প্রশান্ত সেন, ফিচার রাইটার, নয়াদিল্লি:

'হ্যানামাসি-ই-ই -ই ----?' বলে ট্যারা চোখে গুবগুবে গাল নিয়ে হাসতে হাসতে  উপস্থিত হয় ছোট্ট 'কাজল' তার মেজদিদার দুয়ারে, সঙ্গে ভাই বোন চঞ্চল ও ঘেঁটু। পৌষ সংক্রান্তির সূর্য ওঠার আগেই ওরা এক ঝলক পাড়ার কটা ঘরে বাঁধনছেঁড়া-ঘোরা ঘুরে নেয় শীতের সকালে ঠান্ডার তোয়াক্কা না করে।
সুদূর রানীগঞ্জ থেকে 'কাজল'রা মামাবাড়ি বেড়াতে আসে শীতের ছুটিতে প্রায় প্রতি বছর, আর হেনামাসি তার খুব প্রিয়।তাই কাজলকে পেয়ে হেনামাসিও  বেশ আনন্দে গদগদ পিঠে সংক্রান্তিতে পিঠে ভাগ করে খেতে।
'ও---- মা, কাজল, এসো  মা আমার, বোসো সবাই বোসো' ---মেজদিদা মামাবাড়ি-আদরের সবটুকু উজাড় করে দিযে আপ্পায়ন করে বাচ্ছাগুলোকে। এ বাড়িতে ওদের ডবল আনন্দ ---এটা ওদের মায়ের মামাবাড়ি, আর ওদেরও মামা-মাসিদের বাড়ি।

'দিদাও বানাচ্ছে, রাঙাদিদা, ছোটদিদাদের ঘরেও বসিয়েছে' ----- স্পষ্ট-অস্পষ্ট অনর্গল বকবক করা কাজল খবর দেয়।

 ওদিকে  থালা বাটিতে খেজুর গুড় ও গরম পিঠে ধরিয়ে দেয় হেনামাসি মায়ের নির্দেশে। এখন খাওয়া, পাড়ার আরও সবাইকে এক এক করে ডেকে নিয়ে এসে চলতে থাকে খাওয়ানো, পরে নিজেরাই গুনে ঘোষণা করবে  কে কতগুলো পিঠে খেলো। বেলা বাড়লে যে যার গন্ডা-পণএর হিসাব জাহির করবে হাটতলার হট্টগোলে।

ইতিমধ্যে প্রায় চার ঝুলি পিঠে নেমে গেছে মেজদিদার। সিদ্ধ পিঠে --দু রকমের--নারকোলের পুর আর চাঁচির পুর দেওয়া। সাথে আছে খেজুরগুর দিয়ে ক্ষীরপিঠে। বাচ্ছাদের দিয়ে  পিঠে খাওয়ার শুরু হয় একরকম ভোর থেকে।  আগেপিছে  পিঠে বানানোর হুড়োহুড়ি প্রায় প্রত্যেক ঘরে ঘরে পাড়ায়। যেন একটা কম্পেটিশন, আর তা কেন এতো সকাল থেকে শুরু হয় খাওয়া ও খাওযানো বুঝতাম না, আজও বুঝি না।  আর কী-ই বা দরকার বোঝার, আমার তো পিঠে খাওয়া নিয়ে কথা।

তাই আর একবার পিঠের আস্বাদে  পাল্টি খেয়ে যাই সাড়ে-পাঁচ দশকেরও বেশি পিছনে (একঘেয়ে  ক্যা ক্যা আর জে জে জে-র নিউজ ঝেড়ে)।

তখন কাজল'দেরও আসা যাওয়া শুরু হয়নি। সেনবংশের ঐতিহাসিক চার-কুঠুরি মাটির একচালা প্রাসাদ। আর তারই পুবদিকে নিচের ঘরটাকে আমরা মাঝের ঘর বলে জেনে এসেছি।প্রায় মাঝরাত অবধি সংসারের সব কাজ মিটিয়ে মাঝের ঘরের মেঝেয় তাল ও খেজুর পাতার চাটাই-এর ওপর তোশক পেতে দিয়ে বিছানা করে মা শুয়ে দিতো আমাদিকে।  ভোর বেলায় পিঠে খেতে উঠতে হবে, মনে এই আনন্দ নিয়ে শালুর লেপের তলায় কখন ঘুমিয়ে পড়তাম কে জানে । কাকভোরে ঘুম ভাঙতো মায়ের টুংটাং  আওয়াজে । বাইরে কনকনে ঠান্ডা। ততক্ষনে বাইরে তোলা উনুনে আঁচ গনগনে করে নিয়ে মাঝের ঘরের ভেতরে ঢুকিয়ে নিয়েছে মা । উনুনে অ্যালুমিনিয়াম এর হাঁড়িতে জল গরম হয়ে চলেছে।  হাঁড়ির ঢাকায় পিরামিডএর  মতন পিঠে সাজিয়ে কাপড় দিয়ে ঢেকে দিয়ে ঝুলিয়ে দিতো হাঁড়ির মুখে। ভাপে সিদ্ধ হবার অদ্ভুত সময়-আন্দাজে পিঠের পিরামিডের ঝুঁটি ধরে তুলে নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে চুবিয়ে দিতো পাশেই রাখা ডেকচির ঠান্ডা জলে। গড়ে চলতো মা পিঠে, মানা সত্ত্বেও আমরা মায়ের সাথে কাঁচা হাতের কেরামতি দেখাতে গড়তে লেগে যেতাম পুতুল গড়তে।  আর একটু ঠান্ডা হতে না হতে শুরু হয়ে যেত 'আমাকে চাঁচির, আমাকে নারকোলের টা দাও' বলে।
পিঠেপরবের  সাদামাটা গ্রামীণ আনন্দের নেপথ্যে  যার ও যাদের নিস্কলুষ অবদান, যাদের নিরলস পরিশ্রমে পৌষের পিঠে সংক্রান্তি হয়ে উঠতো সার্থক, তাদের কথা আজ বেশি করে ভেসে আসে। তাদেরই  একজন হলো 'কল্যাণীদি'। 'সাঙাৎমা' আমাদের পরিবারের অবিচ্ছেদ্য ধাত্রী পান্না, মায়ের হোলটাইমের  সাহায্যকারী ছিল বটে, কিন্তু কল্যাণীদির সাহচর্য আমাদের শিশুমনকে বেশি করে টানতো। ছিল সে একমাত্র সন্তান।শুনেছিলাম ছোটবেলায় তার মা-বাবাকে হারিয়েছিল। আর নেহাত অল্প বয়েসে বিয়ে দিয়েছিলো তার খুড়তুতো-জাড়তুতো  ভাইয়েরা।তাও আবার টেকেনি।স্বামী পরিত্যাক্ত হয়ে ফিরে  এসেছিলো জীবনের মুখ্য সময়ে বাপ্-ভাইদের ভিটেয়। কিন্তু তারাও তাকে কেন বসে খাওয়াবে ? তাই সে বেছে নিয়েছিল সেন পাড়ার পাঁচটা ঘরকে নিজের বাপের ঘরের মতন। আর নেবেই না কেন, পাড়ার এমন কোনো কেউ নেই যে তাকে ভালো বাসতো না । পিসি, জ্যাঠাইমা, কাকিমা আর আমাদের মা সবাই কল্যাণীর জন্য থাকতো কমবেশি উৎকণ্ঠিত।  কোনো এক কালে  'সয়লা' উৎসবে কল্যাণীদি আমাদের দিদিকে সই পাতিয়ে ছিল--- তাই সে মা-কে 'সই-মা' বলে ডাকতো। অদ্ভুতভাবে মায়েরও নাম 'কল্যাণী'। তাই কোথায় যেন একটা মা-মেয়ের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। আর কল্যাণীদি ছিল আমাদের অনেক কাছের--কারণ সে ছিল আমাদের ঘুম পাড়ানো গল্প-কথিকা, রাতের ভূত-ভয় কাটানোর পাহারাদার।

'ও কল্যাণীদি, তুমি 'তোসোলা' (টুসু পুজো) করবে না?'
'হ্যাঁ, করবো বৈকি, যাই জ্যাঠাইমার ঘরে কাজ আছে'---হাঁসি মুখে মুখ ঘুরিয়ে নেয় আর  তটস্থ হয়ে উধাও হয়ে যায় এবাড়ি থেকে ওবাড়ি।

তখন না ছিল কোনো গাড়ি ঘোড়া, না ইলেক্ট্রিকের আলো অথবা রেডিও, টিভি, ফোন মোবাইলের দাপাদাপি। কল্যাণীদি ছিল আমাদের শিশুমন বিনোদনের মাধ্যম। সূর্য ডোবার সাথে পৌষের শিশিরপড়া  সন্ধ্যা যখন ধীরে ধীরে নিঝুম হয়ে আসতো, ঘরে ঘরে জ্বলে উঠতো হারিকেন লণ্ঠন আর লম্ফোর টিমটিম আলো,  ভেসে আসতো কানে টুসু গাওয়ার সুরেলা কোরাস গ্রামটাকে চারিদিকে ঘিরে রাখা উপজাতি পাড়া গুলো থেকে। কল্যাণীদিও বসতো তার তোসোলা সাজিয়ে আমাদের উঠোনের তুলসী তলায়। একটা মাটির সরা। তাতে থাকতো মাটি ও ধান ছড়ানো, গাঁদা ফুল, সর্ষে ফুল, মূলো ফুল আরো কতরকমের বুনোফুলে ঢাকা। আমরা উঠোনে হাত গেড়ে গোল হয়ে বসতাম তার তুসুগান শুনবো বলে। মুচকি হেসে শুরু করতো, প্রথমে বিড়বিড় করে আমাদের-অবোধ্য মন্ত্র পড়ার মতন উচ্চারণ দিয়ে:
"আম কাঁঠালের পিঁড়ে খানি মা ঘি মৌ মৌ করে
তাতে বসে রাই ঠাকরুন কন্যা দান করে ।
কন্যা দেন করতে করতে------" ইত্যাদি ইত্যাদি।
কয়েক মিনিটের পুরো পাঁচালি আওড়ানো শেষ করার সাথে সাথে শুরু করতো গলা ছেড়ে গান ----'টুসুমনি গণগনানি ভাঙা ঘরে থাকে না -------", যাতে তার গানের আওয়াজ ভেসে আসা আওয়াজগুলোকে ছাপিয়ে যায়। এরকম করেই পৌষের সবকটা সন্ধে কাটিয়ে সংক্রান্তির সকালে বিদায়ীমনে সরা হাতে যেতো টুসু ভাসাতে ঈশান-দীঘির জলে। চাদরমুড়ি দিয়ে আমরাও যেতাম পিছু পিছু দেখতে কেমন করে দীঘির স্থির বরফ জলে ডুব দিয়ে এসে খড়ের আঁঠি জ্বেলে গরম সেকতো ভাসানীরা।
পৌষের একরকম  প্রথম  থেকেই শুরু হয়ে যেত পিঠে-পার্বনের জোগাড়।  জোগাড় আর কি, চালগুঁড়ি বানানো।আমাদের বাড়ির মধ্যেই পুব দিকে পাঁচিল ঘেঁষে ছিল আমাদের একটা ঢেঁকিচালা । আর সেই ঢেঁকিচালা প্রায় প্রত্যেকদিন বুক হয়ে থাকতো। ঘন্টার পর ঘন্টা ঢেঁকিতে পাড় দেবার মতন আর কে থাকবে ?-- -কল্যাণীদি । ঢেঁকিচালার এককোনে একটা কাঠের জ্বালের উনুন ছিল। সেখানে সারাদিন কিছু না কিছু রান্নার পর চারিদিকটা গরম থাকতো।আমরা সবাই সেই উনুন ঘিরে চাদর মুড়ি দিয়ে বসে থাকতুম।

"আজকে তুমি সুকু-দুকুর গল্পটা বলবে না, 'সোনার আতা' গল্পটা বলবে"।
'আচ্ছা ঠিক আছে'- কল্যাণীদি দোক্তামুখে  মুচকে  হেঁসে ঢেঁকিতে পাড় দিতে ওঠে, আর শুরু হয় 'এক ছিল রাজকন্যা---'

'পা চালা মা, এখনো এক সোলি চাল বাকি আছে' --ওদিকে ঢেঁকির গড়ে জ্যাঠাইমা, অথবা কাকিমা, অথবা মা, মানে যাদের যেদিন চাল কোটা হয় --- গুঁড়ি চালুনি চালাতে চালাতে বলতে থাকে।

এদিকে কল্যাণীদির পাড়ের তালের সাথে সাথে চলতে থাকে তার রূপকথার কথামালা । কি দারুন ছিল তার গল্পের ভান্ডার। কোথায়, কেমন করে কার কাছে এতো গল্প যে তার মাথায় গেঁথে ছিল কে জানে। তার গল্পের হাতীশালের হাতি, ঘোড়াশালের ঘোড়া নিয়ে  রাজকুমার যখন তার পক্ষীরাজ ঘরে করে আকাশপথে উড়ে যায় রাজকুমারীর উদ্ধারে, তখন তার শ্রোতারাও একে একে ঢুলতে ঢুলতে চলে যায় আপন আপন স্বপ্নের জগতে।

'তুই এবার মুখটা বন্দো কর কল্যাণী, সব কটা ঢুলছে।'
'মুচকি হেঁসে সে এবার তার মুখকে বিরাম দিয়ে বলে 'আমার কথাটি ফুরুলো, নোটে গাছটি মুরুলো।
আর ততক্ষনে প্রায় এক চাঙারি চালগুঁড়িও তৈরী ।

নিখাদ কল্যাণীদিরা আসে আর চলে যায় নিঃস্বার্থ যোগদান দিয়ে। সময়ের চাকা এগোতে থাকে আর যুগ  হয়ে যায় ফেলে আসা কত ভালো মন্দ উদযাপন। চলে গেছে আজ অনেকে যারা কল্যাণীদির মতো শৈশবের স্মৃতি জড়িয়ে ছিল আমার (কোলে)পিঠেবেলায়। তাই পিঠেপরবের ছুতো নিয়ে একটু স্মৃতির শীষকুড়ানো কেবলমাত্র।

আবার পাল্টি সিধা করে সবাইকে জানাই 'হ্যাপি মকর সংক্রান্তি' ---তা একটু দেরিতে হলেও।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours