নাজমীন মর্তুজা, লেখক ও গবেষক, অ্যাডিলেট, অস্ট্রেলিয়া:

ছিল যত ভুল-ত্রুটি
ছাড়িয়ে যাবার এই সময়,
নতুন দিনের নতুন স্বপ্ন
করতে হবে জয়।
নতুন বছরের শুভেচ্ছা, নতুন বছর আপনার জীবনে নিয়ে আসুক অনাবিল সুখ ও শান্তি। মহান স্রষ্টা আপনার এবং আপনার পরিবারের উপর তার দয়া অবিরত রাখুক ...কিংবা আরও বলি -ধুয়ে মুছে যাক যত ক্লান্তি-গ্লানি-বেদনা, নতুন বছর আসছে আবার জানাই শুভকামনা।নতুন বছর বয়ে আনুক সফলতা আর সুখ, বছর শেষে গর্বে যেন ভরে উঠে বুক।
তাই যারা জানো এবং যারা জানো না, তাদের সবার জন্য আজকে জানিয়ে দিচ্ছি ইংরেজি নববর্ষের ইতিহাস।
আমাদের দেশে নববর্ষ হচ্ছে পহেলা বৈশাখ। তেমনি ১ জানুয়ারি ইংরেজি নববর্ষ। পৃথিবীর প্রায় সব দেশে উৎসবের মেজাজে সাড়ম্বরে পালিত হয়ে থাকে। কিছু জাতি যেমন চীনা, ইহুদি, মুসলমান প্রভৃতির মধ্যে নিজ নিজ ক্যালেন্ডার অনুসারে নববর্ষ পালন করতে দেখা যায়। ছোটবেলায় স্কুলে আমরা লিপিয়ার, জুলিয়ান ক্যালেন্ডার নিয়ে কত কত হিসাবই না শিখেছিলাম যেমন -এই ক্যালেন্ডারে পৃথিবীর সূর্য প্রদক্ষিণকাল ৩৬৫ দিন। কিন্তু বছর ৩৬৫ দিনে রেখে অতিরিক্ত দিন-সংখ্যা (১-৪ দিন) প্রতি চার বছর অন্তর ফেব্রুয়ারি মাসের সঙ্গে যোগ করা হয়।
তখন ফেব্রুয়ারি মাসের দিন-সংখ্যা দাঁড়ায় ২৮ থেকে ২৯ দিন। এই একটি বাড়তি দিনকে বলা হয় 'লিপ'-ডে। আর বছরটি হলো 'লিপিয়ার'। এ ক্যালেন্ডারটি 'জুলিয়ান ক্যালেন্ডার' নামে খ্যাত ছিল।
জানুয়ারি ইংরেজি নববর্ষ, আজ যা সাড়ম্বরে পালিত হয়ে থাকে, দুই হাজার বছর আগেও কিন্তু এমনটি ছিল না। এমনকি দিন-তারিখ বছরও। ফিরে দেখা যায় সেসব ইতিহাস।
মধ্য আমেরিকার মেক্সিকোতে এক সভ্যতার উদয় হয়েছিল। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দী থেকে এ সভ্যতার বিকাশ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল, যা বিস্ময়কর। খুব বিস্ময়কর! এ সভ্যতার নাম 'মায়া' সভ্যতা। মায়া সভ্যতার বহু বিচিত্র কীর্তি-কাহিনীর মধ্যে হায়ারোগি্লফিক লিপি একটি। সম্প্রতি এ দুর্বোধ্য লিপির পাঠোদ্ধার করা হয়েছে। এর ফলে মায়াদের সম্বন্ধে অনেক নতুন তথ্য জানা গেছে। মায়াদের সংখ্যাতত্ত্বের সম্যক জ্ঞান, গ্রহ-নক্ষত্রের গতিবিধি পর্যবেক্ষণের অসাধারণ দক্ষতা, স্থাপত্য-শিল্পকলার বহুবিধ ব্যুৎপত্তি বিস্ময়ে আমাদের হতবাক করে দেয়। মায়ারা আবিষ্কার করেছিল সূর্যকে প্রদক্ষিণ করতে পৃথিবীর ৩৬৫ দিন লাগে। নির্ভুল বিচারে এই গণনা ছিল ৩৬৫-২৪২০ দিন। এ সময়কালকে ১৮ মাসে ভাগ করে নিয়েছিল তারা। যার প্রতিমাসের দিন-সংখ্যা ছিল ২০। বলা হয়ে থাকে, খ্রিস্টপূর্ব ৭৫০ সাল নাগাদ তিনি যে ক্যালেন্ডারের উদ্ভাবন করেছিলেন, সেখানে দিন-সংখ্যা ছিল ৩০০। এই ৩০০ দিনকে সমান ১০টি ভাগে ভাগ করে মাসের দিন-সংখ্যা ৩০ করা হয়েছিল। যা কিনা আজকের মাসের গড়দিন। একে রোমুলাস ক্যালেন্ডার বলা যেতে পারে। এ রোমান ক্যালেন্ডারে প্রথম শুরুর মাস ছিল 'মারটিয়াস', অর্থাৎ আজকের মার্চ মাস। রোমানদের।
এছাড়াও “এই যে ইংরেজী নববর্ষের শুভেচ্ছাবাণী দেওয়া নেওয়া , বা  প্রকৃতঅর্থে আমরা যে ইংরেজি সাল বা খ্রিস্টাব্দ মেনে চলি ,তা হলো গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার। এই ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ইংরেজি নববর্ষ পালন করা হয়। এই ক্যালেন্ডার নিয়েও রয়েছে নানা বিতর্ক। বর্তমানে মতো অনেক আগে সার্বজনীনভাবে পহেলা জানুয়ারি নববর্ষের প্রচলন ছিলো না। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার প্রকৃতভাবে একটি সৌর বছর। আর বর্তমানের যে ক্যালেন্ডার তাতে পৌঁছাতে কয়েক’শ বছর সময় লেগেছে।
ইতিহাসে রয়েছে, মানুষ প্রথমদিকে চাঁদের হিসেবেই নতুন বর্ষ গণনা শুরু করে। চাঁদের হিসেবে ১০ মাসে বছর হতো। সেখানে ঋতুর সাথে কোনও সম্পর্ক ছিলো না। সূর্যের হিসাবে বা সৌর গণনার হিসাব আসে অনেক পরে। সৌর এবং চন্দ্র গণনায় আবার পার্থক্য রয়েছে। সৌর গণনায় ঋতুর সঙ্গে সম্পর্ক থাকে।
এমন কি প্রায় ৪০০০ বছর আগে, খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ খ্রিষ্টাব্দে মেসোপটেমীয় (ইরাক) সভ্যতায় প্রথম বর্ষবরণ উৎসব চালু হয়েছিলো। মেসোপটেমিয়ান সভ্যতার আবার ৪টি আলাদা ভাগ আছে, সুমেরীয় সভ্যতা, ব্যাবিলনীয় সভ্যতা, আসিরীয় সভ্যতা ও ক্যালডীয় সভ্যতা। এদের মধ্যে বর্ষবরণ উৎসব পালন করা শুরু হয় ব্যাবিলনীয় সভ্যতায়।
সে সময় বেশ জাঁকজমকের সঙ্গেই পালন করা হতো এই বর্ষবরণ। তবে সেটা কিন্তু এখনকার মতো জানুয়ারির ১ তারিখে পালন করা হতো না। তখন নববর্ষ পালন করা হতো বসন্তের প্রথম দিনে। বসন্তকালে প্রকৃতির নতুন করে জেগে ওঠাকেই তাঁরা নতুন বছরের শুরু বলে চিহ্নিত করেছিলো। তখন তাঁরা চাঁদ দেখেই বছর গণনা করতো। যেদিন বসন্তের প্রথম চাঁদ উঠত, শুরু হতো তাদের বর্ষবরণ উৎসব, চলতো টানা ১১ দিন। এই ১১ দিনের আবার আলাদা আলাদা তাৎপর্যও ছিল। ব্যাবিলনীয় সভ্যতার পর জাঁকজমক করে নববর্ষ পালন করা শুরু করে রোমানরা। রোমের উপাখ্যান খ্যাত প্রথম সম্রাট রোমুলাসই ৭৩৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রোমান ক্যালেন্ডার চালু করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। অবশ্য এই ক্যালেন্ডারও রোমানরা চাঁদ দেখেই বানিয়েছিলেন। আর সেই ক্যালেন্ডার অনুযায়ী নববর্ষ ছিলো ১ মার্চ। সেই ক্যালেন্ডারে মাস ছিল মাত্র ১০টা। পরে সম্রাট নুমা পন্টিলাস জানুয়ারি আর ফেব্রুয়ারিকে ক্যালেন্ডারে যোগ করেন। সমস্যা ছিল আরও, রোমানদের ক্যালেন্ডারে তারিখও ছিল না। ধীরে ধীরে চাঁদের বেড়ে উঠার ছবি দিয়ে তারা মাসের বিভিন্ন সময় চিহ্নিত করতো। চাঁদ ওঠার সময়কে বলা হতো ক্যালেন্ডস, পুরো চাঁদকে বলতো ইডেস, চাঁদের মাঝামাঝি অবস্থাকে বলতো নুনেস। পরে সম্রাট জুলিয়াস সিজার এই ক্যালেন্ডারের পরিবর্তন ঘটান। তিনি ক্যালেন্ডস, ইডেস, নুনেসের ঝামেলা শেষ করে বসিয়ে দেন তারিখ। ফলে বছরে মোট ৩৫৫ দিন হয়। যেহেতু চাঁদের হিসাবে প্রতিমাসে দিন হয় সাড়ে ২৯। আর তাই চাঁদের হিসাব করায় তাদের বছরে ১০ দিন কম থেকে গিয়েছিলো। এইভাবে বছর হিসাবের ফলে চাষীরা সমস্যায় পড়ে যায়। পরে অনেক চিন্তা ভাবনা করে সম্রাট সিজার চাঁদের হিসাব না করে, সূর্য দিয়ে হিসাব করে বছরকে ৩৬৫ দিনে এনে এই সমস্যার সমাধান করেন।
অনেকে বলেন সেই সময়ে সূর্য দেখে প্রথমে ৩৬৫ দিনের নয়, ৪৪৫ দিনের ক্যালেন্ডার বানিয়েছিলেন! রোমান সম্রাট জুলিয়ান সিজার লিপইয়ার বছরেরও প্রচলন করেন। জুলিয়াস সিজার আলেকজান্দ্রিয়া থেকে গ্রিক জ্যোতির্বিদ মোসাজিনিসকে নিয়ে আসেন ক্যালেন্ডার সংস্কারের জন্য। মোসাজিনিস দেখতে পান পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে প্রদক্ষিন করতে সময় নেয় ৩৬৫ দিন ৬ঘন্টা। ৩৬৫ দিন বছর হিসাব করা হলে এবং প্রতি চতুর্থ বছরে ৩৬৬ দিনে বছর হিসাব করলে হিসাবের কোন গড়মিল হয় না। আর তাই মোসাজিনিস অতিরিক্ত একদিন যুক্ত করে এ বছরটির নাম করেন ‘লিপিইয়ার’।
যিশু খ্রিস্টের জন্মের ৬০০ বছর আগে, অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ অব্দে ঠিক করা হয়েছিলো বর্ষবরণ হিসেবে পালন করা হবে ২৬ মার্চ তারিখটি। কিন্তু সেটা ঠিকভাবে মানা হচ্ছিলো না। পরে সম্রাট নুমা পন্টিলাস যখন জানুয়ারি আর ফেব্রুয়ারিকে ক্যালেন্ডারে স্থান দেন, তিনি ঠিক করে দেন জানুয়ারির ১ তারিখ হলো বছরের প্রথম দিন। ওইদিনই হবে বর্ষবরণ
কিন্তু সে কথাও মানা হলো না। রোমানরা সেই আগের মতো মার্চের ১ তারিখেই বর্ষবরণ উৎসব করতে লাগলেন। পরে জুলিয়াস সিজার যখন ৩৬৫ দিনে বছরের ঘোষণা দেন, তখন আবার বলে দেন মার্চে নয়, বছর শুরু হবে জানুয়ারির ১ তারিখে। উৎসবও সেইদিনই হবে। এরপরই বর্ষবরণ উৎসব মার্চ মাস থেকে চলে এলো জানুয়ারিতে।”
একই দিনে নতুন বছরকে স্বাগত জানালেও বিভিন্ন দেশে নববর্ষ পালনের রীতিনীতিও ভিন্ন ভিন্ন। কিছু কিছু মিল থাকলেও নববর্ষের অনুষ্ঠানের সঙ্গে যোগ হয় দেশীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য। গ্রেট ব্রিটেনে এই গ্রেগরীয়ান ক্যালেন্ডার প্রচলিত হয় ১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দে। আর এই ক্যালেন্ডার আমাদের দেশে নিয়ে আসে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে। আমরাও পহেলা বৈশাখের পাশাপাশি প্রতিবছর ১লা জানুয়ারিতেও বর্ষবরণ করি। তবে আমাদের বাংলা ক্যালেন্ডার অনুসারে স্বভাবতই বাংলা নববর্ষে আমরা যতটা প্রাণ খুলে মেতে থাকি ততটা ইংরেজী নববর্ষে মাতি না , কিন্তু অষ্ট্রেলিয়া আসার পর প্রতিবছর থার্টিফাস্ট নাইটে আমরা ভীষন আনন্দে মেতে উঠি । নতুন ডিশ বানানো থেকে হৈ হৈ রবে ছুটে যাই ফায়ার ওয়ার্ক দেখতে । আলোর ঝলকানি , ফুর ফুর করে ফুটতে থাকা নানা ডিজাইনের ফুলঝারি যখন বিশাল আকাশে তাদের কারিগরি সৌন্দর্য নিয়ে ফুটতে ফুটতে সালের নাম্বারের আকৃতি নেয় , ঠিক সেই মুহুর্ত থেকে বদলে যায় ক্যালেল্ডারের পাতা থেকে মনের হিসাবও , উদাস হয়ে যায় মন ফেলে আসা বছরের পাওয়া না পাওয়া গ্লানি হতাশা, প্রাপ্তির  কথা মনে করে।
আবার পরক্ষণেই নতুনকে পাওয়ার আনন্দে মেতে উঠি আগামীর স্বপ্ন নিয়ে । পা ফেলে চলে যাই নতুন বছরের ঘরে।
এদিনও আমরা সারারাত আনন্দে মেতে উঠি। মেতে উঠি ভালোবাসা ও সৌহার্দ্যতায়।  আজকাল সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকের ইনবক্স ভরে যায় শুভেচ্ছা বার্তায় । কত কত মন ভোলানো এনিমেশনের কার্ড , ক্লিক করতেই কত রকমের ভেল্কি দেখাতে শুরু করে , সদ্য ফুল ফুটছে , আকাশ থেকে রঙধনু আপনার রঙ বিলিয়ে মনকে রাঙিয়ে তুলছে।
তারা খসে পড়ছে । মিষ্টির হাঁড়ি ভরা শুভেচ্ছা কত কত মজার অভিজ্ঞতা হচ্ছে প্রতিবছরের থাকছে নতুন বছরে নতুন নতুন শুভেচ্ছা বার্তার চমক।
একইদিনে নতুন বছরকে সারা বিশ্ব স্বাগত জানালেও বিভিন্ন দেশে নববর্ষ পালনের রীতিনীতি ভিন্ন ভিন্ন। কিছু কিছু মিল থাকলেও নববর্ষের অনুষ্ঠানের সঙ্গে যোগ হয় দেশীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য। খাওয়া -দাওয়া , পোষাক -পরিচ্ছদ , সাজসজ্জা, ইত্যাদি , কিন্তু একটা জিনিসে কোন অমিল নেই .. যখন সবাই বলে পৃথিবীর যে প্রান্ত থেকেই হোক না কেন , যে কোন ভাষাভাষীর হোক না কেন ....
“Happy New Year 2020”

(তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া ও অন্যান্য সূত্র থেকে পাওয়া।)


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours