আনন্দিতা রায়, লেখিকা ও সঙ্গীতশিল্পী, দুর্গাপুর: 

কুমারেশ ঘোষ সম্পাদিত 'যষ্টিমধু' চিরকাল মানুষের মনে অমর হয়ে থাকবে। সুদীর্ঘ ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে 'যষ্টিমধু' সাহিত্যে তার প্রভাব বিস্তার করেছে। এই 'যষ্টিমধু'র একটি সংখ্যাই ছিল প্যারোডি সংখ্যা। 'যষ্টিমধুর' ভাদ্র আশ্বিন ১৩৬৫ সংখ্যায় কবি কৃষ্ণধর রবি ঠাকুরের "ওরে সবুজ ওরে অবুঝ" অনুসরণে লিখলেন 'খাঁচা' নামে বিশেষ একটি প্যারোডি। তার কিছু অংশ:--

ওরে আমার পরান পাখির খাঁচা
দুয়ার খুলে রাখিস নে রে
বাতাস এলে যাবে উড়ে
ধুকপুকুনি পরানটারে আলতো করে বাঁচা
ওরে আমার হৃদয় -হরণ পরাণ- পাখির খাঁচা।

যষ্টিমধুর প্যারোডি সংখ্যায় তপোবিজয় ঘোষ লিখলেন:-

কি সুরে বাজাও হর্ন ওগো মিঠু রায়
তোমার হর্নের সুরে
মীরার অন্তরপুরে
ঢেউ ওঠে। শুধু তাই ঘড়ি পানে চায়।

প্রফেশ্বর বলে যা তা
খোলা পড়ে বই খাতা
উতলা মন ছোটে সিনেমায়
নয়া ক্যাডিল্যাক ছোটে পাশে মিঠু রায়।

("কি সুরে বাজাও বাঁশি ওগো শ্যাম রায়"জনপ্রিয় এই গানটির সুরে)

শনিবারের চিঠি দোর্দণ্ডপ্রতাপ সম্পাদক, বোধোদীপ্ত লেখক, হাস্যরস সাহিত্যের খনি, প্যারোডি সম্রাট, নির্ভীক শক্তিশালী সাহিত্য সেবক সজনীকান্ত দাস, যার নাম অমর হয়ে রয়েছে সিদ্ধহস্ত প্যারোডিকার হিসাবে।
সজনীকান্ত দাস 'শ্রী কেবলরাম গাজনদার' এই ছদ্মনামে নজরুল ইসলামের গজল গান 'বাগিচায় বুলবুলি তুই ফুলশাখাতে দিসনে আজি দোল' অনুসরণে লিখলেন 'জানলায় টিকটিকি তুই টিকটিকিয়ে করিস নে আর দিক'।
শনিবারের চিঠি নজরুলের নাম দেয় "গাজী আব্বাস বিটকেল"। 'গাজী আব্বাস বিটকেল'কে লক্ষ্য করে প্রথম মুদ্রিত কবিতা প্যারোডি রূপে
নিচে কিছু অংশ দেওয়া হলো:-
"ওরে ভাই গাজী রে
কোথা তুই আজি রে
কোথা তোর রসময়ী জ্বালাময়ী কবিতা
কোথা গিয়ে নিরিবিলি
ঝোপে ঝোপে ডুব দিলি
তুই যে রে কাব্যের গগনের সবিতা
দাবানল বীণা আর
জহরের বাঁশিতে
শান্ত এদেশে ঝড় একলাই তুললি
পুষ্পক দোলা দিয়া
মজালি যে কত হিয়া
ব্যথার দানেতে কত হৃদিদ্বার খুললি।

"দাবানল-বীণা", "জহরের বাঁশি" ও "ব্যথার দান" শব্দগুলো যথাক্রমে নজরুল রচিত 'অগ্নিবীণা' 'বিষের বাঁশি' ও 'ব্যথার দান' গ্রন্থত্রয়কে মনে করিয়ে দেয়।

কে উদাসী বনগাঁবাসী বাঁশের বাঁশি বাজাও বনে,
বাঁশি সোহাগে ভিরমি লাগে, বর ভুলে যায় বিয়ের কনে
ঘুমিয়ে হাসে দুষ্টু খোকা, বেরিয়ে আসে দাঁতের পোকা
(বোকা চাঁদের লাগল ধোকা, খোকা কবির বাঁশির স্বনে)
খোকা চাঁদের লাগল ধোকা শ্যাওলা পড়া নীল গগনে। (নজরুল ইসলামের"কে বিদেশী মন উদাসী" এর অনুসরণে)
            অথবা
আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো গোল আলু।
তুমি আছো বিশ্বজুড়ে ওগো গোল আলু
তোমায় দেখেছি নৈনিতালে,
তোমায় দেখিয়াছি ট্রান্সভালে--
তোমায় দেখেছি আগে ও হালে, ওগো গোল আলু--------"
(রবি ঠাকুরের "আমি চিনি গো চিনি তোমারে "অনুসরণে)

মূল রচনার ছন্দকে অবিকল অনুসরণ করে অসামান্য দক্ষতা দেখিয়েছিলেন উপেন চন্দ্র মল্লিক। এক কথায় তার রচিত প্যারোডি গুলি ছিল জাত প্যারোডি। 
উদাহরণস্বরূপ:--

রামুর ব্যাগ ছিল শার্টের পকেটেতে
শ্যামুর হাত ছিল কাছে,
সহসা ট্রাম- কারে মিলন হল দোঁহে
না জানি কপালে কি আছে।
রামুর ব্যাগ বলে, "শ্যামুর হাত তুমি
এখনি দাও মোরে ছাড়ি"। 
শ্যামুর হাত কহে "রামুর ব্যাগ এসো 
আমার কাছে চুপিসারি।"
রামুর ব্যাগ বলে,---"না----
আমি তোমার কাছে নাহি যাব"।
শ্যামপুর হাত কহে,"বটে--
আমি তোমারে তবে কি না পাবো-----"?

(রবীন্দ্রনাথের খাঁচার পাখি ছিল গানটির অনুসৃত প্যারোডির কিছু অংশ)

কেউ কেউ মনে করেন কোনও কবির বা লেখকের এর গদ্য কাব্য বা গানের প্যারোডি রচনা করলে  মূল সৃষ্টিকে অসম্মান করা হয়।
বস্তুতপক্ষে ভাষার ঈষৎ পরিবর্তন করে সুর ধ্বনীও ছন্দকে দ্রুত বেগে রসসিক্ত করে মূল রচনার অবয়বকে অক্ষুন্ন রেখে সাধারণত প্যারোডি রচিত হয়। কাজেই প্যারোডি রচনা আদৌ প্রমাণ করে না যে প্যারোডিকারের মনে মূল সঙ্গীত কাব্য বা রচনাটির প্রতি অসম্মান প্রদর্শনই একমাত্র উদ্দেশ্য। পক্ষান্তরে মহাকবির প্রতি প্যারোডিকারের শ্রদ্ধা ভক্তি ও রচিত ফসলটিকে চিরস্মরণীয় করে রাখার আপ্রাণ প্রচেষ্টাকেই তুলে ধরে।  
নীচে তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ দিলাম:--
সতীশচন্দ্র ঘটকের প্যারোডি গ্রন্থ 'লালিকাগুচ্ছ'এর উৎসর্গ পত্রটি পড়লে  মূলস্রষ্টাদের প্রতি আনুগত্য ও শ্রদ্ধাই চোখে পড়ে:--

        ‌   ।।  উৎসর্গ ।।

"আপনাদের কবিতার ছবি লালিকার তেড়াব্যাঁকা আয়নায় ফেলে আপনাদেরই হাতে দিচ্ছি---
কেমন দেখাচ্ছে বলুনতো? খুশি না হোন, দয়া করে চটবেন না।" (ক্রমশঃ)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours