কাজল ভট্টাচার্য, কার্টুনিস্ট ও সিনিয়র জার্নালিষ্ট, কলকাতা:

মনের কথা আজ বলেই ফেল।
বছরটা শুরু হোক তোর মনের কথা শুনেই। যে কথা এতদিন বলতে পারিসনি। গুমড়ে মরেছিস। সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারে বসে শুধু জলের ঢেউ গুনেছিস। ভেবেছিস, আজ থাক। পরে নাহয়, কোনদিন বলা যাবে। আর তো কয়েকটা দিন। 2019 টা শেষ হোক। নতুন বছর নতুন ছুটি। ফের একবার দেশে ফিরে যাওয়া। তখনই নাহয় বলা যাবে।

"সন্ধ্যা বেলায়। তুমি আমি বসে আছি দুজনে
তুমি বলবে আমি শুনবো......"
"ওই গানের নায়িকার মতোই সব বলবো।
চোখে চোখ রেখে সেকথা বলবো। সব শুনবো গায়ে গা লাগিয়ে। প্রিন্সেপ ঘাটে গঙ্গার ছলাত। জানিস, দেশের নদীর এক আলাদা গন্ধ আছে। গত সতেরো বছরেও, টেমসের গায়ে সেই গন্ধ পাইনি কখনও।"

একেই বলে শেকড়ের টান। ভারতের গোলাপ ইংল্যান্ডে ফুটলেও গন্ধটা বদলে যায়। রংটাতেও হেরফের হয়। যার যেখানে শেকড়। পরবাসে উদ্বাস্তু। তা সে যতোই নাগরিকত্ব পাও না কেন। তাই এত কষ্ট সহ্য করেও ভিটেমাটি আঁকড়ানো। ছেড়ে যেতে যেতেও ফিরে চাওয়া। শূন্য ফেলে যাওয়া কুলুঙ্গিটার জন্যও মন টানে।
তারপর, নতুন বছরে পুরনোর কাছে ফিরে আসা। জীবনটা কি গোল এক বৃত্ত? গোল বলেই এত গোলমাল? হবে হয়ত।

"উঠোনের শিউলি গাছটার ঝরে পড়া কয়েকটা ফুল নিয়ে এসেছিলাম। ওতেই যেন লুকোনো ছিলো ফেলে আসা সেই বাড়ির গন্ধ।"
দিন গেছে শিউলি শুকিয়েছে। অতীতের মিষ্টি গন্ধও বদলে গেছে। একসময় নির্মম ভাবে ফেলে দিতে হয়েছে সেই পূতিগন্ধময় অতীতকে। তবু সেই বিচ্ছিরী কটূ গন্ধ আজও নাকে লেগে। রাত গভীর হলে সেই গন্ধ আজও পাই। অস্থির লাগে। দমবন্ধ হয়ে আসে। ইনহেলারের পাফ নেই। আরও একবার বেঁচে উঠি। উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করি তোর হাত ধরে। নবউদ্যমে।
আমার সেই সবহারানো অতীতের কথা তোকে শোনাবো বলেই তো বসে আছি।

শুনবো, তোর হারানো অতীতের কথা। চাপা পড়ে থাকা তোর কথা। তোর সব, সবকথা।
"মনের কথা।"
আজও সেসব কথা ছড়ানো ছিটোনো নীল আরব সাগরের বালিয়ারিতে। আর কতদিন খুঁজে বেরাবি সেসব? শেষ সূর্যাস্তের আলোতে যা যায়, তা যায়। কালের ঢেউ সব মুছে দিয়ে যায়।
নতুন ভোরের আলোকে বরণ করেনে। তোর দু'চোখেও ছায়া মেলে ভোরের সাগর। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারি না। মনে হয় ডুবে যাচ্ছি তোর সাগর নীলচোখের গভীরে। জানিস তো, আমি আবার সাঁতার কাটতে পারি না।

বছরের প্রথম রাত।
পার্টি থেকে ফিরে দোতলার ব্যালকনিতে বসে আছিস? চোখ আকাশের দিকে। রাতের আকাশ সব জায়গাতেই বোধহয় একরকম। ভীষণ হাতছানি দেয়। হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে ওই তারার দেশে। অসাবধান হলেই চোখটাও ঝাপসা হয়ে ওঠে। গলা ঠেলে বেরিয়ে আসতে চায় "মনের কথা"। পাশেই পড়ে মোবাইলটা। খানিকটা অজান্তেই তোর হাত চলে যায় সেদিকে।
"না থাকুক। আজ না। গিয়েই বলবো।"

জানি, খুব টানাপোড়েনে থাকিস আমায় নিয়ে। ফেসবুক খুললেই অজস্র শুভেচ্ছা- হ্যাপি নিউ ইয়ার। শতসহস্র জনের মধ্যে ছড়িয়ে আমি। গোদা ভাষায়, কলির কেষ্ট। আরও অনেককিছুই বলা যায়। লেখা যায় না। আসলে ছন্নছাড়া মানুষ আমি। সভ্য নগরজীবনে কোনদিনই ছিলাম না।
বছরের ক্যালেন্ডারের মতোই জীবন আমার। যার দরকার হয়েছে পাতা উল্টেছে। চলে গেছে। বারো মাসে বারো রং সেই পাতার। কখনও উষ্ণ তো কখনও হিমশীতল। আবার বসন্তে চঞ্চল। আষাড়ের বৃষ্টি হয়ে ঝরি। আকাশ থেকে মাটিতে আছড়ে পড়ি। গড়াগড়ি খাই। তোদের ছাদ আছে। ছাতা আছে। আমার ছাদটা আছে। ছাতিটা হারিয়ে ফেললাম বছরশেষে।
কতজনকে পেছনে ফেলে নতুনে ঢুকে পড়লাম, কে তার হিসেব রাখে। আমার সমুদ্র নেই। নীলঘণ আকাশও নেই। আমার জনারণ্য আছে। সহস্র চেনামুখ। চেনামানুষ নেই।
আমার এক আকাশ আছে। সেখানে 'গাভীরা চড়ে না'। আকাশের বুকচিড়ে উড়ে যায় হাওয়াই জাহাজ। কোথায় যায় কে জানে। হয়তো তোর দেশে!
"যাও প্লেন বোলো তাকে
সে যেন ভালো থাকে!"
কলির কালিদাস বলে মুখ বেঁকাবি? আবার ওতেই হয়তো কেউ 'ক্রাস' খাবে। তখন আবার তুই কথা শোনাবি। বেড়ে যাবে বুকের ধুকপুকানি। তবে বাঁ দিকের না। কারণ আমি আজ মোটেই বামপন্থী না। সেও এক বড় বিশ্বাসভঙ্গের ইতিহাস।
এ ধুকপুকানি ডানদিকের। নিকোটিনের সোহাগে ঢাকা পড়ছে ফুসফুস। ফোঁসফোঁসের গতি কমছে। তবু লড়াই চলছে। গতবছর হারিনি। এবছর কী হবে জানি না।
আর কেই বা তার কথা জানে? জ্যোতিষিদের কথা আলাদা। তারা সবজান্তা। গুষ্ঠিসুদ্ধ পাবলিকেরটা জানে, শুধু নিজেরটা ছাড়া।

সঞ্চয়ের ভাঁড়ার অনেকটা ক্ষয়ে গেল ভরসার। শিখিয়ে গেল সেই আপ্তবাক্য- এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে তুমি একা। দোকা আগেও ছিলাম না। হয়তো কোনদিনই না। দোকা ভাবতে ভালবাসতাম নিজেকে। প্রতিবছর একই শিক্ষা দিয়ে চলেছে সময়। মাথামোটা নাকি বেহায়া ছাত্র? কিছুতেই কোনও কথা শুনতে চায় না।
আজও 'মনের কথা' শোনার অপেক্ষায় রাত জাগি। নতুন বছরের প্রথম রাত। সেই রাত কেটে এখন দিন। পাশের ফ্ল্যাটে এফ এমে বেজে চলেছে-
"আমি হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল
শুধাইলো না কেহ........................."

"মনের কথা" মনেই থেকে গেল।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours