রিয়া ভট্টাচার্য, লেখিকা, খড়্গপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর:

রোহণের দাদু ভাস্করবাবুর বয়স ৬৫ বছর। রুচিবান, কর্মঠ ও জ্ঞানী মানুষ হিসাবে পাড়ার সকলেই তাঁকে শ্রদ্ধা করে। রামায়ণ - মহাভারত থেকে শ্লোক এই বয়সেও গড়গড় করে উদ্ধৃত করে যেতে পারেন সদ্য শিক্ষকতা হতে অবসর নেওয়া প্রবীণ মানুষটি৷ রোহণও বড্ড ভালোবাসে দাদুর কাছে গল্প শুনতে।
দিনগুলো কাটছিল খুব সহজেই। তবে আচমকাই যেন তার কেটে যেতে লাগল পুরো বিষয়টার। দাদু নিজের প্রাত্যহিক কাজই গুলিয়ে ফেলছিলেন মাঝে মাঝে৷ বাবা মা বয়সজনিত রোগ ভেবে পাত্তা দিলেন না, ধীরে ধীরে দাদুর মস্তিষ্ক থেকে মুছে গেল তাঁর সমস্ত শিক্ষা, আত্মীয়তা এমনকি আমিত্ববোধ। যে দাদু রোহণ বলতে অজ্ঞান ছিলেন তিনিই আর তাকে চিনতে পারেন না। রোগ এতটাই মাথাচাড়া দিয়ে উঠল যে নিজেকে সবকিছু থেকে সংপৃক্ত ভাবতে শুরু করেছিলেন তিনি। তিনি যাতে পালিয়ে না যান তার জন্য তাঁকে ঘরে পায়ে দড়ি বেঁধেও রাখা হয়েছিল৷ কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি৷ একদিন তিনি পালিয়ে গেলেন, আর ফিরলেন না।

স্টেশনের ধারে এক বৃদ্ধার সঙ্গে দেখা হয়েছিল৷ চুপচাপ একমনে কাঁথা সেলাই করে চলেছেন। আধময়লা কাপড়ের ওপর ফুটে উঠছে চমৎকার সুতোর নকশা। এতসুন্দর কারিগরকে পথের ধুলোয় বসে থাকতে দেখে নিতান্ত কৌতুহলবশত জিজ্ঞেস করেছিলাম তাঁর পরিচয়৷ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েছিলেন, বোবা চোখে ফুটে উঠেছিল অস্পষ্ট - অসহায় ভাষা৷ আশেপাশের মানুষজনের কাছ থেকে জানা গেল তিনি কে বা কোথা থেকে আসছেন কেউ জানেনা। কাঁথা সেলাই এর মহিমা দেখে সকলে তাঁকে কাঁথাবুড়ি বলে ডাকে, খেতেটেতে দেয়। কেউ ভিখারী ভেবে পয়সা ছুঁড়লে তিনি ফিরেও তাকান না, মাঝেমাঝেই কোথায় নিখোঁজ হয়ে যান। স্থানীয়রা যথাসাধ্য ডাক্তার দেখিয়েছেন, কিন্তু এই রোগ নিরাময়ের ওষুধ আজও আবিষ্কার হয়নি ।
ডিমেনশিয়া একটি ল্যাটিন শব্দ। স্মৃতি যখন মানুষের সঙ্গে বিদ্রোহ ঘোষণা করে তার নিজস্বতাকে মুছে দেয় তাকে ডিমেনশিয়া বলে৷ এর একটি ভাগ অ্যালঝাইমার্স৷ বেশিরভাগ ৪০ - ৮০ বছরের মানুষের মধ্যে এর প্রাদুর্ভাব বেশী, এরফলে মস্তিষ্কের স্নায়ুগুলি শুকিয়ে যায় যারা স্মৃতিকে সঞ্চয় করে রাখে৷ বেশিরভাগ সময়ই বৃদ্ধাবস্থার স্বাভাবিক রোগ বলে একে গা করা হয় না ও অসচেতনতার ফলে রোগীর অবস্থা খারাপ থেকে খারাপতর হয়৷ এমনকি তাঁর মৃত্যুও ঘটতে পারে দূর্ঘটনায়৷

এর এখনো তেমন কোনো নিরাময়ের ওষুধ আবিষ্কৃত হয়নি, ওষুধ দিয়ে স্মৃতিভ্রংশজনিত সমস্যাকে সাময়িক রোধ করা হয় মাত্র৷ হিন্দী ছবি " ব্ল্যাক " এ অমিতাভ বচ্চনের অভিনীত চরিত্রটি এমনই রোগাক্রান্ত হয়েছিল।
বাড়ির লোকের সচেতনতাই এই রোগীর ক্ষেত্রে আশীর্বাদস্বরূপ। যত তাড়াতাড়ি ধরা পড়বে তত তাড়াতাড়ি ওষুধ ও পারিবারিক সহচর্য দিয়ে একে ঠেকিয়ে রাখার প্রচেষ্টা সম্ভব হবে। ভারতে এমন রোগীর হার ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই সচেতনতা সবচেয়ে জরুরি । আমাদের ঘরের ছাদ রক্ষার দায়িত্ব যেমন আমাদের নিজেদেরই ; তাইনা!!



Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours