আহসান হাবিব, লেখক. বাংলাদেশ:

যৌনতা বুঝে ওঠা সহজ নয়। কেননা যৌনতাকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে মানব সম্পর্কের বহু স্তর জটিলতা এবং রাজনীতি। অথচ আমি প্রায়ই শুনি যৌন ক্রীড়া জীবনের আর পাঁচটা প্রয়োজনীয় কাজের মতই একটা কাজ । তাদের প্রায় সকলের ভাষ্য যৌনতাও একটা প্রাকৃতিক জৈবিক ক্ষুধা যেমন খাবারের জন্য আমাদের ক্ষুধা । এমনকি একে আর পাঁচটা প্রাত্যহিক কাজের সংগে তুলনা করে বলে- এটা যেমন ওটাও তেমন । অর্থাৎ যৌনতা আর পাঁচটা প্রাকৃতিক ক্রিয়ার মতই একটা স্বাভাবিক ক্রিয়া ।

কিন্তু কথাটা কি ঠিক ? আমার মনে হয় না । যৌনতা আর পাঁচটা কাজের মত নয়, এটা মানব জীবনের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক প্রাকৃতিক কাজ । আমার মনে হয় যৌনতাই বদলে দিয়েছে মানব জীবনের গতিপথ, যৌনতাই গড়ে তুলেছে আজকের সভ্যতা । সম্পত্তির উপর ব্যক্তিগত অধিকার প্রয়োগ এবং আধিপত্য নির্মাণে যৌনতা প্রধান ভুমিকা নিয়েছে । যৌনতাকে ক্ষমতার সংগে অঙ্গীভূত করে এর উপর গড়ে তুলেছে নানা আইন কানুন, বিধি নিষেধ । শরীরের আর পাঁচটা কাজের সংগে একে পৃথক করেছে এর পেছনে যে রাজনীতি ক্রিয়াশীল, তার অভিঘাত । যৌনতা যেমন প্রকৃতিকে টিকিয়ে রাখার একমাত্র মাধ্যম, সভ্যতা গড়ে তোলারও এটি একটা প্রধান উপায় ।

শরীরের উপর এই যে নিয়ন্ত্রণ, এটাই যৌনতাকে আর পাঁচটা কাজ থেকে পৃথক করে ফেলেছে । বিশেষত নারীর শরীরকে যেভাবে ব্যবহার করা হয়েছে, তার ফলেই তার শরীর আর প্রাকৃতিক শরীর থাকেনি, হয়ে উঠেছে সামাজিক-রাজনৈতিক শরীর । নারীর শরীরকেই কেন টার্গেট করা হয়েছে ? আর কোন কারণ নেই, সেটা হল এর পুনর্জন্ম দেয়ার প্রাকৃতিক ক্ষমতা । এই ক্ষমতাকেই কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে সম্পদের উপর ব্যক্তিগত অধিকারের মত একটা স্বার্থপর ব্যবস্থা । এইজন্য পুরুষ শরীর নয়, নারীর শরীরই হয়ে উঠেছে প্রধান বাহক যার মধ্য দিয়ে সম্পত্তির উত্তরাধিকার বহন এবং ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখা হয় । এই লক্ষ্যে নির্মাণ করা হয়েছে রাষ্ট্র, এর যাবতীয় আইন এবং নানা বাধ্যবাধকতা । নারীর শরীর আর সেই আদিম সমাজের মত এজমালি থাকেনি, হয়ে উঠেছে ব্যক্তিগত । এই ব্যক্তিগতর ধারণার প্রকাশ ‘পবিত্র’ প্রপঞ্চটিকে সামনে নিয়ে এসেছে । অর্থাৎ নারীর শরীরকে হতে হবে পবিত্র । এটি শুধু পুরুষতন্ত্রের বানানো কোন নিয়ম নয়, এটি সামাজিক বিবর্তনে ক্ষমতার যে নানা স্তর তৈরি হয়েছে তার ইচ্ছানিরপেক্ষ ফল । কোন মানুষ ইচ্ছা করলেই এটা বদলাতে পারে না ।
এই নারীর শরীরকে পবিত্র রাখতে গিয়েই যৌনতা প্রাকৃতিক আর সব জৈবিক কাজ থেকে আলাদা হয়ে গেছে । সংস্কৃতি একে দিয়েছে এক ধরণের শিল্পরূপ । এই শিল্পের প্রধান সৌন্দর্য যা মানুষ গড়ে তুলেছে তা হল আড়াল । যৌনতাকে সে গভীর আড়ালের ক্রিয়া হিসেবে আলাদা করে ফেলেছে । তাই যখন যৌনতার কোন প্রকাশ প্রকাশ্যে করতে দেখা যায়, একদিকে লজ্জা এবং নিন্দা দুটোই মানুষ অনুভব করে । মানুষ তার প্রয়োজনীয় কাজগুলির দৃশ্যমানতাকে নানা ভাবে বিভক্ত করেছে । আমরা যে খাদ্য গ্রহণ করি, তার জন্য ব্যবহার করি যে ঠোঁট, তা কেউ দেখলে আমাদের ভেতর কোন আলাদা অনুভুতি কাজ করে না, স্বাভাবিক মনে হয়, কিন্তু ওই ঠোঁট যখন কাউকে চুমু দেয় প্রকাশ্যে, আমাদের ভেতর প্রতিক্রিয়া হয় । আমাদের আড়ালের সৌন্দর্য বিঘ্নিত হয় । এই সৌন্দর্য নির্মাণের পেছনেও রয়ে গেছে ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দ প্রতিষ্ঠা করার ক্ষমতাভিত্তিক প্রকাশ ।

সভ্যতা যেহেতু বৈষম্যনিরপেক্ষ নয়, ক্ষমতার রকমফেরে এর নির্মিতি এবং এর পেছনে যৌনতার রয়েছে প্রধান ভূমিকা, তাই এর নির্ণায়ক যে নারী শরীর, তার প্রতি রয়েছে বিশেষ দৃষ্টি । এই বিশেষ দৃষ্টি নারীকে অধস্তন করে তুলেছে । এই অধস্তনতাই নারীকে তার শরীর নিয়ে বিব্রত থাকতে হয় এবং তথাকথিত পবিত্র রাখার চেষ্টা জারী রাখতে হয় । একজন নারী শারীরিক শ্লীলতা হারালে যা পুরুষতন্ত্রের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত, নারী তার সামাজিক সম্ভ্রম হারিয়ে ফেলার ভয়ে থাকে ফলে তার শরীরকে কিভাবে বাঁচিয়ে রাখা যায় সে চেষ্টা করতে থাকে । কিন্তু এই কাজের কুশীলব কালপ্রিট পুরুষের শরীর নিয়ে কোন ভাবনা নাই, যেন তার শরীর সতত পবিত্র । কিন্তু তার মানে এই নয় যে এই ব্যবস্থা ভেঙে পড়লে এবং একটি বৈষম্যহীন সভ্যতা গড়ে উঠলে যৌনতার সৌন্দর্য যে এর গোপনীয়তা ভেঙে পড়বে, তা নয়, এই ক্রিয়ার সব আনন্দ সে উপভোগ করবে আড়ালেই ।

তাই বলছি যৌনতা শরীরের আর পাঁচটা কাজের মত স্বাভাবিক কাজ নয়, একটি বিশেষ  অস্বাভাবিক রাজনৈতিক কাজ । একে সঠিক ভাবে বুঝতে গেলে মানব প্রজাতির জার্নির সমগ্র ইতিহাস পড়তে হয়।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours