কাজল ভট্টাচার্য, কার্টুনিস্ট ও সিনিয়র জার্নালিষ্ট, কলকাতা:

একটু চালাকি করেছিলাম সেদিন।
আগুনটা মুখে না ছুঁইয়ে, তা ছুঁইয়েছিলাম মুখের ঠিক পাশে।
এবার আর তা করলাম না। আগুন ছোঁয়ালাম সরাসরি বন্ধ ঠোঁটেই। হাত কেঁপেছিলো ঠিকই, কিন্তু পাত্তা দিইনি। গত ন'বছরে অনুভূতিগুলির রং ব্যাপক পাল্টে গেছে।

প্রথম শরীরটার নাম ছিল মামনি।
যখন কাকুর বিয়ে হয়েছিলো, তখন আমি দশেও পা দেইনি। মা শিখিয়েছিল, কাকিমাকে মামনি বলে ডাকতে।
ন'বছর আগে সেদিন, সেই মামনির শরীরটাই ছিল স্পন্দনহীন। কাঠের চিতাতে শয়ন। সন্তানহীন। তাই আমার ওপর দায়িত্ব পড়েছিল মুখাগ্নির।

পাটকাঠির আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিলো আমার হাতে। পন্ডিতমশাই বলেছিলেন, মামনির হালকা ফাঁক হয়ে থাকা সেই মুখে জ্বলন্ত পাটকাঠির আগুন ছোঁয়াতে।
পারিনি। এতদিন যে মুখে "কাজু" ডাক শুনেছি, সেই মুখটায় আগুনের ছেঁকা দেওয়া? সিম্পলি ইমপসিবল।

আমার সামনে চিতায় যে নারীশরীরটাকে শোয়ানো হয়েছিল, হোক সে নিষ্প্রাণ, কিন্তু শরীরটা তো আমার সেই মামনির।
মৃত শরীরটার নাহয় কোনও অনুভূতি ছিল না। কিন্তু আমি তো সুস্থ, জীবন্ত এক মানুষ। আমার অনুভূতি তো ষোল আনা।
সম্পর্কের আবেগটা তো মারা যায়নি। তাহলে? মামনির মৃত শরীরটা আমার কাছে মূল্যহীন?
কোন মূর্খটা বলে এ কথা!

কথাটা ঘুরেফিরে যথাস্থানে, কাকুর কানে পৌঁছেছিল।
"সেকি রে? মুখাগ্নি তো তোকেই করতে হবে," কাকু বলেছিল। "তোকেই তো নিজের ছেলে ভাবত তোর মামনি।"
খুব নিষ্ঠুর মনে হয়েছিল সেদিন কাকুকে। যে মহিলার সঙ্গে এতদিন ঘর করল, তার মুখে আগুন দেওয়ার ফরমান জারি করছে! এতটুকু দয়ামায়া নেই?

আর একটা স্থায়ী সর্বনাশ হয়ে গেছিল সেদিন।
খুব ঘেন্না ধরে গেছিল স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কের ওপর। মনে মনে ঠিক করেছিলাম, আমাদের দাম্পত্যের সম্পর্কটা এরকম হবে না।

"জীবনমরণের সীমানা ছাড়ায়ে
বন্ধু হে আমার, রয়েছ দাঁড়ায়ে।।"

"তোমার হাতের আগুন না পেলে, তোমার কাকিমা মুক্তি পাবে না," পন্ডিতমশাই তার জ্ঞান ফলালেন।
- "যাও, আগুনটা মুখে দাও দিখিনি।"
দামোদর নদের বালিয়ারিতে তখন নাটক জমে গিয়েছে। আত্মীয় স্বজন, পরিচিতজন সবাই আমাকে বুঝিয়ে চলেছেন, মুখাগ্নি করলে কত পূণ্য হয়। ওদিকে কাকুর ভাবখানা এরকম, যেন আমি কত অপরাধ করে ফেলেছি!
মৃত মামনির মুক্তির জন্য কত উদগ্রীব পাঁচজন।
আমিই ব্যতিক্রম।

সব বেটা বদলা নিতে চাইছিল সময় বুঝে।
হঠাত করেই এ কথাটা মনে হয়েছিল আমার।
বেশ দাপুটে মহিলা ছিল মামনি। চাকরি করত। রোজগেরে বলে "পূর্ণ স্বরাজ" আদায় করতে পেরেছিল। বেশ স্পষ্ট ভাষায় কথা বলত। ওসব আত্মীয়-টাত্মীয়কে পাত্তাই দিত না।
কাকুরও ক্ষমতা ছিল না, মামনির ওপর গার্জিয়ানি ফলায়। তাই মনে হয়েছিল, মামনিকে বাগে পেয়ে সবাই সেদিন জমাখাতার শোধ তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল।
সুযোগ বারবার আসে না।
এ সুযোগ শেষ সুযোগ।
আর মুরগি আমি!

ব্যাস, জেদ চেপে গেছিল আমার মাথায়।
শালা, কিছুতেই আগুন দেব না মুখে। ভেস্তে দেব ষড়যন্ত্র।
মৃতা তো আমার মামনি। বহু ধমক ধামক খেয়েছি আমিও। চড় থাপ্পড়ও যে খাইনি তা নয়। পড়াশোনায় একটু এদিক ওদিক হলেই মুশকিল। আবার কাকুকে মামনিই বলেছিল, "আরে বাবা, দাও না কাজুকে বাইকটা কিনে।"

আর কোনও তর্কে যাইনি।
পাটকাঠিতে ফের আগুন ধরানো হয়েছিল। সেই আগুন হাতে ধীর পায়ে এগিয়ে গেছিলাম চিতার দিকে। সবার নজর তখন আমার ওপর।
টানটান উত্তেজনা। মনে হচ্ছিল, সৎকার আসরের শিরোমণি আমিই।

জীবনের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখেছি, আমার এনট্রি মানে আমিই সব। নাটের গুরু। মরণের বেলাতেও সেই নিয়মের ব্যতিক্রম হলো না।
হালকা ফুরফুরে হাওয়া বইছিল দামোদরের। যেন মামনিকে নিয়ে সেই হাওয়াতেই ভেসে যাবে মরণরথ। চারদিক তমসাচ্ছন্ন। দূরে কালীমন্দির। দেবীও কি আমার দিকে ড্যাবা-ড্যাবা চোখে আমাকে নজর করছিলেন? তা করলে করুন।
আমার যা করার তাই করেছিলাম।
আমার হাত দেড়েক দূরে মামনির মুখ।
চোখে নাকে তুলসি পাতা গোঁজা। যেন জীবন্ত মানুষের এই বিশ্বাসঘাতকতা, বিভৎসতা দেখতে না পায়। ষড়যন্ত্রের গন্ধও না যায় নাকে।
অসহায় মুখ।
জীবনে হয়ত এই প্রথম আত্মসমর্পণ, মৃত্যুর কাছে। আর কোনদিন মামনি "কাজু" বলে ডাকবে না।
এক মুহূর্তের শূণ্যতা।
পাটকাঠির আগুন ছুঁইয়ে দিলাম মামনির মুখের ঠিক পাশটাতে।

শ্মশানবন্ধুরা সব হইহই করে বাড়ি ফিরছে। আমি খানিক আলাদা। কাকু ব্যস্ত সবাইকে মিষ্টিমুখ করাতে। এতদিনের সঙ্গীটা যে চলে গেল, তার জন্য এতটুকু নীরবতা, শোকপালন নেই।
একবারও কি সেদিন মনে হয়নি, একজনকে ছেড়ে ফিরছি। আর কোনও দিন সে ঘরে ফিরবে না।

আমিও তো একদিন এ ভাবেই চলে যাব!
এই লোকগুলো সেদিনও আমাকে এমন করেই চিতায় তুলে দেবে। তারপর দাঁত কেলিয়ে রসগোল্লা গিলবে। দাহকাজও যেন এক উৎসব।

মেজাজ বিগড়ে গেছিল ওই নির্বোধ লোকগুলোর ওপর। কিছু একটা শিক্ষা দেওয়া দরকার এদের। মৃতকে যারা সম্মান জানাতে শেখেনি, তারা মানুষ পদবাচ্য না কিছুতেই।

কাকুকে ঘিরে আছে আত্মীয়-স্বজনরা। এগিয়ে গেলাম নিঃশব্দ পায়ে, চিতার মতো। সামনে এক পাল শিকার। কাকুকে বললাম, "আমি কিন্তু মামনির মুখে আগুন ছোঁয়াতে পারিনি।"
মুহূর্তে চুপসে গেল সব মুখ। কাকুর চোখে দেখতে পেলাম চিতার আগুন।

"তোর মামনির নিজের সন্তান না বলেই, এরকমটা করলি।" কাকুর ব্যখ্যা।
তবুও গর্বোদ্ধত আমি। 'যা করেছি ঠিক করেছি!' আমার মনের কাছে, পরিষ্কার ছিলাম আমি।
তাই সেই অপবাদ, খুশি মনে, ন'বছর বয়ে বেড়িয়েছি।

তারপর এই সেদিন হঠাতই মারা গেল কাকু। আবার সেই মুখাগ্নি। এবার আর কোনও সেন্টিমেন্টকে পাত্তা দিলাম না। আমার সামনে শোয়ানো প্রাণহীন কাকু। এবারেও পন্ডিতমশাই পাটকাঠিতে আগুন দিলেন। তিনি বলামাত্রই এগিয়ে গেলাম আমি। জ্বলন্ত পাটকাঠি ছুঁইয়ে দিলাম কাকুর বন্ধ ঠোঁটে। এবারেও কি একটু হাত কেঁপেছিল আমার? ঠিক বুঝতে পারিনি। কে জানে, আজ আমিও আদৌ বেঁচে আছি কিনা !

তবে ঠিক বুঝতে পারলাম না, কাকুর মুখে আগুন দিয়ে ন'বছর ধরে পুষে রাখা রাগের শোধ তুললাম নাকি, পুত্রবৎ হওয়ার প্রমাণ দিলাম।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours