জীবন রায়, প্রাক্তন সিপিএম সাংসদ, রাজ্যসভা:

জ্ঞানের অর্থ  যখন ধারন ও বিশ্লেষন এবং প্রয়োগের সংবেদনশীলতার এক মহাসম্মেলন বলে বিবেচিত, তখন ভাবতেই হবে আমরা আছি কোথায়। রাজণীতির লক্ষ বিবাদের মধ্যেও, কোন জাতি যখন এই ভাবনাটাকে দল মতের উর্ধে উঠিয়ে এনে এক অখন্ড নিরন্তরতায় সমাজ প্রবাহে নিয়ে আসা না যায়, তবে, তবে শিক্ষা এবং জ্ঞান, দুটোই যে জাহান্নামে যাবে তার সব লক্ষন সারা বিশ্বেই ক্রমে প্রকট  হচ্ছে। তবে ভারতের মতো, চুতি করে স্বাধীনতা পাওয়া দেশে পরিস্থিতি যে ভয়ংকর হবে, তা স্বাভাবিক।

সে যায়গায়, যে দেশে ৬৫-৭০% মানুষকে স্বাক্ষরতার স্থরে উঠিয়ে এনেই, রাষ্ট্র 'বিশ্বজয়' হয়েছে বলে মনে করেন সেই দেশে, এই সত্যটাকে কিঞ্ছুতেই সাধারন অভিবাবকদের মধ্যে পৌছে দেওয়া একেবারেই অসম্ভব
----- যে শিক্ষা জ্ঞানের অভিমুখে প্রতিস্থাপিত করার নিরন্তর চেষ্টার সাথে যুক্ত নয় সেই শিক্ষা কু-শিক্ষা বই কিছুই নয়। ভারতের রাজনৈ্তিক ব্যবস্থা কিংবা রাজনৈ্তিক দলগুলিকে কে বোঝাবে
----- বিদ্যালয় বা প্রাতিষ্টানিক শিক্ষার সাথে গনশিক্ষার সংযুক্তি ঘটিয়েই শিক্ষার জ্ঞানগত উত্তোরন সম্ভব। এমনটি যখন ঘটতে থাকে তখন, যিনি জ্ঞানী তিনি নিজেই নিজের অজান্তে শিক্ষকের ভূমিকায় উঠিয়ে আনবেন। এইভাবেই একদিন ইউরোপে, যদিও বুর্জোয়া আত্মপরতায় অখন্ড সত্বায় উঠে আসতে পারে নাই তবুও, গনশিক্ষার অন্তসলিলা শ্রোত  গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছিলো। একেই ইউরোপে যে গনতান্ত্রিক বিপ্লব হয়েছিলো, ইতিহাস সেই বিপ্লবের ভিত্তি বলে মেনেছিলো। এই কারনেই, সেই বিপ্লবে, 'অসি' এবং 'মসির' এক বিপুল সংহতি দেখা গিয়েছে।

এই দেশে যে কিভাবে কীভাবে  জ্ঞানকে প্রথমে 'ইংরাজীয়ানা', ইংরাজীয়ানাকে নাকে-মুখে ভূল ইংরাজী বলায় নামিয়ে এনে 'শিক্ষার জ্ঞানমুখীন চরিত্রকে নিচে নামিয়ে আনা হয়েছে, তাকে জাতীয় রাজনীতির রাজনীতিহীনতায় পতনের  পথটাতে চিহ্নিত করার চেষ্টা করলেই
----- শিক্ষার জ্ঞানহীনতার সাথে সাথে বিদ্যালয় শিক্ষার ক্রমাবনতিকে চিহ্নিত করা যাবে। ভারতের বাংলায় সংখ্যার অনপাতে কম থাকা সত্যেও এককালে যদি জ্ঞানগত মান অনেক উচুতে থাকার কারনে, ভারতীয় রাজনীতির মুখ্যভূমি হয়ে উঠে আসার সম্মান পেয়ে থাকে, পরবর্তীকালে বারোক্লাস পর্য্যন্ত
অবৈতনিক শিক্ষা এলেও শিক্ষার জ্ঞানদায়ী ভুমিকার চরম অবনতির কারনেই
যদি বিদ্যালয় শিক্ষা ক্রমে বারোটা বাজার দিকে গড়িয়ে গিয়ে থাকে
----  তবে অল্প বুদ্ধি নিয়েও বুঝতে চেষ্টা করেছি, এর  পেছনে, বাজার অর্থনীতি প্রধান কারন হলেও, অপ্রতিরোধ্য হয়ে যাওয়ার  দুটি প্রধান কারনেঃ

 প্রথমতঃ বাংলার বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে আত্মসর্বস্বতার বিস্তার। ব্যতিক্রমীদের সংখ্যা যথেষ্ট থাকলেও, আর্থ-সামাজিক বিপর্য্যয়ে ক্রমবর্ধমান নিরপেক্ষতার ভূমিকা হেতু উনারা ক্রমেই  শিক্ষাকে সামগ্রিক মনবোন্নয়নে জ্ঞানমুখীনতার বিষয়  থেকে বিচ্ছিন্ন হতে দিয়েছেন এবং ক্রমে নিজেদেরকেই বাজারের অংশ হতে দিয়েছেন।
------ অথচ পাশের , বাংলা দেশ এই 'মানবোন্নয়নের' প্রশ্নেই অধিকতরগুরুত্ব দেওয়ায়, উন্নয়নশীল দেশগুলির মানদন্ডে ভারতকে অতিক্রম করেছে তাই নয়, ভারত বাংলায় যখন বিগত তিনদশকে 'বুদ্ধিসত্তার' ক্রমাবনতি ঘটেছে, তখন বাংলা দেশে এই সত্তা উর্ধমুখীন হওয়ার সুযোগ পেয়েছে।
-------  রবীন্দ্র সাহিত্য ও সংগীত সম্পর্কে দুই দেশের একেতে অন্য থেকে 'নেতিবাচকতা এবং অন্যের ইতিবাচকতাই । এদিকে যারা রয়েছেন, তারা বুঝতেই চাইছেন না, - রবীন্দ্রসংগীতের গুনমানের বাজারীকরন এবং কেন্দ্রের রবীন্দ্র নিধনের কর্মসূচী, ভারতকে আরো অজ্ঞানতা এবং আদিভৌতিকবাদের দিকে ঠেলছেঃ অদ্যকার দিনে এটাই ভারতীয় সংকটের কারন। ।*
-----   কোলকাতার 'কিঞ্চু বাবু' যখন যুক্তিবাদী হিসেবে ইংরাজী শিক্ষাকে 'ইংরাজীয়ানার' আন্দোলন শুরু করলেন, উনারা কার্য্যতঃ 'নিরপেক্ষরতার' ভূমিকা নিলেন।
দ্বিতীয়তঃ
মাষ্টার মশাইদের মধ্যে, 'প্রফেসানালিজম' এবং প্রফেসানের মাঝখানের ফারাকটা যেমনভাবে তার নেতীবাচক দিকে বিস্তৃত হয়েছে, তেমনভাবেই
---- বিদ্যালয় যে 'ফরমুলা' শেখানোর আখরা থেকেও 'জ্ঞানালয়' এবং তা থেকেও বেশী জ্ঞানকে 'ধারন' 'বিশ্লেষন' এবং 'প্রয়োগের' যন্ত্র নির্মানকার্য্যশালাই নয়, এই 'জ্ঞানসত্যাটিকে ধারন করার মতো করে, 'মস্তিস্ক' নামক যন্ত্রটিকে ভাংগা গড়ার দিকে টেনে আনা। -
এইভাবে 'শিক্ষকতা' হিসেবে প্রফেসান এবং প্রোফেস্যানালিজম এর মধ্যকার ফাক যেমনভাবে নেতীবাচকতার দিকে এগিয়েছে,
----উল্লেখিত  সত্যগুলিকেও  পেছনে ঠেলা হয়েছে।  পরিনামে শুধু বিদ্যালয় শিক্ষাই নয়, শিক্ষার অবৈতনিক ব্যবস্থাটাই বারোটা বেঁছেছে।

বিগত দেড়দশক ধরে, বিদ্যালয় ব্যবস্থার সাথে যুক্ত থাকার কারনে, শিক্ষক ট্রেইনিং ব্যবস্থা সম্পর্কে যে ধারনা হয়েছে, তাতেও মনে হয়েছে,
----  পুরানো মনন প্রবাহকে ভেংগে দিয়েই,  'শিশুকাল থেকেই' মস্তিস্কের জ্ঞানকেন্দ্রিক রুপটিকে পুণঃ  নির্মান করে নেওয়ার বিষয়টিকে নিশ্চিতভাবে নেই।'বাজার নীতির' কারনে শিক্ষার জ্ঞানসত্বাকে আচল করে দেওয়াই যখন
নীতি হিসেবে মানা হয়েছে, তখন 'মস্তিস্ক' নির্মানের বিষয়টিকে ব্যবস্থা হিসেবেই পেছনে ঠেলা হয়েছে
ট্রেড  ইউনিয়ন আন্দোলনে দীর্ঘকাল মার্ক্সবাদ প্রয়োগ করার অভিজ্ঞতার আলোতে শিক্ষার 'জ্ঞানমুখীন' সত্বাকে বুঝতে গিয়েই এই 'মস্তিস্কের' পূনঃ নির্মানের কাজটাই যে, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কাঠামোর প্রথম কাজ, সে কথাটাও বুঝেছি।
অন্যান্য রাজনীতি যখন রাজনীতিহীনতায় ভুগছে, তখন সাম্যবাদী আন্দোলনের ভাবাদর্শহীনতাও শিক্ষা্র জ্ঞানমুখীনতার সংগ্রাম বিপুলভবাবে
ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
---- শিক্ষার জ্ঞানমুখীন সত্বার যে কোন শ্রেনীচরিত্র থাকে না, সেটা যখন বুদ্ধি থেকে চলে যেতে থাকে, তখন শিক্ষা আন্দোলন যে কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, সে বিষয়ে ভুক্তভোগী লেখক নিজে। আজকে নয়,  সময়কাল হয়তো, সেসব কথা বলতে হবে।
তবে এটা বুঝে নিতে হবে,
সাম্যবাদীরাই প্রথম বুঝবেন, কেন পুরানো আদিভৌতিক বা মেটা-ফিজিস্ক বোধ সত্যাকে গুড়িয়ে দেওয়া যতদিন সম্ভব না হবে ততদিন শিক্ষা, তার জ্ঞানমুখীন প্রতিমূর্তীতে কোন দিন ফিরে আসবে না ।
জীবন রায় মেনেছে, মার্ক্সবাদী চর্চা মাথায় নিয়েই শিক্ষা আন্দোলনে এসেছিলেন বলেই, রবীন্দ্রনাথকে কিঞ্চিৎ এবং বিশেষ করে তার
---- কবিতা, 'নির্ঝরের স্বপ্ন ভঙ্গ' কে কিছুটা উপলব্ধীর মধ্যে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিলেন.
ছোট বূদ্ধিতে বলতে পারি, 'নির্ঝরের স্বপ্নভংগে' নিচের কয়েকটি লাইনেই
শিক্ষায় জ্ঞানের অভিমুখ সম্পর্কে, যে ভাবনয়া প্রতিফলিত সেটাই মাষ্টার মশাইদের শিক্ষার অভিমুখ বলেই এক কালে মানা হয়েছিলো
    "হেতায় হোতায় পাগলের প্রায়
     ঘুরিয়া ঘুরিয়া আতিয়া বেড়ায় --
     বাহিরিতে চায়, দেখিতে না পায় কোথায় কারার দ্বার।
     কেন রে বিধাতা পাষাণ হেন
     চারি দিকে তার বাঁধন কেন!
     ভাঙ্  রে হৃদয় ভাঙ রে বাঁধন
     সাধ্  রে আজিকে প্রাণের সাধন,
     লহরীর 'পরে লহরী তুলিয়া
     আঘাতের 'পরে আঘাত কর্।
     মাতিয়া যখন উঠেছে পরান
     কিসের আঁধার, কিসের পাষান।
     উথলি যখন উঠেছে বাসনা
     জগতে তখন কিসের ডর।"
এইভাবে রবীন্দ্রনাথ চিত্ত-কাঠামোর
পুনঃর্নির্মানকেও এক সংগ্রাম এবং
আনন্দ হিসেবেই দেখলেন। (ক্রমশ)



Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours