সন্দীপ চক্রবর্তী, প্রবীণ সাংবাদিক, কলকাতা:

ভারতীয়ত্ব বলতে কি কোনও জাতিসত্তাকে বোঝায়? প্রশ্নটি ভারতের আজকের প্রেক্ষাপটে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ নিজেকে ভারতীয় বলে পরিচয় দেবার সময় যারা একটি অখণ্ড জাতিসত্তাকে অনুভব করেন তারাই প্রকৃত অর্থে জাতীয়তাবোধ সম্পন্ন। জাতীয়তাবাদ একটি রাজনৈতিক ভাষ্য। এই আলোচনায় ভাষ্যটি তত গুরুত্বপূর্ণ নয়। যে দেশে জাতীয়তাবোধ সম্পন্ন মানুষের সংখ্যা যত বেশি, সেই দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক স্বাস্থ্য তত মজবুত। সন্দেহ নেই, ভারতে জাতীয়তাবোধ সম্পন্ন মানুষের সংখ্যা আগের থেকে বেড়েছে। কিন্তু যতটা বাড়লে ভারতের সামাজিক ও রাজনৈতিক স্বাস্থ্য নীরোগ পদবাচ্য হয়ে উঠতে পারত, ততটা বাড়েনি।
 রোগটা রয়ে গেছে। নয়তো, ভারতে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করার জন্য এবং বাংলাদেশ আফগানিস্তান পাকিস্তান থেকে আসা শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেবার জন্য সংসদ যে আইন প্রণয়ন করেছে তার বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ অযৌক্তিক অসংগত এবং হিংসাত্মক আন্দোলনে এত লোক জুটত না। প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশের একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হবে। গত এক দশকে মায়ানমার সীমান্ত পেরিয়ে প্রায় তিন লক্ষ রোহিঙ্গা মুসলমান বাংলাদেশে অবৈধ অনুপ্রবেশ করেছে। রোহিঙ্গাদের অস্বাভাবিক জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে উদবিগ্ন বাংলাদেশ সরকার তাদের মায়ানমারে ফেরত পাঠাতে চায়।
 এই পরিকল্পনার প্রথম ধাপে এক লক্ষ রোহিঙ্গাকে বঙ্গোপসাগরের ভাসান চরে পুনর্বাসিত করা হয়েছে। এর পরের ধাপে রয়েছে মায়ানমারে ফেরত পাঠানোর বিষয়টি। খোদ বাংলাদেশের বিদেশমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন কবুল করেছেন বাংলাদেশ এবং মায়ানমারের মধ্যে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো নিয়ে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা চলছে। তিনি জানিয়েছেন, বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের ওপর শক্তি প্রয়োগ করবে না। পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করা যাবে বলে বাংলাদেশ সরকার মনে করে। কিন্তু সেইসঙ্গে কিছু হতাশার কথাও তিনি শুনিয়েছেন। যেসব কথার সঙ্গে ভারতের দেশীয় রাজনীতির হর্তাকর্তাদের কাজকর্মের মিল পাওয়া যেতে পারে। মোমেনসাহেবের অভিযোগ, সরকার সব ধরনের অর্থনৈতিক সু্যোগসুবিধা দিলেও রোহিঙ্গারা কক্সবাজারের অস্থায়ী শিবির ছেড়ে ভাসান চরে যেতে চাইছে না। এ ব্যাপারে তাদের ইন্ধন জোগাচ্ছে সমাজসেবী সংগঠনগুলি। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলি যে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন নিয়ে রাজনীতি করছে তার স্পষ্ট প্রমাণ পেয়েছে সরকার। বহু জায়গায় আপত্তিকর লিফলেট ব্যানার বইপত্র আটক করা হয়েছে। গ্রেপ্তারও হয়েছেন কয়েকজন। বাংলাদেশের রোহিঙ্গা সমস্যা রাষ্ট্রসংঘের বিবেচনাধীন। তবে মোমিনসাহেবের কথায়, রাষ্ট্রসংঘ যদি রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার জন্য মায়ানমারকে বাধ্য করতে নাও পারে, বাংলাদেশ সরকার অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের দেশের মূল ভূখণ্ড থেকে সরিয়ে ভাসান চরে পুনর্বাসন দেওয়ার ব্যাপারে বদ্ধপরিকর।
 কিন্তু প্রশ্ন হল, বাংলাদেশ সরকারের এই সিদ্ধান্তকে সে দেশের সাধারণ মানুষ কীভাবে নিচ্ছেন? তারা কি শাসক আওয়ামি লিগের বিরোধী দলগুলির রাজনৈতিক আখের গোছাতে মানছি না মানব না লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে প্রতিবাদ করছেন? বাসে ট্রেনে আগুন লাগানো হচ্ছে? রেলের কাউন্টারে কি লুটপাট চলছে? ছাত্র-ছাত্রীরা কি জঙ্গিদের কায়দায় পুলিশের মাথা লক্ষ করে পাথর ছুড়ছে? ওখানকার নেতানেত্রীরা কি কাকসংগীত শুনিয়ে লোক খেপানোর চেষ্টা করছেন? বাংলাদেশের সৌভাগ্য এসব কিছুই সেখানে হচ্ছে না। বস্তুত, জামাত, হেফাজতের মতো কিছু মৌলবাদী সংগঠন এবং বিএনপির কিছু ধর্মান্ধ নেতা ছাড়া রোহিঙ্গাদের পাশে কেউ নেই। মোমিনসাহেব জানিয়েছেন, বাংলাদেশের শিক্ষিত সমাজ রোহিঙ্গাদের ভাসান চরে পুনর্বাসন দেওয়ার পক্ষে। তারা বুঝতে পেরেছেন, রোহিঙ্গা সমস্যার সুষ্ঠ সমাধান না করতে পারলে মাত্রাতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপে বাংলাদেশের অর্থনীতি ভেঙে পড়বে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের শিক্ষিত মানুষ জানেন, এমনিতেই বাংলাদেশে আইএস আল কায়দা তালিবানদের গতিবিধি বাড়ছে। জঙ্গি স্বভাবের রোহিঙ্গারা সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীগুলির তুরুপের তাস হয়ে উঠতে পারে। সেরকম হলে ছারখার হয়ে যাবে সোনার বাংলাদেশ। তাই তারা সরকারের সিদ্ধান্তকে সমর্থন জানিয়েছেন। অন্তত এই একটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশের শিক্ষিত ও সাধারণ মুসলমান সমাজ ধর্মের আগে দেশকে রেখেছেন। তা না হলে ইসলাম-নির্দিষ্ট মুসলিম ভ্রার্তৃত্বকে উপেক্ষা করে তাদের পক্ষে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ভাসান চরে পুনর্বাসন দেবার সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়া সম্ভব হত না।
 ভারতের ছবিটা বাংলাদেশের ঠিক উলটো। নাগরিক পঞ্জিকরণ এবং নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের উদ্দেশ্য অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করা ও প্রকৃত শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেওয়া। কিন্তু এ দেশের বাম এবং ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলির দাবি কেন্দ্রীয় সরকারের এই সিদ্ধান্ত সংবিধান বিরোধী। এই আইন বৈষম্যমূলক। কারণ এই আইনে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের নাগরিকত্ব দেবার কথা বলা হয়নি। সুতরাং প্রতিবাদের নামে শুধু পশ্চিমবঙ্গেই রেলের ৭০ কোটি টাকার সম্পত্তি নষ্ট করা সংবিধান সম্মত। গুজরাতে গান্ধীজীর মূর্তি ভাঙা যুক্তিসংগত। অসহায় নিরিহ রেলযাত্রীদের সাক্ষাত মৃত্যুর মুখোমুখি দাড় করিয়ে দূর থেকে শ্লোগান দেওয়া ন্যায়সংগত। অথচ এইসব দলের নেতারা বাংলাদেশ সরকারের সিদ্ধান্ত নিয়ে মুখ খোলেন না। আফগানিস্তান পাকিস্তান এবং বাংলাদেশে প্রচলিত জাতীয় নাগরিক পরিচয়পত্র নিয়েও তাদের কিছু বলতে শোনা যায় না। তারা জানেন কে নাগরিক আর কে নয় সেটা স্পষ্ট না করে কোনও দেশ তার নাগরিককে পরিচয়পত্র দিতে পারে না। তবুও তারা চুপ করে থাকেন। আর ভারত যখন তার নাগরিককে পরিচয়পত্র দেবার কথা ভাবে এবং তার জন্য নাগরিক পঞ্জিকরণ করার সিদ্ধান্ত নেয়, ঠিক তখনই তারা সদলবলে মাঠে নামেন। তাদের মনের কথাটি হল, অন্য দেশ যা পারে করুক, ভারত করলে চলবে না। কারণ পঞ্জিকরণ হলে যারা বাদ পড়বেন তারা সবাই অবৈধ অনুপ্রবেশকারী মুসলমান। এত বড়ো ভোটব্যাঙ্ক কি নষ্ট হতে দেওয়া যায়? এদের ভোটেই তো এইসব দল এতকাল জিতে এসেছে। এরা না থাকলে তো এইসব দলের অস্তিত্বই লুপ্ত হয়ে যাবে। প্রতিবাদ তাই এমন জোরালো। আন্দোলন তাই এমন রক্তক্ষয়ী।
  শেষে আমাদের আবার ফিরে যেতে হবে সেই শুরুর প্রশ্নে। জাতিসত্তার প্রশ্নে। যতদিন না আমরা ভারতীয়ত্ব বলতে এক অখণ্ড জাতিসত্তাকে অনুভব করব ততদিন ভোট এবং ক্ষমতার যূপকাষ্ঠে দেশকে বলি দেওয়া চলবে। আমরা যতদিন হিন্দু-মুসলমান ভাবব ততদিন ভারতীয়ত্বের নির্মাণ হবে না। আমরা যেদিন থেকে উপাসনা পদ্ধতির আড়াল সরিয়ে সংস্কৃতি হিসেবে ধর্মকে দেখব সেইদিন শুরু হবে ভারতীয় জাতিসত্তার নির্মাণ।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours