দেবর্ষি মজুমদার, লেখক, বীরভূম:

পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত হলেন এক টাকার ডাক্তার।
শনিবার (২৫ জানুয়ারী'২০) রাত্রে ভারত সরকারের তরফে এই সংবাদ জানানো হয়। প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় প্রতিবেদককে সুশোভন বন্দোপাধ্যায় বলেন, আমি এতটা আশা কোনদিন করিনি।  আজকেই ডায়ালাইসিস হয়েছে। শুয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ সরকারের তরফ থেকে পদ্মশ্রী প্রাপ্তির খবর দিয়ে আমাকে  ধন্যবাদ জানানো হলো। তারপর প্রণববাবু (প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়) আমাকে জানালেন। আমি অভিভূত, আর কি বলবো। তিনি আরও বলেন, ৫৬ বছর ধরে ১ টাকায় রুগী দেখেছি। এই তো করেছি।

বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে বলা হয়, বিশ্বভারতী চিকিৎসক সুশোভন বন্দোপাধ্যায়ের জন্য গর্বিত। তিনি বিশ্বভারতীর একজন শুভাকাঙ্ক্ষী এবং এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের সদস্য।

 চিকিৎসক কে? একজন  বিপন্ন মানুষের হাত যিনি ধরেন। তিনি চিকিৎসক।  চিকিৎসকের ক্ষেত্রে সেই হাত ছাড়ানো যায় না”। এই ছিল তাঁর সারাজীবনের আদর্শ।   তিনি একজন ‘এক টাকার ডাক্তার’।  নাম ডঃ সুশোভন বন্দ্যোপাধ্যায়। বাড়ি বোলপুরের হরগৌরীতলায়। যখন রাজ্যের সমস্ত সরকারী হাসপাতালে পরিষেবা আন্দোলনে বন্ধ ছিল। তখন গ্রামের গরিব গুর্বো মানুষগুলোর স্বাচ্ছন্দ্য যাতায়াত ছিল হরগৌরিতলায় হলুদ রঙের  দোতলা বাড়িটিতে। সব সময় দেখা যায় অগুনিত মানুষের ভিড়।  রুগীদের কাছে তাঁর পরিচয়,   সব দরজা বন্ধ থাকলেও ভগবানের দরজা বন্ধ থাকে না। তাই আমার মত অনেকেই এখানে চিকিৎসা পায়।
 কিন্তু ‘এক টাকা’ কেন? যেখানে বাসে উঠলেই ১০ টাকা! তার উত্তরে তিনি বলেন,  একসময় দেখেন গরীব মানুষেরা গামছা পেতে মুড়ি খাচ্ছে। তখন মনে হয়েছিল এই মানুষদের কাছে ১ টাকার বেশী নেওয়া যায় না। 
 চিকিৎসকের উপর আক্রমণে প্রতিবাদ জানাতে সহকর্মীদের সাথে মিছিলে হেঁটেছেন। আবার চিকিৎসাও চালিয়েছেন সমানে।  তিনি বলেছেন, বহু আশায় চিকিৎসকের হাত ধরেন বিপন্ন মানুষ। তাই প্রতিবাদের মাধ্যম পরিষেবা বন্ধ করে নয়। পাশাপাশি এটাও বুঝতে হবে। একজন চিকিৎসক চেষ্টা করে রোগীকে বাঁচাতে। কোন সময় পারেন। আবার কোন সময় পারেন না। সেক্ষেত্রে চিকিৎসকের গায়ে হাত তোলা গর্হিত কাজ। আমাদের শিক্ষিত হতে হবে।
বোলপুরে সুশোভনবাবুর তিনপুরুষের বাস। বাবা বিনয় কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ওয়েস্ট বেঙ্গল ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ অফিসে কর্মরত ছিলেন। মা মণিবালা বন্দ্যোপাধ্যায় গৃহবধূ। স্ত্রী গৃহবধূ ছায়া বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিজের ঘরকন্না নিয়েই ব্যস্ত থাকতে হত। মেয়ে জামাই দুজনেই চিকিৎসক। অনায়াসেই আয়াসে জীবন কাটাতে পারতেন। কালের নিয়মে প্রিয়জনদের অনেকে এক করে তাঁকে ছেড়ে গেছেন। কিন্তু, না!  আজ রুগীই সুশোভনবাবুর একমাত্র পরিবার। তাঁদের জন্য তিনি অপেক্ষায় থাকেন।  ১৯৬২ সালে সুশোভনবাবু এম বি বি এস পাশ করেন। ১৯৬৯ সালে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি এস সি ( গোল্ড মেডালিস্ট)। তাঁর বিষয় ছিল হেমাটোলজি। তিনি ছিলেন শেফিল্ডের সিনিওর রেজিস্ট্রার এবং সিনিওর ইনচার্জ। তখন তাঁর বার্ষিক বেতন ছিল ষোলো হাজার পাউণ্ড। আজ চল্লিশ বছরের বেশী সময় ধরে এক টাকার ডাক্তার। ১৯৭৮ সালে শেফিল্ড থেকে চাকরী ছেড়ে বিশ্বভারতীতে যোগদান করেন ডেপুটি চিফ মেডিক্যাল অফিসার হিসেবে। সেটাও এক সময় ছেড়ে দিয়ে গ্রামের অসহায় মানুষের জন্য চেম্বার খুলে বসেন। ছোট্ট একটা সেবা নিকেতন। তাতেই চলে দান খয়রাত। রাজনীতিতে আসেন প্রণব মুখোপাধ্যায়ের অনুরোধে। তিন থেকে চার বার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। ১৯৮৩ সালে জয়ী হন। একসময়ে জাতীয় কংগ্রেসের  জেলা সম্পাদক ও সভাপতি হন। এআইসিসির সদস্যও হন। ১৯৮৩ সালে জ্ঞানী জৈল সিং, তারপর ক্রমান্বয়ে, ইন্দিরা গান্ধী, রাজীব গান্ধী, প্রতিভা পাটিল, প্রনব মুখোপাধ্যায় এবং বর্তমানে  রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের প্রতিনিধি হিসেবে বিশ্বভারতীতে দায়িত্বের সাথে কার্যভার সামলান।  ১৯৯৮ সালে ইস্ট ওয়েস্ট ফ্রেন্ডশিপ সোসাইটি ২৫জনকে বেস্ট সিটিজেন এওয়ার্ড দেয়। তার মধ্যে তিনি ছিলেন একজন। এমন একজন সুনাগরিকের জীবন দর্শন আব্রাহাম লিঙ্কনের এক বিশেষ উক্তিঃ এই জগত অনেক কষ্ট পায়। খারাপ লোকেদের হিংসার জন্য নয়। কিন্তু ভালো মানুষের নিরবতার জন্যই।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours