সন্দীপ চক্রবর্তী, প্রবীণ সাংবাদিক, কলকাতা:

ব্যাপারটা বেশ হাস্যকর হয়ে উঠেছে। কেন্দ্রীয় সরকার এখনও পর্যন্ত কারও কাছে নাগরিকত্বের প্রমাণ সম্পর্কিত কোনও কাগজপত্র চায়নি, তবুও পশ্চিমবঙ্গের কয়েকজন বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী বলছেন, আমরা কাগজ দেখাব না। মানতেই হবে ‘আমরা কাগজ দেখাব না’ ক্যাম্পেনের ভিডিওটি প্রযুক্তিগত দিক থেকে অসাধারণ হয়েছে কিন্তু দাবিটি থেকে গেছে বিভ্রান্তিমূলক। এই প্রসঙ্গে সিএএ এবং এনআরসি সংক্রান্ত কয়েকটি মৌলিক প্রশ্ন নিয়ে আমরা আলোচনা করতে পারি।
 প্রথম প্রশ্নঃ এনআরসি কি সিএএ-র একটা অংশ? উত্তর, না। সিএএ নাগরিকত্ব অর্জনের উপযোগী একটি আইন আর এনআরসি নাগরিক পঞ্জিতে নাম নথিভুক্ত করার একটি প্রক্রিয়া। সংসদের উভয় কক্ষে পাশ হওয়ার পর সিএএ সারা দেশে কার্যকরী হয়েছে। অন্যদিকে এনআরসি সারা দেশে করা হবে কিনা বা করা হলেও কীভাবে করা হবে সেই ব্যাপারে সরকার এখনও কোনও সিদ্ধান্ত নেয়নি। অসমে এনআরসি-র কাজ চলছে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে। এ ব্যাপারে কেন্দ্র বা রাজ্য সরকারের কোনও হাত নেই। ১৯৮৪ সালে রাজীব গান্ধীর কংগ্রেস সরকার এবং অসম স্টুডেন্ট ইউনিয়নের মধ্যে একটি চুক্তি হয়। অসমে এনআরসি এই চুক্তিরই অঙ্গ।
 দ্বিতীয় প্রশ্নঃ এনআরসি এবং সিএএ-র জন্য ভারতীয় মুসলমানদের ভবিষ্যত কি বিপন্ন? উত্তর, না। যিনি যে ধর্মই পালন করুন, এনআরসি এবং সিএএ  নিয়ে কোনও ভারতীয় নাগরিকের অযথা আতঙ্কিত হবার কোনও কারণ নেই।
 তৃতীয় প্রশ্নঃ এনআরসি কি কোনও বিশেষ ধর্মের মানুষের দিকে তাকিয়ে করা হচ্ছে? উত্তর, না। এনআরসি-র সঙ্গে ধর্মের কোনও সম্পর্ক নেই। এটি প্রত্যেক ভারতীয়ের জন্য। বস্তুত, এই নাগরিক পঞ্জিতে সমস্ত ভারতীয় নাগরিকের নাম নথিভুক্ত করা হবে। বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশের নিজস্ব নাগরিক পঞ্জি রয়েছে। আফগানিস্তান পাকিস্তান এবং বাংলাদেশেও নাগরিক পঞ্জিকরণ করা হয়েছে।
 চতুর্থ প্রশ্নঃ ধর্মীয় কারণে কি কাউকে এনআরসি থেকে বাদ দেওয়া যেতে পারে? উত্তর, না। আগেই বলা হয়েছে এর সঙ্গে ধর্মের কোনও সম্পর্ক নেই। এনআরসি ধর্মের ভিত্তিতে করা যায়ও না। সুতরাং একজন নাগরিকের ধর্ম যাই হোক, এনআরসি থেকে তার বাদ পড়ার প্রশ্ন ওঠে না।
 পঞ্চম প্রশ্নঃ এনআরসি করা হলে আমরা যে ভারতীয় নাগরিক তার কি কোনও প্রমাণ দিতে হবে? এই প্রশ্নটি বহু মানুষের। এক শ্রেণীর রাজনৈতিক নেতা এই প্রশ্নের উত্তর দেবার অছিলায় ভুল বোঝানোর চেষ্টা করছেন। সুতরাং প্রকৃত সত্যটি জেনে নেওয়া খুবই দরকার। প্রথমেই বলে নেওয়া ভালো, সারা দেশে এনআরসি করা হবে, এরকম কোনও ঘোষণা কেন্দ্রীয় সরকার এখনও পর্যন্ত করেনি। ভবিষ্যতে যদি করা হয়ও, তা হলেও এনআরসি-র জন্য কাউকে ভারতীয় নাগরিকত্বের প্রমাণ দিতে হবে না। এনআরসি একটি খুবই সহজ প্রক্রিয়া। এর উদ্দেশ্য, ভারতের প্রত্যেক নাগরিকের নাম নথিভুক্ত করা। ভোটার তালিকায় নাম নথিভুক্ত করার সময় কিংবা আধার কার্ড করার সময় যেসব নথিপত্র প্রয়োজন হয়, সেইসব নথিপত্রের ভিত্তিতে এনআরসি-ও হবে। আলাদা করে কিছু লাগবে না।
 ষষ্ঠ প্রশ্নঃ নাগরিকত্ব কীভাবে নির্ধারিত হবে? নাগরিকত্বের বিষয়টি কি সম্পূর্ণ কেন্দ্রের এক্তিয়ারে? একজন ব্যক্তির নাগরিকত্ব নির্ধারিত হয় ২০০৯ সালে গৃহীত নাগরিকত্বের নিয়ম অনুযায়ী। এই নিয়ম তৈরি করা হয়েছে নাগরিকত্ব আইন,১৯৫৫-র ভিত্তিতে। পাঠক চাইলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের ওয়েবসাইটে গিয়ে এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করতে পারেন। ভারতীয় নাগরিকত্ব পাওয়ার পাচটি পদ্ধতি রয়েছে। ১) ভারতের মাটিতে জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব, ২) উত্তরাধিকার সূত্রে নাগরিকত্ব অর্থাৎ বাবা-মা ভারতীয় নাগরিক হলে সন্তানও ভারতীয় নাগরিক, ৩) নথিভুক্তিকরণের মাধ্যমে নাগরিকত্ব, ৪) ভারতে নির্দিষ্ট সময় (আগে ছিল ১১ বছর, এখন ৬ বছর) থাকার পর স্বাভাবিকীকরণের (Naturalization) মাধ্যমে নাগরিকত্ব এবং ৫) ভারতীয় সংবিধান এবং আইনব্যবস্থার সঙ্গে একাত্ম (Incorporation) হয়ে ওঠার মাধ্যমে নাগরিকত্ব।
 সপ্তম প্রশ্নঃ আমাদের নাগরিকত্ব প্রমাণ করার জন্য কি বাবা-মা’র জন্মের কাগজপত্র দেখাতে হবে? বুঝতেই পারছেন পাঠক, এটা আর একটি কূট প্রশ্ন। এ ক্ষেত্রেও অনেক রাজনৈতিক নেতা ভুলভাল বোঝাচ্ছেন। উস্কানিমূলক কথাবার্তা বলছেন। এনআরসি-র জন্য আপনার জন্মের দিন, মাস ও বছর এবং কোন শহরে বা গ্রামে আপনার জন্ম হয়েছিল, এইটুকুই যথেষ্ট। প্রশ্ন হল নিজের জন্ম সংক্রান্ত তথ্যও যদি আপনার কাছে না থাকে, তখন আপনি কী করবেন? তখন আপনার বাবা-মা’র জন্ম সংক্রান্ত তথ্য দিলেই চলবে। বাবা-মা’র জন্ম সংক্রান্ত কোনও কাগজ আপনাকে দেখাতে হবে না। শুধু মুখে বলা, ব্যাস। নাগরিকত্ব জন্ম সংক্রান্ত নথিপত্রের ভিত্তিতেই নির্ধারিত হতে পারে। কী কী নথিপত্র লাগবে, সে ব্যাপারে এখনো সরকার কোনও সিদ্ধান্ত নেয়নি। তবে সাধারণভাবে বলা যেতে পারে ভোটার কার্ড, পাসপোর্ট, আধার, ড্রাইভিং লাইসেন্স, বিমার কাগজপত্র, জন্মের প্রমাণপত্র, স্কুল ছাড়ার সার্টিফিকেট, জমি ও বাড়ির দলিল নাগরিকত্বের প্রমাণ হিসেবে গণ্য হওয়া উচিত।
 অষ্টম প্রশ্নঃ আমার পূর্বপুরুষ যদি ১৯৭১ সালের আগে ভারতে এসে থাকে, আমাকে কি তাদের জন্মের প্রমাণপত্র দেখাতে হবে? উত্তর, না। আপনার পূর্বপুরুষ যদি ১৯৭১ সালের গণহত্যার আগে পূর্ববঙ্গ থেকে এসে থাকেন, আপনাকে তার জন্য তাদের জন্মের প্রমাণপত্র দেখাতে হবে না। এই পদ্ধতি শুধুমাত্র অসমের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কারণ এটি অসম চুক্তির অঙ্গ এবং সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশ। ভারতের বাকি অংশে এনআরসি-র প্রক্রিয়া হবে সম্পূর্ণ অন্যরকম। এটি হবে ২০০৩ সালে গৃহীত নাগরিকত্বের নিয়ম অনুযায়ী।
 নবম প্রশ্নঃ নিজের নাগরিক পরিচয় প্রতিষ্ঠা করা যদি এতই সহজ হয় তা হলে অসমে ১৯ লক্ষ মানুষ এনআরসি-তে বাদ পড়লেন কেন? অনুপ্রবেশ অসমে একটি পুরনো সমস্যা। এর আশু সমাধানের দাবিতে অসমে একটি আন্দোলন হয়েছিল। ১৯৮৫ সালে রাজীব গান্ধী সরকার অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করার জন্য আন্দোলনকারী অসম স্টুডেন্ট ইউনিয়নের সঙ্গে একটি চুক্তি করে। সেই চুক্তির অন্যতম প্রধান প্রধান শর্ত ছিল এনআরসি। যার কাট-অফ ডেট ছিল ২৫ মার্চ, ১৯৭১। অর্থাৎ এই তারিখের আগে যারা বাংলাদেশ থেকে এসেছেন ভারত তাদের শরণার্থী হিসেবে স্বীকার করবে এবং আশ্রয় দেবে। পরে যারা এসেছেন তাদের আশ্র্য় দেওয়া হবে না। এই ১৯ লক্ষ মানুষ ওই তারিখের পরে এসেছেন। তবে এদের মধ্যে যারা হিন্দু বৌদ্ধ শিখ জৈন খ্রিস্টান এবং পার্সি ধর্মাবলম্বী তারা মোদী সরকারের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের সুবিধা পাবেন এবং নাগরিকত্বও অর্জন করবেন।
 দশম প্রশ্নঃ গরিব অশিক্ষিত মানুষ যাদের কাছে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নেই, তাদের কী হবে? তাদের ক্ষেত্রে ভারত সরকার সাক্ষ্যদানের মাধ্যমে নাগরিকত্ব প্রমাণের ব্যবস্থা রাখবে। অর্থাৎ, কোনও একজন ভারতীয় নাগরিক তাদের হয়ে সাক্ষ্য দেবেন যে, তারা অত্যাচারিত হয়ে পাকিস্তান আফগানিস্তান বা বাংলাদেশ থেকে এসেছেন। সরকার সেই সাক্ষ্যের ওপর ভিত্তি করে গরিব অশিক্ষিত মানুষটিকে নাগরিকত্ব প্রদান করবে।
 সুতরাং নাগরিক পঞ্জিকরণ এবং নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনে কোনও জটিলতা নেই। বরং জটিলতা রয়েছে ‘আমরা কাগজ দেখাব না’ ক্যাম্পেনের বিশিষ্টজনেদের মনে। তারা মানুষের স্বার্থে নয়, রাজনৈতিক স্বার্থে পথে নেমেছেন। রাজনীতির দাদা-দিদিদের হাত শক্ত করার জন্য সেজেগুজে ক্যামেরার সামনে এসে দাড়িয়েছেন। আমরা বরং তাদের সাজ দেখি, চুলের কাট দেখি---কী বলছেন না শোনাই ভালো।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours