রিয়া ভট্টাচার্য, লেখিকা, খড়্গপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর:

অন্ধকার ঘরের ভেতর পাতা একখানি তেপায়া টেবিল, আয়তনে গোল৷ তার চারদিক ঘিরে বসে আছেন কিছু মানুষ, তর্জনি দিয়ে ছুঁয়ে আছেন টেবিলের মধ্যবিন্দু। ঘরে টিমটিম করে জ্বলছে মোমবাতি, এক আলো আঁধারি রহস্যছায়া খেলা করছে প্রেতজগৎ ও মানুষের মাঝে সংযোগরক্ষাকারী সেতু অর্থাৎ মিডিয়াম হিসাবে অবতীর্ণ হওয়া অল্পবয়সী মেয়েটির চোখেমুখে। উপস্থিত সকলেই একমনে স্মরণ করছেন এক নিকটাত্মীয়ের আত্মাকে, সামনে রাখা কাগজ কলম।

আচমকাই থরথর করে কেঁপে উঠল টেবিলখানায়, শব্দ উঠল খট খট খট। উপস্থিত সকলের পিলে চমকে গেলেও জোর করে মনে সাহস এনে আঙুল ছুঁইয়ে রাখলেন টেবিলে। শুধুমাত্র ভয় পেলেন না একজন প্রাজ্ঞ ব্যক্তি, অস্বাভাবিক শক্ত মুখের মিডিয়ামের দিকে চেয়ে করতে লাগলেন প্রশ্নের পর প্রশ্ন, খসখস শব্দে ভরে উঠতে লাগল কাগজের পাতা। একসময় মিডিয়াম মেয়েটি হেলে পড়ল টেবিলের ওপর, বন্ধ হল টেবিলের নাচানাচি। প্রেত আবাহনী ক্রিয়া সম্পূর্ণ হল।

ওপরের ঘটনাটি একটি দৃশ্যরূপ দেওয়ার প্রচেষ্টা মাত্র, তবে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে প্ল্যানচেট বা প্রেত আবাহন বড্ড নিয়মিত ঘটনা ছিল৷ কৈশোর থেকেই বিশ্বকবি এরসঙ্গে পরিচিত ছিলেন। তাঁর নতুনদাদা বাড়িতে নিয়মিত প্রেতচর্চার আসর বসাতেন। তাতে কবির সক্রিয় অংশগ্রহণ  থাকলেও তিনি প্ল্যানচেট বা প্রেতচর্চায় চরম উৎসাহী হয়ে পড়েন প্রৌঢ়ত্বের সোপানে অবনীত হওয়ার পর। মনে করা হয় একের পর এক প্রিয়জনের মৃত্যুশোক তাঁকে আগ্রহী করে তুলেছিল এ বিষয়ে।
শান্তিনিকেতনে বসত এই প্রেতচর্চার আসর, সঙ্গী হতেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নন্দলাল বসু, মীরা দেবী প্রমুখ। মিডিয়াম হিসাবে থাকতেন কবিবন্ধু মোহিতচন্দ্র সেনের কন্যা উমাদেবী, যার ডাকনাম ছিল বুলা। এই কন্যার প্রেত আবাহনীর এক আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল৷ তার ডাকে সাড়া দিয়ে এসেছিলেন কবির জ্যেষ্ঠা কন্যা মাধুরীলতা, স্ত্রী মৃণালিনী, নতুন দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, ভ্রাতুষ্পুত্র বলেন্দ্রনাথ, সুকুমার রায়, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, অজিত চক্রবর্তী প্রমুখ৷ নামে বেনামে বারবার উপস্থিত হয়েছেন বৌঠান কাদম্বরী, হেঁয়ালি মিশিয়ে তুলে ধরেছেন আপন পরিচয়।

সুকুমার রায়ের আত্মা চেয়েছেন পুত্র সত্যজিৎ রায়কে শান্তিনিকেতনে ভর্তি করতে, সেই মর্মে অনুরোধও জানিয়েছিলেন বিশ্বকবিকে। কিন্তু সত্যজিৎ রায় শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন বড়ো হওয়ার পরে। বারবার আহ্বান করা সত্ত্বেও কবির প্রেতচক্রে যারা আসেননি তাঁরা হলেন পিতা দেবেন্দ্রনাথ, মাতা সারদা দেবী, মেজমেয়ে রেণুকা, বড়দা দ্বিজেন্দ্রনাথ।

প্ল্যানচেটে আহ্বায়িত আত্মাদের কাছে মূলত তিনটি প্রশ্ন করতেন বিশ্বকবি। তা হল, ১) তাঁদের ধর্মবিশ্বাসে পরিবর্তন হয়েছে কিনা, ২) পরলোকে সম্ভোগবাসনার স্বরূপ কি এবং ৩) নূতন জন্ম নিতে ইচ্ছে হয় কিনা।

পরলোকগত আত্মাদের নানা প্রশ্নোত্তরে ভরে উঠেছে খাতার পাতা, যা লিপিবদ্ধ করেছেন অমিয়চন্দ্র চক্রবর্তী ও মোহনলাল গঙ্গোপাধ্যায়। বিশ্বকবির আত্মা আবাহনী বা প্ল্যানচেটে শুধুমাত্র যে পরিচিতরাই এসেছিলেন তা নয়, অনেক অপরিচিত আত্মাও এসেছিলেন যাঁরা নাম বলতে সম্মত হননি৷

মৈত্রেয়ী দেবীকে লেখা চিঠিতে তাঁর এবং কাদম্বরী দেবীর কথোপকথনের অংশবিশেষ বর্ণনা করেছিলেন বিশ্বকবি৷ তাতে ফুটে উঠেছিল আত্মার নিগূঢ় অভিমান ও আপনজনবর্জিত পরিবেশে কষ্টের কথা৷ তিনি অনেকবারই এসেছিলেন কবির আহ্বায়িত প্রেতচক্রে৷

তবে বারবার বিভিন্ন আত্মাকে আহ্বানের কুফল ফলতে দেরী হয়নি৷ একবছরের মধ্যে মাত্র তিনদিনের জ্বরে সাতাশ বছর বয়সে প্রাণ হারিয়েছিলেন মিডিয়াম বুলাদেবী৷ ওনার মৃত্যুর পরেই বন্ধ হয়ে যায় কবির প্রেতচর্চা৷ শুধু একদা স্মৃতি হয়ে রয়ে যায় তেপায়া টেবিলখানি ও আত্মাদের কথোপকথন লিপিবদ্ধ করা সাতখানি খাতা। তেপায়া টেবিলখানি নাকি মাঝেমধ্যেই খটখট শব্দে চলাফেরা করে বেড়াত বদ্ধ ঘরে, শুধু কবির দ্বারা আহ্বায়িত হতেন না আর কোনো প্রেতাত্মা।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours