আনন্দিতা রায়, লেখিকা ও সঙ্গীতশিল্পী, দুর্গাপুর:

সাহিত্যের সমাজে প্যারোডি কুলীন নয়, ভঙ্গজ। গোত্র স্খলন ব্যতিরেকে প্যারোডির প্রাদুর্ভাব ঘটে না। কারণ প্যারোডি পরাশ্রয়ী রচনা। রসিক প্রাণ শ্রীকুমারেশ ঘোষ প্যারোডি সম্পর্কে বলেছেন, "আসলে এই আসল-নকল ছন্দ রচনা যেন যমজ ভাই বা যমজ ভাইবোন"। সুরসিক শিবরাম চক্রবর্তী প্যারোডিকারকে তুলনা করেছেন সার্কাসের ক্লাউনের সঙ্গে। যে সব খেলাই জানে, অথচ মজা দেখাবার জন্য না জানার ভান করে দর্শকদের মজাতে চায়। পরাশ্রয়ী প্যারোডির আরেকটি উপমা:--
লতানে গাছ, ঠিক যেন উচ্ছে লতা। বেচারা নিজে খাড়া ভাবে উঠতে পারে না, তাই পদে পদে শুঁড় বাড়িয়ে পাশের অন্য গাছপালাকে জড়িয়ে ধরে এগোচ্ছে আর ফসল ফলাচ্ছে, যা তেতো কিন্তু স্বাস্থ্যকর। এই এগোবার পথে যদি ধরবার কিছু না থাকে তাহলে গেরস্থ চাষী তাকে সাহায্য করে। পাটকাঠি অথবা মাটির দেয়ালে পেরেক ঠুকে তাকে উপরে উঠতে সাহায্য করে। প্যারোডিকার অনুসৃত মূল কবিতার ছন্দই হল সেই প্যারোডি নামক উচ্ছলতার পেরেক। "প্যারোডি নামক কৌতুক কাব্যে ছন্দ শৈথিল্য মোটেই খাটে না, তাতে হাস্যরসের গভীরতা নষ্ট হয়। কারণ হাস্যরসের প্রধান উপাদান দুটি--অবাধ দ্রুতবেগ ও অভাবনীয়তা।"---বলেছেন রবীন্দ্রনাথ।

আগেই বলেছি রবীন্দ্র পূর্ববর্তী যুগের কাব্য -নির্ভর প্যারোডি রচনার মূলাধার ছিল মাইকেল মধুসূদন দত্তের রচনা সম্ভার। তার 'মেঘনাদবধ কাব্য 'আশ্রয়েই গড়ে উঠেছিল এক সমৃদ্ধ প্যারোডি ভান্ডার। যশোহর জেলার একটি স্কুলের বাংলা শিক্ষক ছিলেন জগদ্বন্ধু ভদ্র, যিনি" ছুচ্ছুন্দরী বধ কাব্য " প্যারোডি রচনা করেছিলেন মধুসূদন দত্তের "মেঘনাদবধ" কাব্যের অনুসরণে। কাব্যটি মাত্র ৭২ লাইনে (প্রথম সর্গ) সমাপ্ত। স্বয়ং মধুসূদন দত্ত এই প্যারোডি পড়ে উক্তি করেছিলেন, "আমার মেঘনাদবধ কাব্য" একদিন হয়তো বাংলা সাহিত্য থেকে বিলুপ্ত হবে কিন্তু "ছুচ্ছুন্দরী বধ" কাব্য চিরকাল অমর হয়ে থাকবে। বাংলা সাহিত্য পন্ডিত ও সমালোচকগণ অনেকেই "ছুচ্ছুন্দরী বধ" কাব্যকে বাংলা সাহিত্যের প্রথম প্যারোডি বলে চিহ্নিত করেছেন। আইনজীবী ও রস ও সাহিত্যিক ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় "পঞ্চানন্দ" ছদ্মনামে "বঙ্গবাসী" সংবাদপত্রে লিখতেন। অজস্র ব্যঙ্গ কবিতাও ছড়া লিখে বিলিতি বাতিকগ্রস্ত বাঙালি বাবুদের অনেক রোগ সারিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এর "ভারত উদ্ধার" বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্যারোডি কাব্য। মেঘনাদ বধ কাব্য এর প্রারম্ভে বাণী বন্দনার অংশের অনুসরণে রচিত এই প্যারোডি--

"গাও মাতঃ সুররমে, বাণী বিধায়িনী,
কমল আসনে বসি, বীণা করি করে,
কেমনে ইংরেজ অরি দুর্দান্ত বাঙ্গালী--
ত্যজিয়া বিলাস ভোগ চাকুরীর মায়া,
টানা পাখা, বাঁধা হুঁকা, তাকিয়ার ঠেস
উৎসৃজি সে মহাব্রতে,সাপটি গুজিয়ো
কাচার অন্তরে নিজ লম্বা ফুলকোচা,
ভারতের নির্বাপিত গৌরব প্রদীপ---
তৈলহীন, সলতে হীন, আভাহীন এবে
জ্বালাইয়া পুনর্বার, উচ্ছলিয়া মহী-----"।
ঔজ্জ্বল্যে অম্লান, স্বাদে নতুনত্বে ভরপুর রঙ্গ-ব্যাঙ্গ প্যারোডি রচনায় সুখ্যাত ব্যক্তিত্ব সরিৎ শেখর মজুমদার। Pun figure of speech এ তিনি ওস্তাদ শিল্পী। স্বতন্ত্র রীতিতে তিনি pun ব্যবহার করেছেন। শিবরাম চক্রবর্তীর প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে ও প্রচলিত পথ ও পদ্ধতিকে পরিহার করে আপন গরিমা বজায় রেখেছেন। উদাহরণ:-

১.খেলবি যখন Rugby
খবরদার রাগবি না

২. ডাক্তারের বিধান এল
Oil নয়    boil খান----
অবাক রোগী, কেমন কথা
Oil b-না, boil পান?

৩. আমাদের হিংসা-দ্বেষ
যার যত বেশি
তাদেরই আদর করে
বলি প্রতিবেশী।

রবীন্দ্রনাথের 'কণিকা' অনুসরণে একটি চতুষ্পদীর উদাহরণ:----

চিত্র অভিনেত্রী কহে গৃহকর্ত্রী ভাই
আছিনু হেঁসেল লয়ে সমান সবাই।
পুরুষ নাচালো আনি সিনেমার রুচি, হলাম 'তারকা' আমি তুই হোলি বুঁচি।

সরিৎ শেখর মজুমদার এর ব্যঙ্গ রস -সিক্ত প্যারোডি গুলি শুধু হাস্যরস নয়, অশুভ অমঙ্গল অবস্থার দিকে ধারালো ব্যঙ্গের কুঠার নিক্ষেপ করেছেন।
দৃষ্টান্ত স্বরূপ হে মোর চিত্ত পুণ্য তীর্থে কবিতার প্যারোডিটি লক্ষ করলে বোঝা যাবে:-

"হে মোর চিত্ত, ক্ষুন্নিবৃত্তে জাগোরে ধীরে---
স্বাধীনোত্তর এই ভারতের হা ঘরে-তীরে।
হেথায় দাড়ায়ে দুবাহু বাড়ায়ে নমি অপদেবতা রে--
উদার ছন্দে পরমানন্দে বন্দন করি তারে।
গ্যাঁড়া গম্ভীর এই যে ভূধর
ঘুষ জপমালা ধৃত প্রান্তর
হের গো নিত্য অপবিত্র ধরিত্রীরে
স্বাধীনোত্তর মহা দানবের  হাঘর তীরে।
কেহ নাহি জানি কার আহবানে কত যে ঘুষের ধারা
দুর্বার স্রোতে এল কোথা হতে শত পকেটেতে হারা
হেথায় কার্য হেথা অকার্য বলবান ক্ষীণ
ঠগ খুনি দল পাঁঠা ও ছাগল এক দেহে হল লীন-------"। (মূল রচনা:-রবি ঠাকুরের "হে মোর চিত্ত" অনুসরণে প্যারোডি "ঘুষ ভারতী"র কিছু অংশ)

অথবা:--
এখন আর দেরি নয়, ধর গো তোরা
হাতে ধামা ধর গো
আজ, কাজ গুছিয়ে ফিরতে হবে, সামনে নেতৃবর্গ।
ওরে ওই উঠেছে শঙ্খ বেজে
পাইয়ে দেওয়ার মন্দিরে যে
লগ্ন বয়ে যায় পাছে ভাই--
তুলে ধর তৈলের অর্ঘ্য। (মূল রচনা রবীন্দ্রনাথের "এখন আর দেরি নয়" অনুসরণে)।

অথবা
"ওগো মা
ভোটের দালাল চলি গেল মোর
ঘরের সমুখ পথে
প্রতিশ্রুতির ফুল কি ঝরিল
মাইক শিখর রথে।" (মূল রচনা রবীন্দ্রনাথের "ওগো মা। রাজার দুলালী চলি গেল মোর ঘরের" অনুসরণে)

বাংলা সাহিত্যে প্যারোডির ইতিহাসে সে যুগে ব্যতিক্রমী একমাত্র প্রতিভাময়ী মহিলা প্যারোডিকার হাসিরাশি দেবী। তীব্র ব্যঙ্গের শ্লেষ তার লেখনীতে কিছু কম ছিল না।
রবীন্দ্রনাথের "এসো নীপবনে, ছায়াবিথী তলে" গানটির প্যারোডি করলেন, এইরকম:--

এসো, এ বিধান- মহা -সভা -তলে,
হও মনোনীত ছলে বলে।
দাও সবজনে দেখা সবিশেষ!
পরো তাড়াতাড়ি ভোট ভিখ বেশ!
কুটিল নয়নে দেখুক গে খলে
এসো এ বিধান মহা সভা তলে।

উপরোক্ত প্যারোডির চিত্রকল্প আজও সামাজিক পটভূমিকায় বাস্তব চিত্র নয় কি? আজ ও সমান‌ প্রাসঙ্গিক নয় কি? (ক্রমশঃ)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours