নাজমীন মর্তুজা, লেখক ও গবেষক, অ্যাডিলেট, অস্ট্রেলিয়া:

আমরা জানি যে যৌনতা শুধু একটা বায়োলজিক্যাল বা শারীরিক বিষয় নয়, এর সাথে সামাজিক, মানসিক এবং সাংস্কৃতিক বিষয়গুলোও যুক্ত৷ শিশু ধর্ষণ বা উৎপীড়ণ কোন সমাজেরই প্রচলিত সংস্কৃতি বা নিয়মের সাথে মেলে না৷ যেমন সব সমাজেই পেডোফেলিয়া বা শিশুকামিতা হচ্ছে একটি বিকৃত যৌনাচার৷
যারা শিশুদের যৌন উৎপীড়ণ করে আনন্দ পায় তারা পেডোফাইল বা শিশুকামী৷ পৃথিবীতে একে ‘সবচে হিংস্র এবং জঘন্য ধরনের অপরাধ' হিসেবে চিহ্নিত করেছেন বিশেষজ্ঞরা৷ বিশ্বের সব দেশেই কম-বেশি এধরনের অপরাধ ঘটতে দেখা যায়৷
বাংলাদেশে গত বছর জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ৬ মাসে প্রায় ৪০০ শিশু ধর্ষণ ও ধর্ষণ চেষ্টার শিকার হয়েছে, বলে জানিয়েছে বেসরকারি সংগঠন মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন৷ এরমধ্যে ৮ জন ছিল ছেলেশিশু৷ ধর্ষণের পর এক ছেলে শিশু সহ মারা গেছে ১৬টি শিশু৷ এর আগে ২০১৮ সালে ৩৫৬ জন শিশু এবং ২০১৭ সালে ৫৯৩ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছিল বলে বিভিন্ন পরিসংখ্যানে দেখা যায়৷ তবে এই পরিসংখ্যানগুলো যে সম্পূর্ণ তা হয়তো বলা যাবে না। কারণ, সত্যি বলতে, শিশু নির্যাতনের কয়টা খবরইবা আমরা জানি? কয়টাই বা সংবাদ মাধ্যমে আসে? খুব মারাত্মক কিছু না ঘটলে বেশিরভাগ সময় পরিবারের সদস্যরাই বিষয়টি চেপে যায়৷ ফলে যে পরিসংখ্যান আমরা পাই তা হয়তো মোট ঘটনার একটি অংশ মাত্র৷
বিকৃত রুচি বলে একটা কথা আছে এই খবর গুলো শুনলে বোঝা যায় মানুষের যৌন বিকৃতির ফিরিস্তি । যৌন বিকৃতি আসলে কি সেটা জেনে নেই । 
 যৌনবিকৃতি (ইংরেজি: Paraphilia, "প্যারাফিলিয়া") বলতে এমনসব যৌনকর্মকাণ্ডের প্রতি আকর্ষণ অথবা সেই সকল কর্মকাণ্ডের সংগঠন বোঝায় যেগুলো 'স্বাভাবিক' নয়। চিকিৎসাবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে যৌনবিকৃতিকে মানসিক রোগ বা বৈকল্য হিসেবে শ্রেণিভুক্ত করা হয়ে থাকে। কোন কোন যৌনক্রিয়া স্বাভাবিক বা অস্বাভাবিকতা নির্ধারিত হয় তিনটি পর্যায়ে। এগুলো হলো -
১)সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি ২)ধর্ম এবং ৩)স্থানীয় আইন।
যেহেতু ধর্ম ব্যতীত বাকী দুটি নিয়ামক চলমান বা পরিবর্তশীল, তাই সার্বিকভাবে যৌনবিকৃতির সঙ্গার্থে পরম বা চূড়ান্ত নয়। উদাহরণস্বরূপ, সমকাম যৌনবিকৃতি হিসেবে সকল দেশের আইনে এক সময় অবৈধ ছিল; কিন্তু ১৯৮০ খ্রীষ্টাব্দের পর থেকে বর্তমান পর্যন্ত অনেকগুলি দেশে সমকাম একটি আইনসিদ্ধ যৌনক্রিয়া হিসেবে স্বীকৃত হয়।
যৌনবিকৃতির একটা বড় চিহ্ন হিসেবে পশুকামিতা (ইংরেজি: Zoophilia) হচ্ছে এমন এক প্রকার যৌন বিকৃতি যেখানে মানুষ নয় এমন প্রাণীর সাথে মানুষের যৌন আকর্ষণ প্রকাশ পায়। পশ্বাচার (ইংরেজি: Bestiality) হচ্ছে মানুষ এবং মানুষ নয় এমন প্রাণীর মধ্যে আন্তঃপ্রজাতি-যৌন কর্মকাণ্ড প্রায়সই পশ্বাচার এবং পশুকামিতা শব্দদ্বয়কে একে অপরের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু কিছু গবেষক আকর্ষণ (পশুকামিতা) এবং যৌনক্রিয়া (পশ্বাচার) এর মধ্যে বিভাজন রেখা তৈরী করেছেন। আমাদের সমাজেও এই পশ্বাচারের সংখ্যা কম নয় ! পশ্বাচার হলো যারা প্রাণীকে নির্যাতন অথবা ধর্ষণ করে এবং পশুকামী হল সারা প্রাণীর প্রতি যৌন আকর্ষণ বা আবেগপ্রবণ আকর্ষণ অনুভব করে।
যৌনবিকৃতি নিয়ে  আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ‘দ্য ডেনভার পোস্ট’-এ প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আউরোরায় বাড়ির কুকুরকে যৌন নিগ্রহ করার অভিযোগে এক যুগলকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। 
জানা গেছে, কয়েকদিন আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আউরোরায় একটি পেট্রোল পাম্পে জেনেটি এলিন সোলানে নামে এক নারীর সঙ্গে আলাপ হয় এক পুলিশ কর্মীর। এর পরেই দু’জনের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। সেখানেই সোলানো ওই পুলিশকর্মীকে জানান, কয়েকদিন আগেই তার বয়ফ্রেন্ড ফ্রেডারিক ব্লু মাঞ্জারেসের সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়ে যায়। বিচ্ছেদের কারণ জানতে গিয়েই অবাক হয়ে যান ওই পুলিশকর্মী।
ওই নারী জানান, ফ্রেডারিক জোর করে তার কুকুরকে যৌন নিগ্রহ করতেন। পাশাপাশি তাকেও সেই কুকাজে লিপ্ত করতেন। সম্পর্কে থাকার সময়ে দু’জনেই প্রায়দিনই কুকুরের সঙ্গে এমন কাজ করতেন। কিন্তু কয়েকদিন পর ওই নারী ভাবতে শুরু করেন, তার থেকে কুকুরটিকে বেশি ভালবাসেন তার বয়ফ্রেন্ড ফ্রেডারিক। এই নিয়ে মাঝেমধ্যে ঝগড়া চলত দু’জনের। তার পরেই ফ্রেডারিকের সঙ্গে সম্পর্ক বিচ্ছেদ করেন ওই নারী।
নারীর মুখে একথা শোনার পরেই কার্যত অবাক হয়ে যান পুলিশকর্মী। তিনি স্বত্বঃপ্রণোদিত হয়ে উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিষয়টি জানান। তার পরেই ব্যবস্থা নেয় পুলিশ। ওই নারী ও তার প্রাক্তন বয়ফ্রেন্ড দু’জনকেই গ্রেফতার করে পুলিশ।
এমন আরো একটি বিক্ষিপ্ত ঘটনা পড়েছিলাম একটা নিউজে। 
যে দেশের মেয়েরা পশুর সাথে যৌন মিলন করে। যৌন মিলন যে কোনো প্রজাতির জীবের জন্য প্রাণের বাত্রা বয়ে আনে। কারণ এর ফলেই প্রজন্মের সৃষ্টি হয়। তাছাড়াও নারী এবং পুরুষ তাদের তৃপ্তি বা ভালোবাসা মেটাতে এভাবে লিপ্ত হয়। কিন্তু বিদেশের এক দেশে মানুষ মিলিত হয় পশুর সঙ্গে। সুইজারল্যান্ড ইউরোপের এক অন্যতম শান্তিপূর্ণ দেশ। কিন্তু সেখানে বিভিন্ন প্রাণীর উপর যৌন নিপীড়ণের হার ক্রমশ বাড়ছে। এর মধ্যেই সর্বাধিক ভুক্তভোগী হলো ঘোড়া।
এর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে যেহেতু বাড়ির পুরুষেরা বেশিরভাগই বাইরে চাকরি করে তাই তারা স্ত্রীদের চাহিদা পূরণ করতে পারেনা।এমন অভিযোগ আনেন। 
তেমনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রীকে ধর্ষণের দায়ে যে ধর্ষক কে আটক করেছেন , সেই ব্যক্তির নাম মজনু । এই মজনুর যৌন বিকৃতির অনেক কথাই শুনলাম । ডিজএইবল এবং ভিক্ষুক নারীদের সাথে যৌনতায় সে লিপ্ত । পুরোদস্তুর নেশায় চুর তার দুটো চোখ , গাজার  কোলকি টানতে টানতে মেন্ডিবল বের হয়ে এসেছে ।  সামনের দাঁত দুটো নেই । তার ঠিকানা। পরিত্যক্ত পাইপে । পৃথিবীতে কত প্রকার যে যৌন বিকৃত মানুষ আছে তার ইয়াত্তা নেই । সমস্যা সমাধানের জন্য এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করা জরুরি৷
সাধারণভাবে কারণগুলোর মধ্যে একটি হলো ব্যাপক সামাজিক অবক্ষয়, নীতি-নৈতিকতার মানদণ্ডগুলির সর্বব্যাপী বিলুপ্তি ও মূল্যবোধের অধঃপতন৷ কেউ কেউ এসব ঘটনার পেছনে ইন্টারনেট পর্নোগ্রাফি সহজলভ্য হয়ে যাওয়া এবং মাদকাসক্তিকেও দায়ী করেছেন৷ আবার কারো মতে বিকৃত যৌন চাহিদা মেটানোর জন্য অপরাধীরা সব থেকে সহজ টার্গেট হিসেবে বেছে নেয় শিশুদের, কারণ তারা অরক্ষিত, অনেক সময় তাদের উপর কি ঘটছে, সেটাই তারা বুঝতে পারে না৷ তাছাড়া শিশুদের উপর ক্ষমতা প্রদর্শন সহজ, তারা শারীরিকভাবে দুর্বল৷ আর যৌন লালসা মেটানোর পরে ভয় দেখিয়ে তাদের মুখ বন্ধ করে রাখাও সহজ৷ বেশির ভাগ সময় শিশুদের ভুলিয়ে ভালিয়ে বা জোর করে পেডোফাইলরা তাদের কার্যসিদ্ধি করে৷ পথবাসী, শ্রমজীবী, দরিদ্র শিশুরা যেমন এর শিকার হয়, তেমনি মধ্যবিত্ত শিক্ষিত সমাজেও এরকম ঘটনা কম ঘটে না৷
অনেকে এসব অপরাধ বেড়ে যাওয়ার পেছনে বিচারহীনতার সংস্কৃতিকেও দায়ী করেন৷ দীর্ঘদিন ধরে মামলাগুলো ঝুলে থাকা , রাজনৈতিক ক্ষমতার অবমূল্যায়ন করা বিচারের দীর্ঘতা অপরাধ করেও অপরাধীর কঠোর শাস্তি না হওয়া, আইনের দুর্বলতা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গাফিলতি বা ব্যর্থতা এরকম ঘটনা ঘটাতে অপরাধীদের উৎসাহিত করে৷
এসবের সমাধান নিয়ে কত কত লেখা পরামর্শ আমরা পড়ে থাকি শুনেও থাকি ... কিন্তু কতটুকু কি হয় আদতে সেটার খবর আমারও জানা নেই। কিন্তু এই ধরনের অপরাধের জন্য আইনের মাধ্যমে অপরাধীর কঠোর সাজা নিশ্চিত করার কোন বিকল্প নেই৷ এসব অপরাধের মামলাগুলোর বিচার খুব দ্রুত শেষ করা দরকার, আর সাজাটাও হওয়া উচিত দৃষ্টান্তমূলক৷ অভিভাবকদের সচেতনতা৷ শিশু কোথায় যাচ্ছে, কোথায় খেলছে, তার চারপাশে কারা আছে সেটাও জানতে হবে৷  সবার সাথে অবাধ মেলামেশা এমনি কি যার তার কোলে উঠতে না দেওয়া । পরিবারে শিশুরা যেন মন খুলে কথা বলতে পারে সেরকম বন্ধুত্বপূর্ণ সহজ পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে৷ বাবা মার বিশেষ লক্ষ্য রাখতে হবে আত্মীয় প্রতিবেশির মধ্যে যৌন অপরাধী ঘাপটি মেরে লুকিয়ে আছে কিনা৷ কেননা শিশুকে আদর করার ছলে তারাই হয়তো শিশুকে নিপীড়ণ করে যাচ্ছে৷
স্কুল ও পরিবার থেকে শিশুকে নিজের সুরক্ষার শিক্ষা দেওয়া সম্ভব। কোনটা ভাল স্পর্শ, কোনটা খারাপ স্পর্শ সেটাও শিশুকে বোঝাতে হবে৷ পশ্চিমা অনেক দেশেই শিশুদের এ বিষয়ে স্কুলে শেখানো হয়৷ 
সেক্ষেত্রে উদাহারণ স্বরূপ আমি বলতে পারি আমার মেয়ে বাচ্চা দুটোর কথা । একজন ক্লাস থ্রি একজন ওয়ানে পড়ে । ওদের স্কুলেই  সাইন নিয়ে সেক্স নিয়ে , এতো সুন্দর ভাবে জ্ঞান দেওয়া হয় , এমন কি টাচ মানে স্পর্শ নিয়েও তাদেরকে সচেতন করা হয় । ওরা এই বয়সে যা জেনেছে আমরা আমাদের বয়সে হয়ত এতো কিছুর নামই শুনিনি । আলোচনা তো দূরের কথা , এসব কথা মুখে আনাও পাপ যেন । জেনেও না জানার ভাব করে থাকে অনেক শিশুই। আমাদের দেশের সামাজিক পরিস্থিতিতে শিশুদের সাথে এসব বিষয়ে খোলামেলা কথা-বার্তার প্রচলন নেই৷ শিশুর নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে স্কুল পাঠের প্রাথমিক স্তর থেকেই এ বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া যেতে পারে৷ 
এজন্য খুব জরুরী পারিবারিক সুশিক্ষার । মেয়ে শিশুর পাশাপাশি ছেলে শিশুদেরও ধর্ষণ ও যৌন হয়রানি বিরোধী মূল্যবোধ শেখাতে হবে৷ যাতে বেড়ে ওঠার সময় থেকেই তাদের মধ্যে এ ধরনের সচেতনতা তৈরি হয়৷ কেননা, মানুষ আজীবন তার পারিবারিক শিক্ষাকেই বয়ে বেড়ায়৷ জীবন আচরণে সুস্থ, স্বাভাবিক যৌনতার চর্চা না থাকলে সেখানে বিকৃতিই জন্ম নেবেই নেবে । 

(তথ্য সুত্র : উইকিপিডিয়া এবং যৌনতা নিয়ে বিভিন্ন নিউজ ও ফিচার থেকে নেওয়া।)


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours