কাজল ভট্টাচার্য, কার্টুনিস্ট ও সিনিয়র জার্নালিষ্ট, কলকাতা:

সেই প্রথম ছোঁয়ার কথা মনে পড়ে?

দমদম ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট।
গিয়ে হাজির সময়ের বেশ খানিকটা আগেই। আমার মতো লোকের সংখ্যা নেহাত কম না।
"আয়ে যা রে উড়কে মেরা/ হংস পরদেশিয়া!"
যে যার আপনজনকে রিসিভ করতে এসছে।

ওই অচেনার ভিড়ে তোর নিজের লোকজনও ছিলো। তুই আগেই জানিয়েছিলি। সেখানে হয়তো আমাদের আদৌ দেখা হবে না। বা দেখা হলেও ওই 'চোখাচুখি'টুকুই। নইলেই হাজারো সওয়াল জবাব। এ কে? কতদিন ধরে চিনিস?
সবাই অপেক্ষা করছে। বোকার মতো এর দিকে তার দিকে তাকালাম। কেউ কেউ আবার আমার দিকেও তাকালো। আমি চেনার চেষ্টা করলাম, যারা তোকে রিসিভ করতে এসেছে। তারাই তোকে হাইজ্যাক করে নিয়ে যাবে। সব জেনেশুনেই গেছিলাম।

ওই যে লোভ।
তোকে একবার দেখার লোভ। লোভ ছোঁয়ার। বেরিয়ে এলি তুই। আমায় ফটো পাঠিয়েছিলি তোর সাজপোশাকের। তাই দেখামাত্রই চিনতে পেরেছিলাম তোকে। কেমন চুপ হয়ে গেছিলাম যেন। একটু আগের সব উত্তেজনা উধাও। পাদুটো যেন মেজেতে গেড়ে বসেছিলো। তোকে দেখতে পেয়েই, হুড়মুড় করে ঘিরে ধরেছিলো সবাই। নজরের আড়ালে চলে গেছিলি তুই। ওই ভিড়ে আমার প্রবেশ নিষেধ।
তুই কি আমাকে দেখতে পেয়েছিলি?
জানি না। কোনদিন আর জানতেও চাইনি। তবে সে সময়টাতে জানিস, নিজেকে বড় 'চোর চোর' লাগছিলো। মনে হচ্ছিলো, পাশের বাড়ির বৌদি স্নান করছে। আর আমি সেই বাথরুমে উঁকি মারছি। সে মুহূর্তে যত রাগ গিয়ে পড়েছিলো তোর ওপর।
মনে হচ্ছিলো, তোর আসার সময়টা বাড়ির লোকদের না জানালেও তো পারতি !
জানি এটা আবদারের বাড়াবাড়ি।

তোর আসার আগমনী বাজছিলো তো কতদিন ধরেই। একটু আগেভাগে টিকিটটা কাটলে ভাড়া খানিকটা কম লাগে। তাই তোকে তাগাদা দিতাম। তুইও কাটবো কাটবো করতি। বিরক্ত লাগতো একেকসময়। মনে হতো গরজটা শুধু আমারই। আসলে কী জানিস, তর সইছিলো না আমার। তোকে দেখার। তোকে ছোঁয়ার।

তারপর একদিন তুই জানালি টিকিট কেটেছিস। তোর ওখানকার সঙ্গে আমাদের এখানের সময়ের ফারাক সাড়ে পাঁচ ঘণ্টার। আমার মোবাইলে তখন রাত তিনটে বেজে গেছিল। সে রাতটায় আর ঘুমোতে পারিনি।
কেন জানিস?
ভয় পেয়ে বসেছিলো আমাকে। কখন যেন উবে গেছিলো তোর আসার আনন্দটা। মনে হচ্ছিলো, তোকে আসতে না বললেই ভালো হতো।
কোনদিন ফ্লাইটে চাপিনি। তাই বড় ভয় লাগতো। সাত সমুদ্র তেরো নদী ডিঙিয়ে তোর প্লেন এদেশে আসবে।
থেকে থেকেই তোর ফটো দেখতাম।
জানিস খুব ইচ্ছা করতো, এয়ারপোর্ট থেকে তুই বেরিয়ে এলেই, পেছন থেকে খপ করে জড়িয়ে ধরবো। ছিটকে বেরিয়ে যেতে চাইবি তুই। ভয় পেয়ে যাবি আচমকা হামলায়।
সেটাই হতো, তোকে আমার প্রথম ছোঁয়া। ওই হায় হ্যালো হ্যান্ডশেক আমার ধাতে নেই। তাই সুন্দর ভদ্র নাগরিক সমাজের কেতায়, কিছু ভাবতেও পারি না।
আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। একসময় প্লেনটাকে দেখলাম তোকে নিয়ে ভেসে আসতে। বাপরে বাপ, সেকি উত্তেজনা রে। গভীর রাতের উত্তেজনাকেও যেন হার মানায়।
ঘোর কালো পোশাকে মনে হচ্ছিলো, তুই আঁধারের রানি। তখন ওই পেছন থেকে জড়িয়ে ধরা- টরার গল্প হাওয়া। মন চাইছিলো ঝাঁপিয়ে পড়ি তোর ওপর।

প্রথমটায় খুব হিংসে হচ্ছিলো। পরে হিংসের মেঘ সরিয়ে উড়ে এলো রাগের ঝড়। নিজেই নিজেকে সরিয়ে আনলাম এক হ্যাঁচকা টানে। আর মনে-মনে তখন অনর্গল খিস্তি তোকে। তারপর ফস করে আগুন দিলাম উল্টো সিগারেটে। তুলোঠাসা ফিল্টারের ধোঁয়ায় সেকি কাশি রে! চট করে সরে গেছিলাম। পাছে তুই ভাবিস লোকটা কেশোরোগী।
তোর ওপরে রাগ তো ছিলোই। এবার আমার ওপরেও আমার রাগ ধরলো। আমার হ্যাংলাপনার ওপর।
হনহন করে বেরিয়ে গেছিলাম। পালাতে চাইছিলাম ওই জায়গা থেকে। একটু এদিক সেদিক ঘুরতে ঘুরতেই চলে এসেছিলাম মেন রাস্তায়। সামনেই দেখি একটা এসি ফিফটি বাস। চেপে বসলাম। মনেমনে তোকে বলে এসছিলাম, থাক শালা তুই।

ফেসবুক স্টেটাসে দেখতাম তুই শহরের নানা জায়গায় ঘুরছিস। একেকজনের সঙ্গে তোর ফটো। আমাকেও মেসেজ করতি। কিন্তু আমার উৎসাহে কী করে যেন জলঢালা হয়ে গেছিলো।
সবই বলেছিলি তুই আগে থাকতে। তখন ওসব ধর্তব্যের মধ্যেই আনিনি। তখন তোর প্রেমে হাবুডুবু খেতেই ব্যস্ত ছিলাম তো। গরীবের ছেলে হাতের সামনে কষা মাংস পেলে যা হয় আর কী ! এমন গেলান গেলে যে পেটখারাপ হয়।
আমারও ওই দোষ ষোল আনা। বরাবরই কল্পলোকের বাসিন্দা আমি। তাই বাস্তবের তোকে আমি দেখতেই পাইনি। আর যেদিন দেখলাম সেদিনই বুঝলাম, 'রানুর(আমার) প্রথম ভাগ' হতে পারে না। ওটা সিনেমাতেই হয়। অভাবী সংসারের মানুষ, ইচ্ছাপূরণের উপাখ্যান শুনতেই ভালবাসে।

তুই শুধু আমার জন্য আসিসনি। এই শহরটায় তোর নিজের লোকের অভাব নেই। বন্ধুবান্ধবও অঢেল। আর এনআরআই-দের জন্য কিছু বিশেষ লোক সবসময়, সব জায়গাতেই থাকে। এই সহজ সরল সত্যটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না। তোর ভাগাভাগি? ওহ নেভার।

- কিরে দেখা করবি না? তুই জানতে চাইতি।
আমি কোন না কোনও ভাবে এড়িয়ে যেতাম। তুই জানতেও পারতি না, ঠিক কিভাবে নিজের ইচ্ছেগুলোকে গলা টিপে ধরতাম। নির্দয় ভাবে। বাঁচাতে চাইতাম নিজেকে।
পাগলের মতো তোর পোস্ট দেখতাম। আজ এর সঙ্গে তো কাল তার সঙ্গে। হিংসায় জ্বলে মরতাম।
"পরদেশিয়ো সে না আঁখিয়া মিলা না।"
কাজ করতো আরও একটা ভয়।
জানতাম তো কদিন পরেই তুই চলে যাবি। আসছে বছর আবার হবে। ফের দেখা হবে। একবছর তোকে না দেখে, না ছুঁয়ে কাটাতে হবে। অসম্ভব। আমি জানতাম, আমি ব্যাপারটাকে নিতে পারবো না। তাই দূরে দূরেই থেকে গেলাম। শ্যামার উত্তীয়র মতো।
তুই-ই বা তখন আর আমায় পাত্তা দিবি কেন? তুই তো আর জানতি না, আমি কেন তোকে এড়িয়ে যেতাম।
তারপর একদিন তোর ছুটি ফুরলো। উড়ে গেলি তুই। আর তারপর থেকেই ডেরা বাঁধলি আমার অনুভবে। এযাত্রা তোকে আর ছোঁয়া হলো না।

আচ্ছা শরীর দিয়ে শরীর ছুঁলেই কি 'ছোঁয়া' হয়? নাহলে হয় না? মন দিয়েও তো শরীর ছোঁয়া যায়। যে পুরুষরা মাস্টারবেট করে তাদের মতো। বন্ধুরা কোনদিন হেমামালিনী তো পরদিন রেখাকে ওভাবেই এনজয় করতো। শুধু ছোঁয়া কেন, মন দিয়েই নগ্ন শরীরটা চষে ফেলা। আমি অবশ্য কোনদিনই ওসব পারতাম না। আমার কল্পনার দৌড় অতদূর পৌঁছতোই না।

প্রায় এক মাস হতে চললো তুই ফিরে গেছিস। তাই আজ যখন নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করি- কিরে কেমন লেগেছিলো 'মনের মানুষ'কে ছুঁয়ে? মনে পড়ে নাকি এরইমধ্যে সব ভুলে মেরে দিলি?
চুপ মেরে যাই।

...মনে পড়বেটা কিভাবে?
কোনদিন তো ছুঁইনি তোকে। হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলাম নীতিবাগিশরা যাই বলুক, শরীর ছুঁতে হয় শরীর দিয়েই।
মন দিয়ে মনও কি ছোঁয়া যায়?
হয়তো যায়।
আর রইলো 'বাদবাকী' ছোঁয়াছুঁয়ির গপ্পটা।
তার গোটাটাই তো আমার একলা নিশিথরাতের স্বপ্নপূরণের কাহিনী।
'তাই দিয়ে মনে মনে, রচি মম ফাল্গুনি!'
গোটাটাই মনগড়া।
গল্পের গরুর গাছে চড়া, আর কী !




Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours