শুভ্রা গুপ্ত, ফিচার রাইটার ও আইনজীবী, বারাসাত, কলকাতা:

ফাঁকি একটা দারুণ জিনিস, তাই না! ফাঁকি দিতে অনেকেরই বেশ ভালো লাগে, বিশেষত রবিবার দিনটায়, কাজে ফাঁকি, পড়ায় ফাঁকি, ফোনে ফাঁকি জাস্ট ফাঁকির ফাটাফাটি। তবুও যেন ফাঁকফোকর গলে দায়িত্ব ফাঁকিটা মারতেই দেয় না, বড্ড পাঁজি।

আমি খুব ফাঁকিবাজ বরাবর, যত কমে কিছু সেরে দেওয়া যায় সেটার কায়দা খুঁজতাম সবসময়। আমাকে এক গুরুজন স্নেহভরে বলেছিলেন "ফাঁকি দিতে নেই, ফাঁকি দিলে নিজেকেও ফাঁকে পড়তে হয় "। কথাটা ঠিক হলেও আমরা কি মানতে পারি সবটা?

আমাদের ছোটবেলায় অনেকজন অর্থাৎ প্রতিটি বিষয়ে আলাদা আলাদা গৃহশিক্ষক রাখার চল ততটা ছিল না। আমার আর আমার দাদার একজন টিচার ছিলেন, বাড়িতে পড়াতে আসতেন, দুই ভাইবোন তার কাছে সায়েন্স গ্রুপ আর ইংলিশ পড়তাম। পড়াশোনায় ভালো তো ছিলামই না তার সঙ্গে আবার ফাঁকিবাজি ফ্রি। কেমন লাগে! স্যার প্রায়ই পরীক্ষা নিতেন, আমি একেকদিন পড়া না করেই পরীক্ষা দিতাম স্যারের সামনে দশমিনিট বই পড়ে। স্যার একদিন রাগ করে মাকে বলেছিলেন "ছেলেরা ফাঁকিবাজ হয় জানি, কিন্তু মেয়েরা এত ফাঁকিবাজ হয় তা আমার জানা ছিল না। যার দশমিনিট পড়লে এতটা হয়, সে ভালো করে পড়লে তো ভালো ফল হতে পারতো। হবে না, হবে না, টেনেটুনে মাধ্যমিকে দুটো দাঁড়ি জুটবে দেখবেন "। দুটো দাঁড়ি মানে সেকেন্ড ডিভিশন, যদিও একটা দাঁড়িই জুটেছিল।

আমার দাদা ছিল আরেক কাঠি উপরে, তার ছিল ওস্তাদের মার শেষ রাতের মত বিগ ফাঁকিবাজির ট্যালেন্ট, একটু ডিফারেন্ট ও ইউনিক। দাদা ভীষণ খেলতে ভালোবাসতো, ফুটবল। আর স্যার আসবে জেনেও সে থাকতো মাঠে। স্যারেরও খেয়ে আর কাজ ছিল না, সারা পাড়া ঘুরে তারপর আমাদের বাড়ি আসতেন। আর মাকে বলে দিতেন বাপ্পা অমুক জায়গায় আছে, ডেকে আনুন। বেচারা দাদা আমার, ফাঁকিবাজির সকল প্রচেষ্টা হত ব্যর্থ।
ফাঁকিবাজি বা চিটিং যে কেবলমাত্র ছোটবেলায় পড়াশোনা করতে গিয়ে আমরা দিয়ে থাকি, তা নয়। লুকিয়ে গল্পের বই পড়া, ফাঁকি দিয়ে খেলতে যাওয়া, বইয়ের আড়ালে ঘুমিয়ে পড়া, এগুলো ছোটবেলার সহজাত কিছু দুষ্টুমি, এগুলো ঠিক ফাঁকিবাজির আওতায় পড়ে না। তাতে কে প্রথম হল বা কে ফেল করল তা আপেক্ষিক। কারণ দেখা যায় অনেকে প্রচুর পড়াশোনা করেও প্রথম হয় না, অথচ কেউ কেউ কেবল পরীক্ষার আগে রাত জেগে পড়ে পাস করে যায়। 

কিন্তু বড় হয়ে জ্ঞান বয়েসে পৌঁছে যারা জ্ঞানত ফাঁকি দেন সেটাই হল আসল ফাঁকি, তাতে তারা নিজেকেও যে ফাঁকি দেন ও ফাঁকের ফাঁদে পড়ে যান সেটা তারা বোঝেন না। যেমন :- শিক্ষক হয়ে শিক্ষার্থীকে ফাঁকি (তাতে বাচ্চারা অজ্ঞানতার স্বীকার), সরকারি কর্মচারী হয়ে কাজে ফাঁকি ( ভাবেন কি হবে, পরের জন এসে করবে), নেতা হয়ে দেশ ও দেশবাসীকে ফাঁকি (প্রতিশ্রুতি না রাখা, কোরাপশন), শ্রমজীবী হয়ে মালিককে ফাঁকি, মালিক হয়ে কর্মচারীকে ফাঁকি, চাষবাসে ফাঁকি, এমনকি যারা ঈশ্বরে বিশ্বাসী তারাও পারলে উপাসনাতেও ফাঁকি দেন ( সবাই নয়, তবে বেশিরভাগই), প্রেমে ফাঁকি এক বিরাট বিষয় (আশেপাশের সবাই তার প্রভাব টের পায়) ইত্যাদি ইত্যাদি।

দেখবেন আমরা বাবা মায়েরা কখনও কখনও ছোট সন্তানের জেদ পূর্ণ করব না বা তার চাহিদা পূর্ণ করব না বলে বিভিন্ন অজুহাত খাঁড়া করি বা সন্তানকে ফাঁকি দিই, সেসময় সন্তান সরলীকৃত থাকে বলে ফাঁকি দেওয়াটা সহজ হয়, কিন্তু তারা বড় হয়ে গেলে বিভিন্নভাবে বাবা মাকেই ফাঁকি দিতে শুরু করে আর ভাবে বাবা মা বোধহয় সেটা বোঝেন না।

সবচেয়ে খারাপ হল বন্ধুকে বন্ধুর বিশ্বাসে ফাঁকি দেওয়া,  পিঠের পিছনে বদনাম করা, জোর করে মিথ্যাচার করা, বিশ্বাসে তুমুল আঘাত করা  এরচেয়ে মিথ্যা ও অন্যায় ফাঁকি ও ঘৃণিত আর কিচ্ছু নেই। ছোটবেলায় সেই রাখালের পালে বাঘ পড়ার গল্প নিশ্চয়ই সবার মনে আছে। রাখাল কিন্তু নিজের ভুলেই অন্যকে ফাঁকি দিতে গিয়ে নিজে ফাঁদে পড়ে। একবার তো বেঁচে গেল, কিন্তু বারবার ভুল করলে...?

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours