সন্দীপ চক্রবর্তী, প্রবীণ সাংবাদিক, কলকাতা:

একদিকে কৌরবদের সপ্তরথী আর অন্যদিকে একা অভিমন্যু। এই অসম যুদ্ধে অভিমন্যুর কী পরিণতি হয়েছিল, আমরা মোটামুটি সকলেই জানি। ২০২০ সালের ২৩ জানুয়ারি আর মাত্র কয়েক ঘন্টা দূরে। এই সন্ধিক্ষণে এসে মনে হচ্ছে, ২৩ জানুয়ারি দিনটি যার জন্মদিন হিসেবে ভুবনবিখ্যাত সেই নেতাজী সুভাসচন্দ্র বসু ছাড়া ভারতীয় রাজনীতির অভিমন্যু হিসেবে আর কাউকে ভাবা যায় না। স্বাধীনতার আগে এবং পরে নেতাজী সুভাসচন্দ্র বসুই ভারতীয় রাজনীতির আদি ও অকৃত্রিম অভিমন্যু। একদিকে গান্ধীজী-সহ কংগ্রেস ও বামপন্থী সপ্তরথী আর অন্যদিকে তিনি একা। পরিণতিও একইরকম। নেতাজী অপমানিত, ক্লেদাক্ত, রক্তাক্ত কিন্তু শেষ বিচারে নায়ক থেকে মহানায়ক। তারপর সেখান থেকে ভারতের স্বাধীনতা-প্রাপ্তির প্রধান কারিগর।
 ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন প্রবাহিত হয়েছিল দুটি ধারায়। একটি ছিল নরমপন্থী অন্যটি চরমপন্থী। ১৮৮৫ সালে কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠার সময় থেকে নরমপন্থী ধারাটির উদ্ভব। কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রথম সভাপতি অ্যালেন অক্ট্যাভিয়ান হিউম চেয়েছিলেন কংগ্রেস এমন একটা প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠুক যেখান থেকে ভারতীয়রা আবেদন-নিবেদনের মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকারের কাছে তাদের দাবিদাওয়া পেশ করতে পারবে। না, হিউম কোনওরকম সংঘাতে যেতে চাননি। ব্রিটিশ হিউমের পক্ষে স্বজাতীয় সরকারের বিরুদ্ধে সংঘাতে যাওয়া সম্ভবও ছিল না। তদানীন্তন ভারতীয় নেতাদের বেশিরভাগই হিউমের এই নরমপন্থী দৃষ্টিভঙ্গী মেনে নিয়েছিলেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম ছিল ১৮৫৭ সালের সিপাহি মহাসংগ্রাম। এবং এই সংগ্রাম ছিল চরমপন্থী। কিন্তু কংগ্রেসের নেতৃত্বে যে রাজনৈতিক সক্রিয়তা শুরু হল প্রথম দিকে তা ছিল নরমপন্থী এবং আবেদন-নিবেদন নির্ভর। কংগ্রেসের নরমপন্থী মনোভাব ভারতীয়দের মধ্যে কেউ কেউ মানতে পারেননি। বালগঙ্গাধর তিলক, অরবিন্দ ঘোষ প্রমুখ এদের অন্যতম। মূলত এদেরই নেতৃত্বে এবং অনুপ্রেরণায় শুরু হয়েছিল স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্য একটি ধারা—যার নাম চরমপন্থী স্বাধীনতা আন্দোলন।
 নেতাজীর রাজনৈতিক জীবন কংগ্রেস থেকে শুরু হলেও তিনি কংগ্রেসের চিরাচরিত নরমপন্থী মানসিকতার মানুষ ছিলেন না। ব্রিটিশরাজের শিকড়ে চরম আঘাত হানাই ছিল তার রাজনৈতিক লক্ষ্য। অন্যদিকে সেইসময় মোহনদাস করমচাদ গান্ধী ছিলেন কংগ্রেসের মূল চালিকাশক্তি। সম্প্রদায়গত পরিচয়ে তিনি বৈষ্ণব এবং বংশানুক্রমিক পেশায় বানিয়া। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন যত না তার কাছে রাজনৈতিক আন্দোলন তার থেকে অনেক বেশি আত্মিক উত্তরণের মাধ্যম। হিংসায় তিনি বিশ্বাস করেন না। সুতরাং নেতাজীর সঙ্গে তার সংঘাত যে অনিবার্য হয়ে উঠবে সে কথা বলাই বাহুল্য। যদিও প্রকাশ্যে কেউই পরস্পরের বিরুদ্ধে অসৌজন্য প্রকাশ করেননি। কিন্তু মতপার্থক্য ছিল, সংঘাতও ছিল। চৌরিচৌরায় হিংসাত্মক ঘটনার অভিঘাতে গান্ধীজী যখন অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করে নিলেন তখন নেতাজী এই সিদ্ধান্তকে বলেছিলেন Historical Blunder। তবে চৌরিচৌরা নয়, গান্ধীজী ও নেতাজীর রাজনৈতিক সংঘাতের কিংবা আরও পরিষ্কার করে বললে নেতাজীর প্রতি গান্ধীজীর অন্যায় আচরণের চরম নিদর্শন আমরা পাই ত্রিপুরি কংগ্রেসের সময়।
 ১৯৩৯ সালের কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচনের সময় বিরোধিতার মুখোমুখি হবেন জেনেও নেতাজী মনোনয়নপত্র দাখিল করলেন। কয়েকমাস আগে ইউরোপে দীর্ঘ ছুটি কাটিয়ে গান্ধীজীর মানসপুত্র জওহরলাল নেহরু দেশে ফিরেছেন। গান্ধীজী নেহরুকে অনুরোধ করলেন সুভাসের বিরুদ্ধে মনোনয়নপত্র দাখিল করার জন্য। নেহরু রাজি হলেন না। এরপর প্রস্তাব দেওয়া হল মৌলানা আজাদকে। তিনিও রাজি হলেন না। শেষমেশ রাজি হলেন অন্ধ্রের নেতা ড পট্টভি সীতারামাইয়া। নেতাজী নিজের জয়ের ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন না। কিন্তু ২৯ জানুয়ারি ১৯৩৯ ফল প্রকাশিত হবার পর দেখা গেল সুভাস পেয়েছেন ১৫৮০টি ভোট আর সীতারামাইয়া ১৩৭৭টি ভোট। সুভাস জিতলেন বটে কিন্তু তার জয়ে গান্ধীজী মর্মাহত হলেন। প্রকাশ্যে বললেন,’আমি ওর (সুভাসের) জয়ে খুশি—কিন্তু মৌলানা আজাদ সাহেব মনোনয়নপত্র দাখিল করতে রাজি না হওয়ায় আমিই যেহেতু পট্টভি সিতারামাইয়াকে প্রার্থী হতে বলেছিলাম, তাই ওর পরাজয় আমারই পরাজয়।‘
 এরপরের ঘটনা আরও সাংঘাতিক। ১৯৩৯ সালের মার্চে কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশন বসেছিল জবলপুরের কাছে ত্রিপুরিতে। কিন্তু অত্যধিক শারীরিক পরিশ্রমের ফলে সুভাস ফেব্রুয়ারির ২০-২১ তারিখ নাগাদ অসুস্থ হয়ে পড়েন। এই সময়েই ওয়ার্ধায় কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক হবার কথা ছিল। অসুস্থ সুভাস ওয়ার্ধায় যেতে পারবেন না বলে বার্ষিক অধিবেশন অনুষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক স্থগিত রাখার অনুরোধ জানিয়ে বল্লভভাই প্যাটেলকে টেলিগ্রাম করেন। অন্য একটি টেলিগ্রামে গান্ধীজীকে তার বিবেচনা অনুযায়ী নতুন ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করতে অনুরোধ করেন। আশ্চর্যের ব্যাপার গান্ধীজী সুভাসের অনুরোধে কর্ণপাত করেননি। নতুন কমিটিও গঠিত হয়নি, আবার পুরনো কমিটির বৈঠকও স্থগিত রাখা হয়নি।
  গান্ধীজীর এ হেন উদাসীনতার পিছনে যে রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি ছিল সে কথা বলাই বাহুল্য। কারণ এর কিছুদিনের মধ্যেই জানা গেল, সুভাসের প্রতি কংগ্রেসের নেতা এবং সাধারণ কর্মীরা ক্ষুব্ধ। তাদের অভি্যোগ, টেলিগ্রাম পাঠিয়ে কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক স্থগিত রাখতে বলার মধ্যে সুভাসের একনায়কতান্ত্রিক মনোভাব ফুটে উঠেছে। কংগ্রেস তার অনুপস্থিতিতে কোনও কাজ করুক, সেটা নাকি সুভাস চানই না! প্রতিবাদে বল্লভভাই প্যাটেল-সহ এগারো জন সদস্য কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটি থেকে পদত্যাগ করেন। বাধ্য হন সুভাস অধিবেশনে যোগ দিতে। জ্বরে কাবু স্ট্রেচার-বাহিত সুভাস মঞ্চে ওঠার পর গান্ধী-অনুগামী এক কংগ্রেস নেতা মন্তব্য করেছিলেন, ‘Why don’t you check whether he has any onions under his armpits।‘ পরের মাসেই সুভাস কংগ্রেস থেকে পদত্যাগ করেন। তারপর এগিয়ে যান তার নিজস্ব পথে।
 প্রশ্ন উঠতে পারে, ভারতের স্বাধীনতা প্রাপ্তিতে গান্ধীজী না সুভাস—কার অবদান বেশি? বাম এবং কংগ্রেসের ল্যাবরেটরিতে তৈরি ভারতের ইতিহাসে সুভাস দুটি অনুচ্ছেদের বেশি জায়গা পান না। অন্যদিকে গান্ধীজীকে নিয়ে পাতার পর পাতা জুড়ে আলোচনা হয়। এ কথা অনস্বীকার্য, গান্ধীজীর জন্যেই ভারতবর্ষের সাধারণ মানুষ স্বাধীনতা আন্দোলনে অনুপ্রাণিত হয়ে উঠেছিল। কিন্তু গান্ধীজীর জন্যেই কি ভারত স্বাধীনতা লাভ করেছিল? এ বিষয়ে আলোকপাত করেছেন সামরিক ইতিহাসের বিশেষজ্ঞ মেজর জেনারেল জি ডি বক্সি। বোসঃ অ্যান ইন্ডিয়ান সামুরাই গ্রন্থে তিনি ভারতের স্বাধীনতা প্রাপ্তির সময়ে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট অ্যাটলি এবং পশ্চিমবঙ্গের তদানীন্তন ভারপ্রাপ্ত রাজ্যপাল পি বি চক্রবর্তীর আলাপচারিতার এক বিবরণ দিয়েছেন। আমাদের মনে রাখতে হবে ক্লিমেন্ট অ্যাটলি ১৯৪৫ থেকে ১৯৫১ পর্যন্ত ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন এবং ভারতের হাতে ক্ষমতা প্রত্যর্পণের সনদে তিনিই স্বাক্ষর করেছিলেন। মেজর জেনারেল বক্সি লিখেছেন, পশ্চিমবঙ্গের ভারপ্রাপ্ত রাজ্যপাল পি বি চক্রবর্তী সরাসরি অ্যাটলিকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন,’গান্ধীজীর ভারত ছাড়ো আন্দোলনের তীব্রতার কারণেই কি আপনারা তড়িঘড়ি ভারতের হাতে ক্ষমতা প্রত্যর্পণ করে এ দেশ থেকে চলে গেলেন?’ জবাবে অ্যাটলি তাদের ভারতত্যাগের অনেকগুলি কারণ দেখিয়েছিলেন। তবে তার মধ্যে প্রধান ছিলেন নেতাজী সুভাসচন্দ্র বসু এবং তার আজাদ হিন্দ বাহিনী। বিশেষ করে সুভাসের মৃত্যুসংবাদ পাওয়ার পর  এবং লালকেল্লায় আজাদ হিন্দ বাহিনীর বন্দি সৈন্যদের বিচারপর্ব চলার সময় ভারতীয় সেনাবাহিনীতে বিদ্রোহের সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছিল। ভারতের ব্রিটিশ সরকার আর একটি সিপাহি মহাসংগ্রামের আশঙ্কা করেছিল। দু-দুটি বিশ্বযুদ্ধের ভারে পর্যুদস্ত গ্রেট ব্রিটেন এত বড়ো ঝুকি নিতে চায়নি। সেই কারণেই ক্ষমতা হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পি বি চক্রবর্তী জিজ্ঞাসা করেছিলেন,’গান্ধীজী এবং কংগ্রেসের আন্দোলন কি কোনও প্রভাবই ফেলতে পারেনি?’ যেন কেউ তার সঙ্গে ঠাট্টা করছে, ঠিক সেই ভঙ্গিতে হেসে অ্যাটলি বলেছিলেন,’মি-নি-মা-ল!’ অর্থাৎ খুবই সামান্য।
 গান্ধীজী সুভাসকে কংগ্রেসের ভেতরেই আগাছায় পরিণত করতে চেয়েছিলেন। বুঝতে পারেননি সুভাস একদিন তাকেও ছাড়িয়ে যাবে। বামপন্থীরা গান্ধীগিরির ধার ধারেন না। তারা যদি কাউকে পথের কাটা বলে মনে করেন তা হলে তার ভাবমূর্তি ধ্বংস করার জন্য যে-কোনওরকম অসভ্যতায় নেমে আসতে পারেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে রাশিয়া ইংল্যান্ডকে সমর্থন করা মাত্র কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া(সি পি আই) ইংল্যান্ডের সমর্থক হয়ে গেল। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের বারোটা বাজিয়ে ইংল্যান্ডকে সমর্থনের ডাক দিল সি পি আই। স্বভাবতই সুভাস এর প্রতিবাদ করেছিলেন। ফলে সি পি আই-পরিচালিত জনযুদ্ধ পত্রিকায় সুভাসকে সাম্রাজ্যবাদের কুকুর হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছিল। কারণ সুভাস ভারতকে স্বাধীন করার জন্য জাপানের সাহায্য নিয়েছিলেন। আর জাপান ছিল রাশিয়ার বিরোধী। জনযুদ্ধে প্রকাশিত পরপর কয়েকটা কার্টুনে সুভাসকে কখনও হিটলারের ছায়াসঙ্গী গোয়েবলসের পাশে বাচ্চা ছেলে হিসেবে আবার কখনও জাপানের প্রধানমন্ত্রী তোজোর কুকুর হিসেবে দেখানো হয়েছে। শুধু তাই নয়, বাম নেতারা প্রকাশ্য জনসভায় নেতাজীকে তোজোর কুকুর বলতেন। সে যুগের এমনই এক নেতার নাম জ্যোতি বসু।
 তবুও নেতাজীকে আটকানো যায়নি। তিনি ভারতীয় রাজনীতির অভিমন্যু ঠিকই কিন্তু বিস্মৃত নন। বরং স্বাধীনতার বাহাত্তর বছর পরে তিনি এক আশ্চর্য বিশল্যকরণীতে পরিণত হয়েছেন। বিশেষ করে অবক্ষয়িত এবং পরাভূত বাঙালির কাছে। এখনও কেউ কেউ বিশ্বাস করেন তিনি ফিরে আসবেন। ফিরে এসে ঝাকুনি দিয়ে বাঙালিকে দাড় করাবেন। তারপর জাগাবেন ভারতবর্ষকে। হোক না কষ্টকল্পনা। ক’জন পারেন মৃত্যুর পর এরকম অমৃতভাণ্ডে পরিণত হতে? গান্ধীজী পারেননি, নেহরু পারেননি কিন্তু নেতাজী সুভাসচন্দ্র বসু পেরেছেন।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours