আনন্দিতা রায়, লেখিকা ও সঙ্গীতশিল্পী, দুর্গাপুর:

নগেন আইচ বলে এক ভদ্রলোক শান্তিনিকেতনে বাংলা পড়াতেন। কেউ তাকে কখনো গান গাইতে শোনেনি। কিন্তু গভীর রাত হলেই তাকে গানে পেত। জানালার পাশে বসে আপন মনে গান ধরতো মেজাজে। পাশাপাশি বাড়িতেই থাকতেন দিনু ঠাকুর। বিশ্রামের ব্যাঘাত হতো তাঁর। এ বেসুরো গান শুনে চুপ করে বসে থাকাই যেন দায় হয়ে যেত। নগেন আইচ একদিন যেই না গান ধরেছেন, দিনু ঠাকুর রেগে গিয়ে এসরাজ নিয়ে জুড়ে দিলেন একটি প্যারোডি গান:-

গভীর রাতে তোমার অত্যাচার
নগেন আইচ শত্রু হে আমার
তোমার গান কান্না সম
আসেনা ঘুম নয়নে মম
দুয়ার খুলি হে মোর যম
তোমায় তাড়াই বারেবার।

(রবীন্দ্রনাথের "আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার" অনুসরণে)

একসময় রবীন্দ্রনাথের সোনার তরী কাব্য নিয়ে যারপরনাই সমালোচনা হয়েছিল। যুগাপেক্ষা অনেক আধুনিক গভীর মনস্তাত্ত্বিক মূল্যবোধের পরিচয় বহন করত রবি ঠাকুরের কবিতা, যা সে যুগে অনেকের বোধগম্যই হয়নি। গল্প আমরা সবাই জানি। কিন্তু এই "সোনার তরী"র প্যারোডি করেছিলেন স্বয়ং সজনীকান্ত দাস "মানের তরী" নামে।

মানের তরী
ভবনে গরজে প্রিয়া, নাহি ভরসা
কখন ঝরিবে জানি মান বরষা।
করে বুঝি করে তাড়া
রাশি রাশি ভারা ভারা
বরষিয়া গালিধারা খরপরশা।
ভাবিতে ভাবিতে প্রাণে নাহি ভরসা।
একখানি ছোট ঘর, আমি একেলা
রাস্তাতে ছেলেগুলো করিছে খেলা।
দেয়ালে খোকার আঁকা
ছবি কত মসীমাখা,
খুকি শুয়ে লেপ ঢাকা সকালবেলা
মন দুঃখে নয় মুখে আমি একেলা।
রাগ করে গেছে ভোরে গিন্নি হা রে--
মান ভাঙ্গা হবে দায়, চিনি উহারে
দুমদাম আসে যায়
মোর পানে নাহি চায়,
ডাকি ,আর কি উপায় স্যাকরাটারে
গড়াইতে হল দেখি পুষ্পহারে।

শ্রী কেবলরাম গাজনদার ছদ্মনামে সজনীকান্ত নজরুলের গজল গান "বাগিচায় বুলবুলি তুই ফুল শাখাতে দিসনে আজি দোল" এর প্যারোডি লিখলেন:-

জানলায় টিকটিকি তুই টিকটিকিয়ে করিস নে আর দিক
ও বাড়ির কলমি লতা কিসের ব্যথায় ফাঁক করেছে চিক।।
বহুদিন তাহার লাগি রাত্রি জাগি গাইনু কত গান
আজিকে কারে জানি নয়না হানি হাসল সে ফিক ফিক
চেয়ে আমার কি আমার পানে?
কেবা জানে মন মানে না হায়--
নয়নের এক চুমুকে বিধলো বুকে তপ্ত অলখ শিক্।
কবি জীবনানন্দ দাশের বিখ্যাত কবিতা বনলতা সেন ও রক্ষা পায়নি সুরসিক প্যারোডিকার সরিৎশেখর মজুমদার এর হাতে পড়ে।:--

ঘনঘটা সেন

হাজার বছর ধরে আমি কাদা ঘাঁটিতেছি
পৃথিবীর পথে
বেঙ্গল বিহার থেকে হিলি দিল্লি অন্ধ আর মালয়ালি ঘরে
অনেক খুজেছি আমি
হিড়িম্বার  তাড়কার ধূসর জগতে
সেখানে গিয়েছি আমি আরো দূরে
গন্ধ ভরা কদর্য- নগরে
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক কষ বেয়ে
গ্যাজলা সফেন ,
আমাকে প্রচন্ড ধোকা দিয়ে গেছে
কাটোয়ার ঘনঘটা সেন।

কিংবা" বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি"এর প্যারোডি দাঁড়ালো এই রূপ:--

হ্যাঙলার মুখ আমি দেখিয়াছি

হ্যাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি
তাই আমি পৃথিবীর রূপ
খুঁজিতে যাই না আর, অন্ধকারে জেগে ওঠে ভাড়ারের কাছে
চেয়ে দেখি ছাতার মতন বড়ো শালপাতা পেতে বসে আছে পেটুক দয়াল চাকি
চারিদিকে চেয়ে দেখি
খাবারের স্তুপ।
ডিম চপ গাছ পাঠা মাছ মাংস যা পেয়েছে
খায় গুপগুপ
ফণীমনসার পাশে ডাস্টবিনে কুকুরের ছায়া পড়িয়াছে
বলদ এর সিংহ থেকে না জানি সে কবে মাছি গোবর এর কাছে....।।

কিন্তু "নির্জনতম কবি"র সমাহিত ধ্যানমগ্ন কবিতাগুলিও প্যারোডিকারের হাতে পড়ে হালকা হাসি ও আনন্দ ছাড়াও তৎকালীন সামাজিক অসংগতি গুলিকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে প্যারোডির অভিনব চালে:-

আবার আসিব ফিরে

আবার আসিব ফিরে পান বিড়ি মুখে করে এই বাংলায়
আসল মানুষ নয়, হয়তোবা অতি ধূর্ত শৃগালের বেশে
যেথা হুক্কা হুয়া ডাক
বঙ্গ কার্তিকের সদা মিছিলের দেশে।
ভেজালের কারবারে চুষে চুষে মুনাফার কাঁটাল কোয়ায়;
হয়তোবা হাঁসফাঁস এ শরীর লাভের ঘুঙুর লাল পায়
দিন রাত কেটে যাবে কালো বাজারিয়া জলে ডুবে আর ভেসে
আবার আসিব আমি বাংলার নদী নালা মাঠ-ঘাট ঘেঁষে।

গ্রামবাংলার ঐতিহ্যময় নিসর্গ ও রূপকথা-পুরাণের জগৎ জীবনানন্দের কাব্যে হয়ে উঠেছে চিত্ররূপময়, তাতে তিনি ‘রূপসী বাংলার কবি’ অভিধায় খ্যাত হয়েছেন। বুদ্ধদেব বসু তাকে নির্জনতম কবি বলে আখ্যায়িত করেছেন। অন্নদাশঙ্কর রায় তাকে ‘শুদ্ধতম কবি’ অভিধায় আখ্যায়িত করেছেন। সমালোচকদের অনেকে তাকে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল-পরবর্তী বাংলা সাহিত্যের প্রধান কবি বলে মনে করেন। জীবনানন্দের বনলতা সেন কাব্যগ্রন্থ নিখিলবঙ্গ রবীন্দ্রসাহিত্য সম্মেলনে পুরস্কৃত (১৯৫৩) হয়। ১৯৫৫ সালে শ্রেষ্ঠ কবিতা গ্রন্থটি ভারত সরকারের সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার লাভ করে। জীবনানন্দ দাশের বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থগুলোর মাঝে রয়েছে রূপসী বাংলা, বনলতা সেন, মহাপৃথিবী, বেলা অবেলা কালবেলা, শ্রেষ্ঠ কবিতা ইত্যাদি।

আমি কবি যত চামারের

আমি কবি যত চামারের পাজি ছুঁচোদের
"হাঁ -জী হুজুরে"র
আমি কবি যত ইতরের
আমি কবি পুরুচর্মের অপকর্মের
বেশরম কাম কর্মের যত স্বপ্নের তরে ভাই
প্রাণ করে আইঢাই
চাটি মেরে ছিল মতলববাজ
পানি পাইনিকো হালে।

(প্রেমেন্দ্র মিত্র রচিত "আমি কবি যত কামারের "প্যারোডি।)
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ; বিশ শতকের শেষভাগে সক্রিয় একজন প্রথিতযশা বাঙালি সাহিত্যিক। ২০১২ খ্রীষ্টাব্দে মৃত্যুর পূর্ববর্তী চার দশক তিনি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব হিসাবে সর্ববৈশ্বিক বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর কাছে ব্যাপকভাবে পরিচিত ছিলেন। বাংলাভাষী এই ভারতীয় সাহিত্যিক একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, ছোটোগল্পকার, সম্পাদক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট হিসাবে অজস্র স্মরণীয় রচনা উপহার দিয়েছেন। তিনি আধুনিক বাংলা কবিতার জীবনানন্দ-পরবর্তী পর্যায়ের অন্যতম প্রধান কবি। একই সঙ্গে তিনি আধুনিক ও রোমান্টিক। তার কবিতার বহু পঙ্‌ক্তি সাধারণ মানুষের মুখস্থ। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় "নীললোহিত", "সনাতন পাঠক", "নীল উপাধ্যায়" ইত্যাদি ছদ্মনাম ব্যবহার করেছেন।
রোমান্টিক আক্ষেপের কবিতা "কেউ কথা রাখেনি" তার প্যারোডি এইরূপ:-

কেউ কথা রাখেনি

কেউ কথা রাখেনি তেত্রিশ বছর কাটলো
ছেলেবেলায় এক দুষ্টুমি ভরা অষ্টমী মেয়ে
ঝাল -ঝাল নুন- নুন তেতুল আচার চাটিয়ে বলেছিল:-ফোকলা পিসির ক্যানেস্তারা থেকে লজেন্জুস চুরি করে এনে একাদশীর দিন চোষাবে
তারপর কত পূর্নিমা-অমাবস্যা এসে চলে গেল কিন্তু সেই অষ্টমী আর এলোনা।
পঁচিশ বছরের একাদশী প্রতীক্ষায় আমি বুড়ো আঙ্গুল চুষেছি।

মামাবাড়ির বুড়ি ঝি রক্ষাকালী বলেছিল:-বড় হও দাদাঠাকুর তোমাকে আমি নবাবজাদার মতিঝিল দেখাতে নিয়ে যাবো;
যেখানে হাজার পদ্মফুলে
মাথায় হেকিমি তেল মেখে
মেয়ে পুরুষ সাপ-নেউলে খেলা করে।
রক্ষাকালী আমি আর কত বড় হবো?
মাথার চুল যে হুশ হুশ করে আকাশে উড়ে গেল
আর কবে তুমি আমায় মতিঝিল দেখাতে নিয়ে যাবে?
লাঠি উঁচিয়ে গেটের কাছে ফুঁসেছে পাহারাদার
নস্কর বাড়ির সূপুত্তুররা মদ গিলেছে ঢকঢক
আমি ভিখারির মত গেটে দাঁড়িয়ে দেখেছি Rum উৎসব
বারান্দায় রঙের ধারার মধ্যে সুবর্ণ কঙ্কণ পরা পরী বাঈজিরা
কত রকম আমোদে ভেসেছে
কেউ আমার দিকে ফিরেও চায়নি।
বাবা বলেছিলেন:-কুছ পরোয়া নেই বেটা
বড় হয়ে একদিন তুইও আমার পয়সায়.....
হায়! বাবা মরে হেজে গেছে
আমি এখন দেউলিয়া
আমার চাখা হয়নি কিছুই না আফিং গুলি না লজেঞ্জুস না বিদেশী Rum
বুকের মধ্যে সুগন্ধি রুমাল রেখে পাঁচি বলেছিল : যেদিন আমায় সাতনোরি হার কিনে দিবি সেদিন তোর বুকেও এ-রকম আতরের গন্ধ থাকবে।
পাঁচির জন্য আমি কাব্ লের কাছে ঋণ করেছি
হাতের মুঠোয় জান রেখেছি
নোট জাল করেছি
কলুর ষাঁড়ের মত চোখে বেঁধেছি রুমাল
বিশ্বকোষ ঘেটে ঘেটে প্রেমের কবিতা লিখেছি ১০৮টা
তবু কথা রাখেনি পাচি
কেউ কথা রাখেনি
তেত্রিশ বছর কাটলো....
কেউ কথা রাখে না। (ক্রমশঃ)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours