প্রিয়াঙ্কা সরকার, লেখিকা, বর্ধমান:

আমার ধাতৃকা মাতা ক্ষেমাংকরী ; বড়ো প্রতিশোধপরায়ণ সে..  আহা! মুখরা বলতে ইচ্ছা হয় আমার। সেই কবে বার্তালাপ প্রাক্কালে আমার ভয় ছিল!  অযাচিত কথার ভঙ্গিতেই আমি বলি হবো না তো!  ক্ষেমাংকরী আমায় মানুষ করেছেন ; গর্ভধারিনীর যন্ত্রণা না হোক পালনেও যে অপত্য প্রেম, তা তো অস্বীকার করা যায় না। পাত্র রাজপদের অধিকারী নয়, জন্মান্ধ..  তাই থাকবে না ক্ষোভ!! তাকে চুপ করিয়ে রাখি কি করে!!  আমার প্রাথমিকের প্রয়োজনীয় শিক্ষায় যে,  তিনিই আমায় যাপন করতে শিখিয়েছেন৷ না, পারি না আমি বোঝাতে! নিরুক্তিতে ভেবেছিলাম আর হয়তো কথার জোড়াতালি দিতে হবে না কথপোকথন, না অঘটন শিহরে এসে গেলো অবসরে৷ ক্ষেমাংকরী বলে ফেললেন, "আমাদের কন্যাটিকে  তাহলে আপনাদের ক্ষমতার যূপকাষ্ঠে উৎসর্গীত হতেই হলো৷ "

অসহ্য আগ্রহ বললে যে বৈপরীত্য এসে ধরা দেয় কালির আঁচড়ে।  তাই অনিচ্ছাজ্ঞাপন করলে যে, রাজ্য ধুলোয় মিশে যেতো, একথা কি ভীষ্মের কাছে মান্যতা পায় না!  আবার সেই ক্ষত্রিয়ধর্ম প্রকট হয় অধিকারের নামে৷ উঠে এলো ব্যক্তিগত প্রশ্ন। কিন্তু মালিন্য ছুঁয়ে গেলো বাতিল সমাজের পোশাকি নামে৷ ক্ষেমাংকরী দোষারোপ করলেন ভীষ্মকে ; অম্বার জীবনের পরিণতির মূলে ভীষ্মকে দায়ী করলেন৷ অপর দুজন তো বিকৃতকামুক যক্ষারোগগ্রস্থ রাজকুমারকে বিবাহ করতে বাধ্য হলেন,  আহা!  জ্যেষ্ঠভ্রাতা কিভাবে ভাদ্রবধূকে অঙ্গস্পর্শ করে!!  এবার ভীষ্ম পারছেন না৷ এ যে যাজ্ঞবল্ক্য অবস্থা!! উদাসীন মনের কারক হয়ে তো নারীর কাছে হেরে যেতে নেই৷ এবার তাই একাকী পুড়ে নয়,  কালি মাখাতে হবে যুক্তির অসহায়তার মুখে৷

তবে শুদ্র রজকিনী তো ধাতৃকা। শূদ্রের অভিজ্ঞতা থাকবে এমন আবার হয় নাকি!  পুড়ন্ত বিকালের মতো ফুরিয়ে যায় অহং। শুদ্র কিন্তু অনভিজ্ঞ  নয়। মাতৃবৎ জ্ঞান যে বড়ো পূর্ণতা দেয় কোলজুড়ে। দুঃখী গাছের ডাল শূণ্য হলেও পূর্ণ করেছে সে আমাকে, সে মায়ের জাত নেই৷ মন্দিরের দেওয়ালে স্তব্ধ আরামে আমার দায়িত্ব যে তিনি। মর্যাদার নিশ্চয়তা আমার ধাতৃমা নয়, শুধুই মা। এখানে ভীষ্ম "দগ্ধবীর্য "কথাটা মেনে নিলেন না।  বিচিত্রবীর্য অতিকামুক ; ক্ষত্রিয়দের নাকি যৌনকামনা এমন বেশী হয়৷ আসলে সবটুকু শোধ বর্ণের গুণ বললে বিচ্ছিন্ন শোকের মতো বুকে তীর বাঁধে৷ ধাতৃমা বললেন, নারীর স্বাভাবিক অধিকারের অমর্যাদার বিরুদ্ধেই তো প্রতিবাদ। আসলে ক্ষেমাংকরী যতই যুক্তিসম্মত কথা বলুক, সে শব্দ তীক্ষ্ম। কিন্তু, ভীষ্ম স্বভাব ভদ্র।
এখন প্রশ্ন হলো আমি তো নারী।  হঠাৎ ভালোবাসা না হয় আমায় মানায় না, কিন্তু আমি কি স্তব্ধ হবো ছোট প্রাণে। আমারো পিতা মাতা সমানভাবেই আমাকে মানুষ করেছে, তবে কেন!  কেন আমার মনের ঘর ভাঙবে মননে!  শ্রদ্ধাযোগ্য স্বামী, আর বরণীয় সাথী তো আমি পেতাম; তবু   রাজপদে আসীন নয় এমন জন্মান্ধ কে নিয়ে আমায় বইতে হবে!  সে তো নিজেই স্বীকার করেছে যে, সে প্রভূত ঐশ্বর্যের অধিকারী, তাহলে তো সে ইন্দ্রিয়পরায়ণ হবে এটাই সম্ভাবনা ; কিন্তু বিয়ে যে আমাকে করতেই হবে ; কৌরব জ্ঞাতি ও বাহ্লীকরাজ সম্পর্কে ভীষ্ম জ্যেষ্ঠ। এই বন্ধুত্ব যে থাকবেই, এটাই নিশ্চিত৷ সবটুকুই তো রাজনৈতিক বাঁধন৷ আমার পিতাও তো কিংকর্তব্যবিমুঢ় ; সিদ্ধান্ত নিতে বার বার পা সরিয়েছেন। আমিও তাঁর অপারক ভাব বুঝি। আসলে শান্ত মস্তিষ্ক সবসময় বিচারে চলে৷ পিতা আমাকে অমর্যাদা করেননি কোনদিন ; শুধুই অকপট নয় বৃক্ষের মতো দাঁড়িয়েছেন গর্জে, শিকড়ে আটকে নিয়েছেন মাটি আমাকে৷ পুত্রের মতো স্থান দিয়েছেন এবং সম্মান করেছেন। আমার স্থিরতা, একরত্তির খেলার আহ্বানের মতো আধখানা সিদ্ধান্ত নয়, তাই ভরসা করেছেন আমায়। পিতার মুখে ইরম্মদের মতো জামাতার আকাঙ্ক্ষাকে ভ্রষ্ট হতে দেখে,  অশ্রুজলে বক্ষ সিক্ত হয়েছে৷

ক্ষমতাশীলরা কি এইভাবে আঘাত করে!  ভাগ্য কি কেউ তৈরি করে দেয়!  হ্যাঁ, দিয়েছে তো। ক্ষমতার অলাতচক্র নাকি দৈব্য বিধান, না, আমি মানি না। আচ্ছা!  তবু কি ভবিষ্যৎ গড়ে দেয় বাঁচার আশ্রয় ; নাকি আমার মতো মহাধ্বংসের কারণ গড়ে দেয়। আমাকে যে বর্জন করার ক্ষমতা সমাজ দেয় নি... ; আমি জানিয়ে দিয়েছি তাঁকে, ভালোবেসে নয়,  স্বচ্ছায় বিচার করে সম্মতি জানিয়ে দিয়েছি। চেতনা হলো শেষে, টুকরো সুখে বৃহৎ বিসর্জন যে বিধেয় নয়,  সিদ্ধান্তে এসেছি...  আমার কন্যাপণ, উপঢৌকন, কার্পণ্য নয়...  ভীষ্ম রাজি। পিতা অনঢ়! আমরা ত্যাগী হতে পারি, সমর্পণ করছি; এ আমার  সংসার ভূমি, বিকিকিনির হাট নয়, বিচক্ষণ হতে পারি, পাত্রের সৌভাগ্যবতী জীবনসঙ্গীনী। (ক্রমশঃ)
Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours