বিশ্বপরিচয়: শিবাশীষ বসু, ফিচার রাইটার, উত্তরপ্রদেশ:

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের কৃতী ছাত্র প্রমথনাথ সেনগুপ্ত এমএসসি করে পাঁচ বছর বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর কাছে গবেষণা করেছিলেন। ১৯৩৩ সালের মে মাসে গ্রীষ্মকালীন অবকাশে তিনি 'স্টেটসম্যান' পত্রিকায় বিশ্বভারতীর পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক পদের জন্য বিজ্ঞাপন দেখে আবেদন করে ফেললেন। জুন মাসের শেষ সপ্তাহে শান্তিনিকেতন থেকে পেলেন সিলেকশনের সংবাদ। অভিজিত রায় লিখেছেন, "তরুণ প্রমথনাথ শান্তিনিকেতনে চাকরী পেয়েছিলেন সত্যেন বসু এবং জ্ঞানচন্দ্র ঘোষের সুপারিশে।" ঘটনাটা সম্ভবত তাই-ই কারণ প্রমথনাথ নিজেও রবীন্দ্রনাথের উক্তি উদ্ধৃত করে এই কথারই সমর্থন করেছেন।

১৯৩৩ সালের ১৫ই জুলাই প্রমথনাথ মাসিক ৭৫ টাকা বেতনে যোগ দিলেন বিশ্বভারতীতে।

আশীষ লাহিড়ী লিখেছেন, "মেট্রোপলিটান কলেজে বিদ্যাসাগর মশাই যেমন শিক্ষকদের না জানিয়ে আড়াল থেকে শিক্ষাদানের পদ্ধতি পর্যবেক্ষণ করতেন, রবীন্দ্রনাথও, অন্তত প্রমথনাথের ক্ষেত্রে, তাই করতেন।" এরকমই একদিনের কথা লিখেছেন প্রমথনাথ। তিনি ক্লাসে পড়াচ্ছেন, দেখতে পেলেন গুরুদেব দরজায় দাঁড়িয়ে, দৃষ্টি নিবদ্ধ টেবিলের উপরের যন্ত্রপাতির দিকে। ল্যাবরেটরির ভিতরে ঢুকে যন্ত্রগুলি সাগ্রহে দেখে গুরুদেব বললেন, "এবার অধ্যাপনা শুরু করো, বিজ্ঞানের রস আস্বাদনে আমার লোভের অন্ত নেই।"

সেইদিনই সন্ধ্যার পর গুরুদেব প্রমথনাথকে ডেকে পাঠালেন উত্তরায়ণে।
সেখানে তখন বসে প্রিন্সিপাল ডঃ ধীরেন্দ্রমোহন সেন। এইখানে রবীন্দ্রনাথ প্রমথনাথকে লোকশিক্ষার জন্য একটি বিজ্ঞানের বই লেখবার প্রস্তাব দিলেন। বললেন, "তোমার উপর একটা ভার দিতে চাই, বৈজ্ঞানিক বিষয়ে 'লোকশিক্ষা' পাঠগ্রন্থ প্রণয়নের কাজ।" বই লেখার নির্দেশ দিয়ে গুরুদেব তাঁকে বইয়ের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে বললেন এবং লেখবার পদ্ধতি নিয়েও আলোচনা করলেন। "সাধারণ জ্ঞানের সহজবোধ্য ভূমিকা করে দেওয়াই হবে তোমার কাজের উদ্দেশ্য। তাই, জ্ঞানের এই পরিবেশনকার্যে পাণ্ডিত্য যথাসাধ্য বর্জন করতে হবে। পড়তে দিলেন ব্রিটিশ পদার্থবিদ স্যার জেমস জিনসের লেখা একটা বই, ‘থ্রু স্পেস এ্যান্ড টাইম’। বইটি থেকে জনপ্রিয় বিজ্ঞানের বই কিভাবে লিখতে হয় তার একটা রসদ পাবেন প্রমথবাবু – বোধহয় সেরকমই একটা ধারণা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।

এইখানে একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলেছেন দীপঙ্কর চট্টোপাধ্যায় - প্রমথনাথ বিজ্ঞানের কৃতী ছাত্র এবং খুব ভাল শিক্ষক হতেই পারেন, কিন্তু "যেখানে এতটা প্রত্যাশা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ লোকশিক্ষামূলক বিজ্ঞানের বই লেখাচ্ছেন এবং সেই বই নিয়ে তাঁর ঈপ্সিত 'লোকশিক্ষা গ্রন্থমালা'র প্রকাশন শুরু করবেন বলে ভেবেছেন, সেখানে প্রমথনাথের যোগ্যতা সম্বন্ধে তিনি নিশ্চিত হলেন কি করে?" এর উত্তর রয়েছে প্রমথনাথকে দেওয়া রবীন্দ্রনাথের প্রস্তাবেই - "আমি বিজ্ঞানের সাধক নই, তবে বিজ্ঞানের সঙ্গে প্রথম পরিচয় ঘটিয়ে দেবার কাজে সাহিত্যের সহায়তা কিভাবে গ্রহণ করতে হবে ও কিভাবে লোকশিক্ষাদান সঙ্কল্পকে সার্থক করে তুলতে পারা যায় সে বিষয়ে নিঃসঙ্কোচে আমার সাহায্য নিতে পার।"

সত্যি কথা বলতে কি, যার পর নাই খুশি হয়েছিলেন প্রমথনাথ। এর পরের ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায় প্রমথনাথ সেনগুপ্তের রচিত 'আনন্দরূপম' গ্রন্থখানিতে। এই প্রসঙ্গে ওই গ্রন্থটি নিয়ে দুকথা বললে তা নিশ্চয়ই অপ্রাসঙ্গিক হবে না। আনন্দরূপম-এর লেখাগুলি প্রথম মুদ্রিত হয়েছিল 'সাপ্তাহিক বসুমতী' পত্রিকায়, ১৯৭০ সালের ২৮শে মে থেকে ১০ই সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বসুমতীর ৭৪ বর্ষের ৪৮ তম সংখ্যা থেকে ৭৫ বর্ষের ১১ তম সংখ্যা অর্থাৎ মোট চোদ্দো কিস্তিতে। পত্রিকায় প্রকাশের সময় মূল লেখাটির সঙ্গে ছাপা হয়েছিল প্রমথনাথের স্বহস্তে লেখা 'বিশ্বপরিচয়'-এর খসড়া পান্ডুলিপির মধ্যে রবীন্দ্রনাথের সংশোধন সমেত পাঁচটি পৃষ্ঠার প্রতিলিপি। রচনাটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশের বছর দুইয়েক পর 'বসুমতী প্রাইভেট লিমিটেড পাবলিকেশন' থেকে ১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আনন্দরূপম গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। ৭ই সেপ্টেম্বর বসুমতী পত্রিকায় আসন্ন প্রকাশিত বইটির একটি বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল, যাতে লেখা ছিল, "রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে নানা অজানা তথ্যের সমাবেশে গ্রন্থটি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে একটি অপরিহার্য গ্রন্থ হিসেবে নিঃসন্দেহে বিবেচিত হতে পারে।" কোনো এক অজ্ঞাত কারণে বইটির প্রথম এবং একমাত্র সংস্করণটি প্রকাশিত হওয়ার পর জনমানসের স্মৃতি থেকে হারিয়ে যায়। অভিজিত লিখেছিলেন, "এখন বইটি দুর্লভ, খুঁজলেও পাওয়া যায় না।" দীর্ঘ প্রায় পঞ্চাশ বছর পর বইটি আমাদের ফিরিয়ে দিয়েছেন সাহিত্য সংসদ।

তোপসে, গন্ধটা খুব সন্দেহজনক!

(চলবে)

তথ্যসূত্র :
বিশ্বপরিচয়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ
রবীন্দ্রনাথ ও বিজ্ঞান, দীপঙ্কর চট্টোপাধ্যায়, আনন্দ পাবলিশার্স
রবি ঠাকুর, রাহাজানি এবং রবীন্দ্র পুজারীবৃন্দ, অভিজিত রায় ফরিদ আহমেদ, মুক্তমনা ডট কম
রবীন্দ্রনাথ : মানুষের ধর্ম মানুষের বিজ্ঞান, আশীষ লাহিড়ী, অবভাস
আনন্দরূপম, সঞ্জীব মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত, সাহিত্য সংসদ

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours