ সালে ক্লাইম্যাক্স হয়ে যাবে।  তারপর কিষাণের বিষয়ে তিনি বলেন,   রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের  কৃষি ভাবনা  সঠিক দিশায় এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য বিশ্বভারতীর উপাচার্য সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য, বলে রেক্টর উল্লেখ করেন। সাম্প্রতিককালে বিশ্বভারতীতে অশান্তি প্রসঙ্গে উপাচার্যের প্রশংসা করে তিনি বলেন, অবসরপ্রাপ্ত মুখ্য বিচারপতিকে তাঁর তদন্তের ভার দেওয়া দায়িত্বশীলতার পরিচায়ক।  আমি চাই বিশ্বভারতী তাঁর পুরানো গরিমায় ফিরে আসুক।  দুনিয়াতে তার নাম হোক। সাথে সাথে ভারত ও পশ্চিমবাংলার নাম হোক।  জমিদারি ছিল, তবুও কৃষকদের জন্য তাঁর হৃদয় ছটপট করতো। নোবেল প্রাইজের  অংশ কৃষকদের জন্য দিয়ে মাঘমেলা শুরু করেন। ২০২২ সালে একশ বছরে পূর্ণ হবে।   কাল আমি বিধানসভা সম্বোধিত করব। আমি প্রথম রাজ্যপাল যে স্বাধীনতার পর জন্মেছি এবং বিধানসভায় তার দায়িত্ব পালন করতে ভাষন দেব। আগে বহু স্বনামধন্য পূর্বসূরীরা এই ভাষণ দিয়েছেন।  কিন্তু তাঁরা স্বাধীনতার আগে জন্মেছিলেন।  সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে রাজ্যপাল বলেন, হেলিকপ্টার মিলুক না মিলুক, সেটা কোন বিষয় না। মালদা- মুর্শিদাবাদ ৩০০-৩৫০ কিমি দূরত্ব ছিল। আমি তাই হেলিকপ্টার চেয়েছিলাম। সরকারের কোন কারণ ছিল। তাই সড়কপথে যেতে হয়েছিল। এখানেও না মিললে, ৮ টার সময়ের পরিবর্তে ৪টায় রওনা হতাম। আমি ভোগী নয়। আমি মানুষের সেবার জন্য চেয়েছিলাম। আর তার জন্যই চাওয়া হয়ে থাকে।  হেলিকপ্টার কোন মোদ্দা নয়। এটা সরকারের বিবেকের। বিশ্বভারতীতে  সি আই এস এফ প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেক্টর বলেন,  সি আই এস এফ  প্রয়োজন দেশের গুরুত্বপুর্ণ প্রতিষ্ঠানের খাজানার সুরক্ষার জন্য।  আজও লোকের প্রশ্ন, আপনি কি বিশ্বভারতী গেছেন? এতেই বুঝতে পারছেন। বিশ্বভারতীর রেক্টর হিসেবে, সামান্য কিছু হলেই, আমার চিন্তা হয়।  ছাত্রছাত্রী তোমাদের ভাগ্য, বিশ্বভারতীতে তোমরা সময় কাটিয়েছো। আর কোন পরিচয় দরকার নেই।  আমাদের এমন কোন আচরণ করা উচিত নয়, যাতে করে খবরের কাগজে সেন্সসেসান্যাল নিউজ হয়। আমাদের প্রস্তাবনা পড়া উচিত।  একমত হয়ে কাজ করুন।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours