কাজল ভট্টাচার্য, সিনিয়র জার্নালিষ্ট, কলকাতা:

প্রথমচোটেই পুত্রসন্তান।
জোড়াপায়ে বাবা মারলেন এক তিড়িক লাফ। ফট- ফটাস শব্দে খসে পড়লো চালের দু- দুটো টালি। আঁতুড়শয্যায় শুয়ে সদ্যমায়ের চোখে টলটল আনন্দাশ্রু।
পুত্রসন্তান। যেন জীবন বীমার নতুন পলিসি।উৎসাহে, উদ্দীপনায় বাবার অবস্থা তখন কড়াইয়ে খইয়ের মতো। অনবরত ফুটছে। উপচে পড়া সোহাগের চোখে তাকালো স্ত্রীর পানে। লাজে লাল সোহাগী।
এরপরেই চটপট ছেলের নাম ঠিক করে ফেললেন বাবা- গণপতি। সঙ্গমে সিদ্ধিলাভ বলেই হয়ত! নবজাতের মায়েরও বেশ মনে ধরলো পুত্রের নাম। তবে কান্না জুড়ে দিলো এতো ঘটনার নায়ক। সম্ভবত, গণপতি নামটা তার মনমতো হয়নি।

দেবদেবীর নামেই সন্তানের নাম। সেটাই ছিলো সে যুগের ট্রেন্ড। তবে সবকিছু জট পাকাতো আরও কিছুদিন পরে। 'হম দো হমারে দো' তখন ভারতবাসীর চিন্তাতেই ছিলো না। জন্ম নিয়ন্ত্রণের কথা সম্ভবত কারুর মাথাতেও আসেনি। তবে গৌরীদান প্রথা বন্ধ হওয়ায়, বিয়ের বয়সও খানিক বেড়েছিল। আর সৌভাগ্য হাতছাড়া হয়েছিল, এক দেড় ডজন সন্তানের মা- বাপ হওয়ার। বেলা ফুরাতো চার- পাঁচ সন্তানের জন্ম দিতে দিতেই।

এদিকে গণপতির বয়স বছর দুই পেরোতে না পেরোতেই মায়ের কোলে এলো কন্যাসন্তান। সবার মুখভার। আবার দু একজন বললো- প্রথমে গণেশ, পরে লক্ষ্মীর আগমণ। সংসারের মঙ্গল অবধারিত। এমন এক সান্ত্বনা দিয়ে যে যার নিজের মনকে বোঝালো।
কন্যার নাম কী? লক্ষ্মী। না, মিললো না। গণপতির বোন যখন নাম হোক সরস্বতী। ছন্দমিল আবিষ্কার করা গেল। এবার স্বামী স্ত্রী নেমে পড়লেন ড্যামেজ কন্ট্রোলে। যার পরিণামে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ফের আরেক সন্তান। তবে ষষ্ঠীর কারসাজিতে এবারেও মেয়ে।
স্বামীর রক্তচোখ দেখে স্ত্রীর মূর্ছা। কন্যাসন্তান প্রসব করে, স্ত্রী যেন এক মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে এনেছে। যাই হোক, ফের নাম নিয়ে বাঁধলো গোল। অনেক মাথা চুলকে, টিকি নেড়ে ভরচাজমশাই কন্যার নামকরণ করলেন ভারতী। সেই সঙ্গে দেবতার ফুল হাতে গুঁজে যজমানকে নিশ্চিত করলেন, চতুর্থ গর্ভে পুত্রলাভ হবেই। অতএব, গণপতি সরস্বতী ভারতীর ছোট ভাই জন্মালো।
ফের খুশিতে ডগমগ স্বামীস্ত্রী। ভরচাজমশাইয়ের শ্রীমুখ বাণী ফলে গেছে। কিন্তু গোল বাঁধলো অন্য জায়গায়।
"অত চিন্তার কী আছে?" স্বামীকে বললো স্ত্রী। "ভেবেভুবে ছেলের নাম রেখো।" কিন্তু তর সয় না বাপের। জপমন্ত্রের মতো বারেবারে আওড়াতে লাগলো- গণপতি ভগবতী ভারতী। মিনিট কয়েক পরেই বাবা চেঁচিয়ে উঠলো, পেয়ে গেছি, পেয়ে গেছি। অবশেষে ছেলের নাম হলো রাষ্ট্রপতি। গণপতি ভগবতী ভারতী রাষ্ট্রপতি।
আজকাল অবশ্য দেবদেবীর বাজারে ধস নেমেছে। ধর্মনিরপেক্ষতার বিস্ফোরণে ওসব অচল। বস্তাপচা। এমনকি নাম দিয়ে, জাত ধর্ম দেশবিচারেও প্রমাদের সম্ভাবনা।

মজা আরও আছে। কথায় বলে গাঁয়ের মধা শহরের মধুসূদন। কীর্তিমানদের অনেকেরই আবার 'লোকাল' নাম থাকে। সেই নামেই ধরা থাকে তাদের একেকজনের গুণ। হাতকাটা বাপী। ওয়াগন ব্রেকিংয়ে সিদ্ধহস্ত। তারপর একদিন রেলের চাকাতেই কাটা পড়লো কনুই থেকে বাঁহাত। পেটোবিশু। অন্য পাড়াতেও বোমাবাজি করার অর্ডার পেতো বিশু। সকালে উঠেই কালীমার্কা দিয়ে মুখ কুলকুচা করা। তবে জাতে মাতাল তালে ঠিক। হঠাত নাকে চোলাইয়ের গন্ধ আসা মানেই আশপাশে কেষ্ট হাজির। তাই ওই গুণধরের লোকাল নাম মাতালকেষ্ট।

শুধু মাতালের অভিনয় করেই নামডাক করে ফেলেছিলেন ব্রাহ্মনসন্তান কেষ্ট মুখার্জি। আবার গব্বর সিংয়ের কথাই ধরুন। তার বাপমায়ের দেওয়া আমজাদ নামটাই যেন ঢাকা পড়ে গেছিলো শোলের ওই ডাকাতের দাপটে। অনেক নায়ক নায়িকাই আবার নিজেই নিজের নাম রাখেন। যতীন খান্না বিখ্যাত হন রাজেশ খান্না নামে। অরুণকুমার হয়ে যান উত্তমকুমার। গৌরাঙ্গ হয়ে যান মিঠুন।
আরও কায়দা আছে। প্রসেনজিত। অনেকেই কথা বলার সময় প্রসেনজিত না বলে, বলেন বুম্বাদা। বেশ ভেবেচিন্তেই, নায়ক নায়িকা বা অন্যকোনও নামজাদা মানুষের নামের সঙ্গে 'দা' অথবা 'দি' জুড়ে দেওয়া। ভাবখানা এই, দেখ ওই মানুষগুলির কত ঘনিষ্ঠ আমি।

ঠাকুর দেবতার পাশাপাশি বিখ্যাত লোকজনের নামে সন্তানের নামকরণেরও রেওয়াজ ছিল। রাসবিহারী, সুভাষ, রবীন্দ্রনাথ, কণিকা, সুচিত্রা। কিন্তু দাদু ঠাকুমারা নাতি নাতনির নাম ছেঁটেছুটে নিয়ে, সেই নামে ডাকতেন। রাসবিহারী হতো রাসু, রবীন্দ্রনাদ রবী, কণিকা কণা বা কণি এরকম।
আমার কেসটা আবার ছিলো, আরও কয়েক কদম এগিয়ে। রামের জন্মের আগেই রামায়ণ লেখার মতো।
শুনেছিলাম, অপুর সংসার দেখে ঠাকুমা আমার জন্মের আগেই নাম ঠিক করে রেখেছিল। নাতি হলেই নাম কাজল। আজকাল অবশ্য এই নামটা বাতিলের খাতায়। কাজল মানে কালো। কেই বা চায় তার সন্তান কালো হোক।
এখানেই শেষ না। এযুগের এক কবিতো আবার কাজলকে চক্রান্তে জড়িয়ে ফেলেছেন। কলঙ্ক আমি কাজলের ঘরে থাকি। এতে কী কবি তাঁর স্বাধিকার লঙ্ঘন করেছেন?

তা আমিই জন্মালাম।
কিন্তু কাজল নামটা সবার বড্ড বড় মনে হয়েছিলো নিশ্চয়ই। তাকে কাটছাঁট করে নামটা দাঁড়ালো কাজু। শেষ পর্যন্ত আমার আসল নামটা কাজল, স্কুল কলেজ গড়িয়ে এপিক প্যান হয়ে আধারে এসে থিতু হলো। ওদিকে ইতিমধ্যেই দিন ফুরিয়ে স্বর্গ অথবা নরকবাসী হয়েছে দাদু ঠাকুমা। কিন্তু কাকা কাকিমার মুখে দিয়ে গেছিল সেই ডাক। ভাবতাম কী কুঁড়ের বংশে জন্মেছি। গোটা নামটা ডাকার এনার্জিও খরচ করতে চায় না কেউ।
তা যাই হোক, কাকিমা হাসপাতালে ভর্তি হয়ে, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কাজু বলেই ডেকে গেলো। তার বছর দশেক পর মারা গেলো কাকু।
ব্যাস, হারিয়ে গেলো কাজু। ওই নামে আর কেউ কোনদিন ডাকবে না। শুধু যে একজন মানুষ মারা গেলো তাই না। তার সঙ্গে হারিয়ে গেলো অন্য আরেকজনের একটা নাম।
এবার থেকে আমি কাজল।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours