কাজল ভট্টাচার্য, কার্টুনিস্ট ও সিনিয়র জার্নালিষ্ট, কলকাতা:

প্রধানমন্ত্রীর সফরের ছন্দ একটিবারের জন্যও কেটে যায়নি।
যাত্রাপথের ছন্দ কেটেছিল বললে ডাহা মিথ্যে কথা বলা হবে। একেবারে তালগোল পাকিয়ে গেছিলো সাধারণ মানুষের প্রাত্যহিক সফর। 'যুব দিবস'- এর একদিন আগে ঠিক এভাবেই, তাঁদের ক্ষমতা জাহির করে দেখিয়ে দিলেন পড়ুয়ারা।
শনিবার দুপুরের পর থেকেই, শহরের রাস্তায় দিশেহারা হয়ে পাগলের মতো ছুটে বেরিয়েছে সাধারণ মানুষ। অবরুদ্ধ ধর্মতলা। তার প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছিলো দূর দূরান্তেও।
একসময় মনে হচ্ছিলো, নাগরিক আইন তৈরির কারিগর নরেন্দ্র মোদি না, কারিগর সাধারণ মানুষ। সেই সাধারণ মানুষদের শাস্তি দিতেই, যেন জোট বেঁধে নেমে পড়েছিলেন পড়ুয়ারা। সংবাদমাধ্যমের খবর, এই আন্দোলনের মূল কারিগর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়। তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলো অন্যান্য কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা।
এ যেন উধোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে। বাম কংগ্রেস ছাত্রদের ধর্মতলা অবরোধ। নাগরিক আইন মানছি না মানবো না। ক্ষোভ প্রধানমন্ত্রীর ওপর। কিন্তু তাঁকে ছোঁয়ার সাধ্য কী! সেই অক্ষমতার মাসুল গুনতে বাধ্য করা হলো সাধারণ মানুষকে। ওদিকে হাসিমুখে মোদি বিরোধিতার সেই পুরনো মুখস্থ বয়ান দিয়ে গেছেন বাম কংগ্রেস নেতারা।
কিন্তু প্রশ্ন একটাই, অবরোধের জন্য মানুষের ভোগান্তির দায় নেবেন কে?
তবে শনিবার অসামান্য সংযম দেখিয়েছে রাজ্য পুলিস। তাঁরা মারমুখী ছাত্রদের সামাল দিয়েছেন রীতিমতো ঠান্ডা মাথায়। নইলে যে কোনও মুহূর্তে, এই শহরের বুকেও ঘটে যেতে পরতে আর এক জামিয়াকাণ্ড। যা নিয়ে নিশ্চিতভাবেই বাম কংগ্রেস তোপের মুখে পড়তো মমতা সরকার।
শনিবার সকালের দিকে বিক্ষোভ শুরু হয়েছিলো শহরে মোদির পা পড়া নিয়ে। গো ব্যাক মোদি। উড়েছিলো কালো পতাকা, কালো বেলুন। পরে বেলা বাড়তেই আক্রমণের নিশানা পাল্টালো। এবার রোষের মুখে পড়লেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কেন তিনি মোদির সঙ্গে রাজভবনে বৈঠকে বসলেন? ফের সেই পুরনো রেকর্ড বাজালো বাম কংগ্রেস- দিদি মোদি সেটিং।

শনিবার গোটা ধর্মতলা চত্বর ছাড়িয়ে তার আশপাশের এলাকা জুড়েও শুধুই পুলিস। রাস্তা ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছিলো বাইরের থেকে আসা বাসের। শহরের রাস্তায় ঘুরপাক খেয়ে মরেছে যাত্রীবোঝাই বাসও। ঠিক কোনরাস্তায় গেলে গন্তব্যে পৌঁছনো যাবে? বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছেন বাইরে থেকে আসা মানুষজন। শহরের সব রাস্তাঘাট অনেকেরই চেনা নেই। উদভ্রান্ত ডিউটি থেকে ফেরা মানুষজন। কিভাবে বাড়ি পৌঁছবেন মানুষ?
রাতে মারমুখী ছাত্রদের শান্ত করতে একসময় এগিয়ে এলেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী। রাসমণি অ্যাভিনিউয়ে তৃণমূল ছাত্র সংগঠনের মঞ্চে দাঁড়িয়ে, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর বৈঠকের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা বারবার বোঝানোর চেষ্টা করলেন তিনি। মুখ্যমন্ত্রীর কোনও যুক্তি মানতে চাইলেন না বাম কংগ্রেস পড়ুয়ারা। একসময় বচসায় জড়িয়ে পড়তে দেখা গেল দু'পক্ষকে। এরপরেই মুখ্যমন্ত্রী নরমেগরমে জানিয়ে দিলেন, আন্দোলন হিংসার রাস্তা নিলে সরকার বরদাস্ত করবে না। বিরোধীপক্ষকে খোঁচা দিয়ে তিনি বললেন, "এ রাজ্যে বিজেপি'র অনেক লুকানো বন্ধু আছে।"
ওদিকে নরেন্দ্র মোদি তাঁর সফরসূচীর অন্যান্য কাজকর্ম সেরে রাতের আশ্রয় নিলেন বেলুর মঠের নিভৃতাশ্রয়ে। ধর্মতলা তখনও পড়ুয়াদের দখলে। "মোদি শহর ছাড়লে আমরাও ধরনা থেকে উঠবো।" সাফ জানিয়ে দিলেন একগুঁয়ে বিক্ষোভকারীরা।

ছবিটা বদলালো না রবিবার সকালেও।
নেতাজি ইন্ডোরে কলকাতা পোর্ট ট্রাস্টের অনুষ্ঠানে যোগ দেন মোদি। একটিবারের জন্যও বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর নাম মুখে আনেননি তিনি। শুধু জানিয়ে দিয়েছেন নাগরিক আইনের সারমর্ম মানুষ বুঝলেও, রাজনীতির কারবারীরা তা বুঝতে পারছেন না। এরপরেই সরাসরি তোপ দাগেন রাজ্য প্রশাসনের দিকে। জানান, কাটমানি, সিন্ডিকেটের সুযোগ নেই বলেই বাংলায় কৃষক সম্মান নিধি চালু করেনি শাসকদল।
বাংলার আবেগে সুড়সুড়ি দিতে বাংলাতেই সম্বোধন করে নিউ ইয়ারের শুভেচ্ছা জানালেন মোদি। এদিন প্রধানমন্ত্রী কলকাতা বন্দরের নতুন নাম দিলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বন্দর। সেই সঙ্গে ঘোষণা করলেন আরও একগুচ্ছ উন্নয়নমুখী প্রকল্পের।
অপেক্ষা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিদায়ের। এ শহর থেকে আজই তিনি উড়ে যাবেন তাঁর সফরসূচী সেরেই। তাহলে কেন অবরুদ্ধ হয়ে থাকলো কলকাতার প্রণকেন্দ্র? কেনই বা এ ব্যাপারে চুপ জনদরদী নেতারা? নাগরিক আইন মানবেন না বিরোধিতা করবেন, তা পড়ুয়াদের নিজস্ব ব্যাপার। স্বতন্ত্র মতামত আছে সাধারণ মানুষের। কিন্তু নিজেদের মতে প্রধানমন্ত্রীর সীলমোহর দাগার দাবিতে, কোন অধিকারে শহরের গতি স্তব্ধ করে দেন আমাদের 'শিক্ষিত' পড়ুয়ারা?
একি সেই 'ঝি পিটিয়ে বউকে শিক্ষা দেওয়া' নাকি?

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours