শিবাশীষ বসু, ফিচার রাইটার, উত্তরপ্রদেশ:

রবীন্দ্রনাথের কাছে বই লেখবার আদেশ পাওয়ার পর কি হল, তা বরং প্রমথনাথের নিজের বয়ান থেকেই শোনা যাক। "সেদিন থেকেই বিজ্ঞানের সহজ বই পড়তে লেগে গেলাম, তারপর ধীরে ধীরে শুরু হল বই লেখার কাজ। সে এক বিপর্যয় কান্ড ! কোনোদিন বৈজ্ঞানিক তথ্য দিয়ে সুসংবদ্ধ বাংলা রচনায় হাত দিইনি, দু-একটা ছোটখাট রচনা যা লিখেছি, তা হল ইংরেজিতে। তাই এই অনভ্যস্ত পথে প্রতিপদে শুধু হোঁচটই খেতে হল। এগোনো আর হচ্ছিল না, নিজের লেখা নিজেরই এত খারাপ লাগতে আরম্ভ হলো যে দু-এক পাতা লিখেই তা ছিঁড়ে ফেলতাম। ফলে ছিন্ন কাগজের পাতায় ঝুড়ি ভর্তি হয়ে উঠল। খাতাখানাও তার সম্বল হারিয়ে ক্রমশ শীর্ণকায় হয়ে উঠল। অবশ্য এতে একজন খুব খুশি হলেন, উনুন ধরাবার কাজে অনায়াসলব্ধ এই ছিন্নপত্রগুলো আমার স্ত্রী যথাযথ সদ্গতি করে চললেন।" এই উদ্ধৃতিটুকু থেকে বোঝা যায় প্রমথনাথ নিজের বাংলা রচনা নিয়ে বিশেষ আত্মবিশ্বাসী ছিলেন না, কিন্তু এটুকু অন্ততঃ ঠিক যে বইটার লেখকসংক্রান্ত বিষয়ে তখনও পর্যন্ত কারুর মনে কোনও প্রশ্ন জাগেনি।

এই সময় একদিন এলেন পাঠভবনের অধ্যাপক তনয়েন্দ্রনাথ ঘোষ এবং প্রিন্সিপাল ডঃ ধীরেন্দ্রমোহন সেন। প্রমথনাথের স্ট্রাগল দেখে তনয়বাবু বললেন, "এভাবে তো কোনো সমাধান হবে না, আপনি যা পারেন লিখুন, তবে তথ্যের দিক থেকে যেন হালকা না হয় সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখবেন। আমাদের বিচারে যে ভাষা সাধারণত ভালো বলে আখ্যা পায়, গুরুদেবের হাতে পড়লে তার খোল-নলচে বদলে গিয়ে এক নতুন ভাষা প্রকাশ পায়। কাজেই বৈজ্ঞানিক তথ্য পর পর সাজিয়ে দিন, ভাষার ভার গুরুদেব নেবেন। গুরুদেবের সেই ভাষা দেখে পরবর্তী পর্যায় লিখতে শুরু করবেন।" ডঃ সেন বললেন, "আপনার ভাষায় লিখে যান তথ্যের পারম্পর্য রক্ষা করে, তারপর দেখবেন ভাষা প্রয়োগের অসাধারণ নৈপুণ্যে ও সহজ দৃষ্টান্তের ভিতর দিয়ে কি সুন্দরভাবে গুরুদেব এসব তথ্য শিক্ষার্থীর আয়ত্তগম্য সীমায় পৌঁছে দেন। তাঁর হাতে সেই হবে আপনার সবচেয়ে বড় ট্রেনিং।"
এখানে একটা বিষয় দেখবার আছে, বই লেখবার এই পদ্ধতি ঠিক হবার পরেও হতভাগ্য প্রমথনাথবাবু কিন্তু ভাবছেন বইটা তাঁরই রচনা হবে। তিনি লিখেছেন, "ওদের উপদেশ মেনে নিয়ে তথ্য সংগ্রহের কাজ শুরু হল, বইটার নামকরণ করলাম, 'বিশ্বরচনা'। ধীরে ধীরে কাজ এগোতে লাগল। ‘পরমাণুলোক’ দিয়ে শুরু হলো বইয়ের প্রথম অধ্যায়, এটা শেষ করে গুরুদেবের কাছে নিয়ে যেতে হবে।" দীপঙ্কর বাবুর ভাষায়, "বইটার নামকরণ করলাম 'বিশ্বরচনা', এ-কথার মধ্যে তারই আভাস পাওয়া যায়।"

যাইহোক, প্রথম অধ্যায় লেখা শেষ করে প্রমথনাথ রবীন্দ্রনাথের কাছে নিয়ে গেলেন। রবীন্দ্রনাথ সাগ্রহে লেখাটি পড়তে আরম্ভ করলেন ও তার উপর কলম চালিয়ে চললেন। কিছুক্ষণ পরে বললেন, “রচনাটি আমার কাছে রেখে যাও, কাল ফেরত পাবে। বিজ্ঞানের সঙ্গে প্রথম পরিচয় ঘটাতে হলে ভাষাটা কীরকম হবে, তাই শুধু দেখিয়ে দেব। একটা কথা মনে রাখতে হবে, এসব গ্রন্থের শুরুথা ও শেষটা যেন বেশ চিত্তাকর্ষক হয়, এতে যদি একটু সাহিত্যরস বিতরণ করতে হয় তাও করতে হবে।" দীপঙ্কর বাবুর লিখেছেন, "শুনলে মনে হবে, প্রমথনাথের লেখার উপর যে কলম চালাতে হচ্ছে, সেজন্য কবি যেন কুন্ঠিত। তাই আশ্বাস দিচ্ছেন, ভাষাটা বদলে দেওয়া ছাড়া আর কিছু তিনি করবেন না।"

প্রমথনাথকে আরেকটি চমকপ্রদ কথা বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, "বৈজ্ঞানিক রচনা লিখে প্রথমে দেখাতে হবে এমন দু-একজনকে, বিজ্ঞানের সঙ্গে যাঁদের পরিচয় নেই। তাঁরা পড়ে যদি বুঝতে পারেন, তাহলে নিঃসন্দেহে ধরে নেবে লেখার উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। ..... এ বিষয়ে আমাদের 'গোঁসাই' (নিত্যানন্দবিনোদ গোস্বামী) নিতান্ত নিরীহ ভালোমানুষ, লেখাটা প্রথমে গোঁসাইকে দেখিয়ো, বোধগম্য হয়েছে, বলে উনি সার্টিফিকেট দিলে পরে আমাকে দিও, যতটুকু ঘষামাজা দরকার করে দেব।"

স্পষ্টতই, ঘটনাপ্রবাহের এই পর্যন্ত গুরুদেব স্রেফ প্রমথনাথের রচিত বইটির "ঘষামাজা"র দায়িত্বই নিয়েছিলেন - এটুকু বেশ বোঝা যাচ্ছে।

তার পরের দিন গুরুদেবের কাছে প্রমথনাথ যেতেই তিনি বললেন, "তোমার রচনা পড়েছি, শুরু যেভাবে করেছ তার পাশে লিখে দিয়েছি কিভাবে শুরু করতে হবে। মনে হয় বাংলায় বিজ্ঞানের সহজবোধ্য বই 'এই ভাষায়' লেখাই সংগত হবে।" প্রমথনাথকে পান্ডুলিপিটি ফিরিয়ে দিয়ে গুরুদেব আরও বললেন,"পরমাণুলোক অধ্যায়ের বাকি অংশটা এই ভাষায় লিখে আমাকে দিয়ে যাবে, সাতদিনের মধ্যেই, দেরি করলে কিন্তু চলবে না। তথ্য আহরণ ও তা সাজানোর ব্যাপারে তোমার মুনশীয়ানা আছে, এখন ভাষাটা ঠিক হলেই স্বচ্ছন্দে লিখে যেতে পারবে।"

এইখানে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলেছেন দীপঙ্করবাবু, "রবীন্দ্রনাথ কি যথার্থই বিশ্বাস করতেন যে তাঁর ব্যবহৃত ভাষায় প্রমথনাথ বই লিখতে পারবেন? .... একজনের পক্ষে কি অকস্মাৎ আর-একজনের ভাষায় লেখা সম্ভব?"

এ প্রশ্ন আমাদেরও। রবীন্দ্রনাথের এ বক্তব্য কি স্রেফ প্রমথনাথের উৎসাহবর্ধনের জন্য নাকি কিছু অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য আছে?

(চলবে)

তথ্যসূত্র :
বিশ্বপরিচয়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ
রবীন্দ্রনাথ ও বিজ্ঞান, দীপঙ্কর চট্টোপাধ্যায়, আনন্দ পাবলিশার্স
রবি ঠাকুর, রাহাজানি এবং রবীন্দ্র পুজারীবৃন্দ, অভিজিত রায় ফরিদ আহমেদ, মুক্তমনা ডট কম
রবীন্দ্রনাথ : মানুষের ধর্ম মানুষের বিজ্ঞান, আশীষ লাহিড়ী, অবভাস
আনন্দরূপম, সঞ্জীব মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত, সাহিত্য সংসদ

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours