আনন্দিতা রায়, লেখিকা ও সঙ্গীত শিল্পী, দুর্গাপুর:
শৈশবের মা ঠাকুমা পিসিমা দিদি মারা ছোটদের সবুজ মনকে পরীদের দেশে সুয়োরানী দুয়োরানীর রাজ্যে পক্ষীরাজ ঘোড়ায় করে জল স্থল ব্যপ্ত করে চেতনার প্রবাহ প্রত্যেক রোমকূপ থেকে সরিয়ে স্বপ্নের দেশে নিয়ে যেতেন ঘুমের ভেলায় চড়ে। অনির্বচনীয় সে যাত্রা। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে চিন্তা করতেন গভীরভাবে, কিন্তু আমরা কোনদিনই তাদের হাঁড়ি হেঁশেলের বাইরের জগতে আনতে চাইনি--তাদের মনের মধ্যেও যে কত সুক্ষ্ম জীবনবোধ, দার্শনিক চিন্তা, প্রখর দৃষ্টি ভঙ্গি ছন্দে সুরে গানে লয়ে পুলকিত মুকুলিত হয়ে প্রতিদিন ঝরে পড়েছে জীবনের বিভিন্ন খন্ড খন্ড মুহূর্তে অর্থপূর্ণ ছড়াতে তা আমরা অবহেলা ভরে শুনে মুচকি হেসেছি মাত্র, এর মূল্য অনুভব করতে চাইনি কোনদিনই।
মানুষ যখন শহরবাসী- যান্ত্রিক হয়নি যখন বেশিরভাগ মানুষ ছিল গ্রামবাংলার পল্লী মুখী জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত তখনকার সেই পল্লী সমাজে পুরুষপ্রধান একান্নবর্তী পরিবারে অন্তঃপুরবাসিনী স্ত্রী সমাজ সহজ কুলাচার ও গার্হস্থ্য বৈশিষ্ট্য এবং সেইসঙ্গে পালা পার্বন ব্রত উপাসনা ত্যাগ করতে না পারলেও তারা ছিলেন অফুরন্ত জীবনীশক্তির অধিকারিনী, সময় সচেতন ও অত্যন্ত রসিক -স্বভাব। তাদের স্বভাবের রুক্ষতা সাময়িকভাবে স্থায়ী হতো। তাদের সৃষ্ট গভীর জীবনানুভূতি মিশ্রিত ছড়া গুলিতে এমন অমোঘ সত্য ব্যক্ত করেছেন যা মুখে মুখে যেন এক একটি চলতি প্রবাদ হয়ে রয়ে গেছে, যেমন, "বামুন গেল ঘর (তো) লাঙ্গল তুলে ধর",বা "বেকায়দায় পড়লে হাতি চামচিকি তে মারে লাথি"ইত্যাদি বাংলাদেশের এই ছড়া গুলি স্বরবৃত্ত ছন্দে বা syllabic Mitre এ রচিত। বাংলাদেশের গ্রামীণ লোক সাহিত্য বহুদিন থেকেই এই ছন্দে রচিত হয়ে আসছে। ঘুমপাড়ানি গানে, বারো মাসে তেরো পার্বণ এর ব্রতকথা য়, গ্রাম্য সঙ্গীতে কবি গানে এর প্রচলন দেখা যায়। সংলগ্ন লোকায়ত শিল্পচর্চা অর্থাৎ আলপনা পটচিত্র মাটির তৈরি জিনিসে নানা অলঙ্করণে তার ছাপ স্পষ্ট। তাই স্বরবৃত্ত ছন্দের অন্য নাম লৌকিক ছন্দ বা ছড়ার ছন্দ। এই ছন্দের সকল প্রকার অক্ষর একমাত্রা হয়। লয় দ্রুত হয় এবং মূল পর্ব চারমাত্রা হয়।
যেমন--"বড় সাধ/ যায় গো চিতে ৪+৪
গোদা পায়ে /আলতা দিতে ৪+৪
এই ছন্দে আবৃত্তি করার সময়ে বাগযন্ত্রে এক ধরনের ক্ষিপ্রতা আসে। ফলে দ্রুতলয়ের সৃষ্টি হয়। এইজন্য কেউ কেউ একে ধামালি ছন্দ বলে থাকেন। ধামালি অর্থাৎ ধাবমান। দ্রুতগতি ভঙ্গির ব্যঞ্জনা শব্দটির মধ্যে ফুটে ওঠে। ছন্দ একটি শাস্ত্রগত ও পুথিগত ব্যাপার হলেও যেখানে প্রকৃতি পারিপার্শ্বিকতা তথা চলমান জীবনের ছায়া না পড়লে সৃষ্টিশীল মন ও কল্পনা শক্তি বিকশিত হওয়ার অবকাশ পায় না --অনেক ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা তথা স্বকীয় অনুভব প্রচ্ছন্নভাবে গভীরতায় লীন হয়ে থাকে ছন্দকে ঘিরে।
যেকালে এইসব ছড়ার উৎপত্তি সেই সময় মেয়েরা ন্যূনতম শিক্ষাটুকু থেকে বঞ্চিত ছিলেন। নিরক্ষরতার অন্ধকার তখন ঘরে ঘরে। তা সত্ত্বেও যে কি করে তারা এইসব মৌখিক ছড়া রচনা করেছিলেন তা ভেবে অবাক হতে হয়। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে পারিপার্শ্বিক শিক্ষার ভিত্টি খুবই দৃঢ়। সময় যত এগিয়েছে সভ্যতা যত গতিশীল হয়েছে মেয়েদের শিক্ষার সুযোগ ততই গেছে বেড়ে। ঘর ছেড়ে তারা ছড়িয়ে পড়েছেন নানা ভূমিকায় নানা ক্ষেত্রে নানা কর্মকাণ্ডে। ব্যাকরণগত বিচারে ভাষার প্রয়োগে ছড়াগুলি হয়তো ত্রুটিমুক্ত নয়, কিন্তু তারা ছড়াগুলি কে যেসব শব্দ চয়ন করে, যে ছন্দে, যে কাঠামোতে বেঁধে দিয়েছেন তাকে পরিবর্তিত করতে গেলে পল্লী বাংলার রাঙামাটির সেই সোঁদা গন্ধ টি উবে গিয়ে ছড়ার অপকর্ষ সাধিত হবে। যেমন:-
"যেমন তেমন বিয়ে দেবো/ বয়স কালে রুপ দেখাবো"
বা
"কালো জামা রুক্ষু মাথা দুঃখু বলে যাবো কোথা।" ইত্যাদি।
সব ছড়াই যে নারী সৃষ্ট তা কিন্তু নয় তবে এর অধিকাংশই মহিলা সমাজে প্রচলিত ছিল। তারা কাজের সময়, অবসর সময় ছকে বাঁধা জীবনের একঘেয়েমি কাটাতে একে-অপরের সাথে ছড়া কেটে কেটে কথা বলতেন। মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজে বহুল প্রচলিত এই ছোটখাটো আকৃতির ছড়াগুলির রচয়িতা পুরুষ না নারী তার চুলচেরা বিচার বিশ্লেষণের চেষ্টা করা খুব বুদ্ধিমান এর কাজ হবে না যদিও পড়তে পড়তে জানতে ইচ্ছে করে সৃষ্টিকর্তা বা কর্ত্রী র রসিক মনটিকে। তবু রহস্য বর্তমান থাকায় যে রস আছে রহস্য উদঘাটনে তা নেই। কোন নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে এসব রচিত হয়নি, তথা নির্দিষ্ট কোন পাণ্ডুলিপিতে মুক্তাক্ষর এদের সাজানো হয়নি। উদ্দেশ্যভিত্তিক রচনায় যান্ত্রিকতা থাকে সৃষ্টির আনন্দ ঢাকা পড়ে যায় এক্ষেত্রে তা হয়নি। তাদের উদ্দেশ্য ছিল একটাই তা হল জীবনের ছোট ছোট আনন্দ উপভোগ করা পারিবারিক আবহাওয়ায়। তাই এই ধরনের ছড়া এক স্বতন্ত্র বস্তু-তা মৌখিক। (ক্রমশ)
শৈশবের মা ঠাকুমা পিসিমা দিদি মারা ছোটদের সবুজ মনকে পরীদের দেশে সুয়োরানী দুয়োরানীর রাজ্যে পক্ষীরাজ ঘোড়ায় করে জল স্থল ব্যপ্ত করে চেতনার প্রবাহ প্রত্যেক রোমকূপ থেকে সরিয়ে স্বপ্নের দেশে নিয়ে যেতেন ঘুমের ভেলায় চড়ে। অনির্বচনীয় সে যাত্রা। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে চিন্তা করতেন গভীরভাবে, কিন্তু আমরা কোনদিনই তাদের হাঁড়ি হেঁশেলের বাইরের জগতে আনতে চাইনি--তাদের মনের মধ্যেও যে কত সুক্ষ্ম জীবনবোধ, দার্শনিক চিন্তা, প্রখর দৃষ্টি ভঙ্গি ছন্দে সুরে গানে লয়ে পুলকিত মুকুলিত হয়ে প্রতিদিন ঝরে পড়েছে জীবনের বিভিন্ন খন্ড খন্ড মুহূর্তে অর্থপূর্ণ ছড়াতে তা আমরা অবহেলা ভরে শুনে মুচকি হেসেছি মাত্র, এর মূল্য অনুভব করতে চাইনি কোনদিনই।
মানুষ যখন শহরবাসী- যান্ত্রিক হয়নি যখন বেশিরভাগ মানুষ ছিল গ্রামবাংলার পল্লী মুখী জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত তখনকার সেই পল্লী সমাজে পুরুষপ্রধান একান্নবর্তী পরিবারে অন্তঃপুরবাসিনী স্ত্রী সমাজ সহজ কুলাচার ও গার্হস্থ্য বৈশিষ্ট্য এবং সেইসঙ্গে পালা পার্বন ব্রত উপাসনা ত্যাগ করতে না পারলেও তারা ছিলেন অফুরন্ত জীবনীশক্তির অধিকারিনী, সময় সচেতন ও অত্যন্ত রসিক -স্বভাব। তাদের স্বভাবের রুক্ষতা সাময়িকভাবে স্থায়ী হতো। তাদের সৃষ্ট গভীর জীবনানুভূতি মিশ্রিত ছড়া গুলিতে এমন অমোঘ সত্য ব্যক্ত করেছেন যা মুখে মুখে যেন এক একটি চলতি প্রবাদ হয়ে রয়ে গেছে, যেমন, "বামুন গেল ঘর (তো) লাঙ্গল তুলে ধর",বা "বেকায়দায় পড়লে হাতি চামচিকি তে মারে লাথি"ইত্যাদি বাংলাদেশের এই ছড়া গুলি স্বরবৃত্ত ছন্দে বা syllabic Mitre এ রচিত। বাংলাদেশের গ্রামীণ লোক সাহিত্য বহুদিন থেকেই এই ছন্দে রচিত হয়ে আসছে। ঘুমপাড়ানি গানে, বারো মাসে তেরো পার্বণ এর ব্রতকথা য়, গ্রাম্য সঙ্গীতে কবি গানে এর প্রচলন দেখা যায়। সংলগ্ন লোকায়ত শিল্পচর্চা অর্থাৎ আলপনা পটচিত্র মাটির তৈরি জিনিসে নানা অলঙ্করণে তার ছাপ স্পষ্ট। তাই স্বরবৃত্ত ছন্দের অন্য নাম লৌকিক ছন্দ বা ছড়ার ছন্দ। এই ছন্দের সকল প্রকার অক্ষর একমাত্রা হয়। লয় দ্রুত হয় এবং মূল পর্ব চারমাত্রা হয়।
যেমন--"বড় সাধ/ যায় গো চিতে ৪+৪
গোদা পায়ে /আলতা দিতে ৪+৪
এই ছন্দে আবৃত্তি করার সময়ে বাগযন্ত্রে এক ধরনের ক্ষিপ্রতা আসে। ফলে দ্রুতলয়ের সৃষ্টি হয়। এইজন্য কেউ কেউ একে ধামালি ছন্দ বলে থাকেন। ধামালি অর্থাৎ ধাবমান। দ্রুতগতি ভঙ্গির ব্যঞ্জনা শব্দটির মধ্যে ফুটে ওঠে। ছন্দ একটি শাস্ত্রগত ও পুথিগত ব্যাপার হলেও যেখানে প্রকৃতি পারিপার্শ্বিকতা তথা চলমান জীবনের ছায়া না পড়লে সৃষ্টিশীল মন ও কল্পনা শক্তি বিকশিত হওয়ার অবকাশ পায় না --অনেক ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা তথা স্বকীয় অনুভব প্রচ্ছন্নভাবে গভীরতায় লীন হয়ে থাকে ছন্দকে ঘিরে।
যেকালে এইসব ছড়ার উৎপত্তি সেই সময় মেয়েরা ন্যূনতম শিক্ষাটুকু থেকে বঞ্চিত ছিলেন। নিরক্ষরতার অন্ধকার তখন ঘরে ঘরে। তা সত্ত্বেও যে কি করে তারা এইসব মৌখিক ছড়া রচনা করেছিলেন তা ভেবে অবাক হতে হয়। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে পারিপার্শ্বিক শিক্ষার ভিত্টি খুবই দৃঢ়। সময় যত এগিয়েছে সভ্যতা যত গতিশীল হয়েছে মেয়েদের শিক্ষার সুযোগ ততই গেছে বেড়ে। ঘর ছেড়ে তারা ছড়িয়ে পড়েছেন নানা ভূমিকায় নানা ক্ষেত্রে নানা কর্মকাণ্ডে। ব্যাকরণগত বিচারে ভাষার প্রয়োগে ছড়াগুলি হয়তো ত্রুটিমুক্ত নয়, কিন্তু তারা ছড়াগুলি কে যেসব শব্দ চয়ন করে, যে ছন্দে, যে কাঠামোতে বেঁধে দিয়েছেন তাকে পরিবর্তিত করতে গেলে পল্লী বাংলার রাঙামাটির সেই সোঁদা গন্ধ টি উবে গিয়ে ছড়ার অপকর্ষ সাধিত হবে। যেমন:-
"যেমন তেমন বিয়ে দেবো/ বয়স কালে রুপ দেখাবো"
বা
"কালো জামা রুক্ষু মাথা দুঃখু বলে যাবো কোথা।" ইত্যাদি।
সব ছড়াই যে নারী সৃষ্ট তা কিন্তু নয় তবে এর অধিকাংশই মহিলা সমাজে প্রচলিত ছিল। তারা কাজের সময়, অবসর সময় ছকে বাঁধা জীবনের একঘেয়েমি কাটাতে একে-অপরের সাথে ছড়া কেটে কেটে কথা বলতেন। মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজে বহুল প্রচলিত এই ছোটখাটো আকৃতির ছড়াগুলির রচয়িতা পুরুষ না নারী তার চুলচেরা বিচার বিশ্লেষণের চেষ্টা করা খুব বুদ্ধিমান এর কাজ হবে না যদিও পড়তে পড়তে জানতে ইচ্ছে করে সৃষ্টিকর্তা বা কর্ত্রী র রসিক মনটিকে। তবু রহস্য বর্তমান থাকায় যে রস আছে রহস্য উদঘাটনে তা নেই। কোন নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে এসব রচিত হয়নি, তথা নির্দিষ্ট কোন পাণ্ডুলিপিতে মুক্তাক্ষর এদের সাজানো হয়নি। উদ্দেশ্যভিত্তিক রচনায় যান্ত্রিকতা থাকে সৃষ্টির আনন্দ ঢাকা পড়ে যায় এক্ষেত্রে তা হয়নি। তাদের উদ্দেশ্য ছিল একটাই তা হল জীবনের ছোট ছোট আনন্দ উপভোগ করা পারিবারিক আবহাওয়ায়। তাই এই ধরনের ছড়া এক স্বতন্ত্র বস্তু-তা মৌখিক। (ক্রমশ)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours