রিয়া ভট্টাচার্য, লেখিকা, খড়্গপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর:

মিশা একজন গৃহকর্ত্রী, দশটা - পাঁচটার অফিস সামলে স্বামী - সন্তানের দেখভাল সুচারুভাবে করে থাকেন। সমস্ত কাজ একা হাতে করতে গিয়ে নিজের দিকে তাকাবার সময় হয়না তার। ধীরে ধীরে সব বদলে যেতে থাকে৷ অতিউৎসাহে রিস্কি অ্যাসাইনমেন্ট কভার করতে গিয়ে চাকরি যায় মিশার। বসের সঙ্গে ঝামেলা, সহকর্মীদের কটুক্তি সবই তাকে অপ্রিয় করে তুলেছিল অফিসের সকলের কাছে। চাকরী যাওয়ার পরেই ডিপ্রেশন ঘিরে ধরে মিশাকে, স্বামী - সন্তান অসহ্য হয়ে ওঠে ; জীবন মনে হয় অর্থহীন। সাততলার ফ্ল্যাটের ব্যালকনি থেকে ঝাঁপিয়ে জীবনে ইতি টানে মিশা, রেখে যায় একগুচ্ছ উত্তরহীন প্রশ্নমালা।

উত্তীয় একজন ঝকঝকে তরুণ, সবক্ষেত্রেই ঝাঁপিয়ে এগিয়ে আসা একজন দক্ষ কর্মী। তার সমস্যাটা পরিবার ততদিন ধরতে পারেনি যতদিন না বাবার মৃত্যুশয্যায়ও তার কাছে অফিস গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। স্বাভাবিকভাবেই এতে পরিবার ক্ষুন্ন হয় এবং তার সঙ্গে বার্তালাপ বন্ধ করে৷ ধীরে ধীরে ডিপ্রেশনের গহ্বরে তলিয়ে যায় উত্তীয়, অনিয়ন্ত্রিত অপরাধবোধ বোঝা হয়ে চেপে বসে ঘাড়ে। অনিয়ন্ত্রিত রাগ, আচমকা ক্ষেপে ওঠা, অযথা হাসাহাসি সন্ত্রস্ত করে তোলে পরিবারকে। মনোবিদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে জানা যায় উত্তীয় যে রোগে আক্রান্ত তার নাম বাইপোলার ডিজর্ডার। আপাতত তার চিকিৎসা চলছে, পারিবারিক সহচর্য ও সময়মত ওষুধপত্র পেয়ে সে এখন আরোগ্যের পথে।

ওপরের দুটো ঘটনায় একটা জিনিস কমন, অনিয়ন্ত্রিত অনুভূতি। একজন মানুষ যখন নিজের খুশি এবং দুঃখ নিজে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হন এবং এরফলে তাদের স্বাভাবিক জীবনযাপন ব্যাহত হয় তাকেই বাইপোলার ডিজর্ডার বলে। বাইপোলার ডিজর্ডার সাধারণত একসঙ্গে দুটি বা তার বেশি মানসিক সমস্যার সমষ্টি৷ যেমন, ডিপ্রেশন, বর্ডারলাইন পারসোনালিটি ডিজর্ডার, অ্যাঙ্গার ডিজর্ডার ইত্যাদি। মোট চারপর্যায়ে এটিকে ভাগ করা যায়। এই রোগে আত্মহত্যার ঘটনা বড্ড বেশি।
কয়েকটি প্রাথমিক লক্ষণ ভালো করে পর্যালোচনা করলেই এই সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। যেমন,ঃ---

১) এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হন। ফলে অতিরিক্ত রাগ, খুশি এসবের অতলে তলিয়ে যায় তার স্বাভাবিক প্রবৃত্তিগুলো।

২) আক্রান্ত ব্যক্তির ভেতরে বিপজ্জনক কাজ করার ইচ্ছে এবং উৎসাহ প্রবল হয়ে ওঠে৷ ফলে প্রায়শই এরা অযথা বিপদগ্রস্ত হন।

৩) অনিদ্রা এবং চরম ডিপ্রেশন এই রোগের অন্যতম প্রাথমিক লক্ষণ।  কোনো কাজে মন বসাতে না পারা, ক্লান্তি সর্বদা এদের আচ্ছন্ন করে রাখে।

৪) এদের দ্বিপাক্ষিক চরিত্র বা ডুয়েল পারসোনালিটি ও বলা হয়৷ কখনো হতাশা কখনো বা আনন্দ ; একেকটি অবস্থা কয়েক সপ্তাহ থেকে কয়েক বছর পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে।

৪) রোগী সর্বদা অপরাধবোধে ভোগে। তার আত্মনিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা কমে যায়। তাই নিজের ক্ষতি করা ও আত্মহত্যার প্রবনতা এদের মধ্যে সর্বাধিক।

বাইপোলার ডিজর্ডার এর প্রকৃত কারণ এখনো জানা যায় না। তবে মনে করা হয় এই রোগ কিছুটা জিনঘটিত। এছাড়া কোনো মানসিক আঘাত, ট্রমা, মস্তিষ্কের স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্থ হওয়া বা মাদকাসক্তির ফলেও এটি হতে পারে।

প্রিভেনশন ইজ বেটার দেন কিয়োর,  এই আপ্তবাক্যটা মনে রাখুন,  সর্তক হোন। কোনো কারণে ডিপ্রেশন বা আত্মহত্যাপ্রবনতায় ভুগলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মনোবিদের সাহায্য নিন। যোগাসন - প্রাণায়াম করুন, সময়ে ওষুধ খান। পরিবারের সহায়তায় এইসব রোগীর সেরে ওঠার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশী। তাই আক্রান্তকে দূরে সরিয়ে দেবেন না, তার পাশে দাঁড়ান, সহায়তা করুন। আপনার সংবেদনশীল মনোভাবই আপনাকে একজন দায়িত্বশীল নাগরিক হিসাবে প্রতিফলিত করবে।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours