আনন্দিতা রায়, লেখিকা ও সঙ্গীতশিল্পী, দুর্গাপুর:

 আমার গল্পে আমি মাতোয়ারা, তোমার গল্পে তুমি,
আমারটাই সর্বশ্রেষ্ঠ আমারটাই দামি।
আমার গল্পে আমি সেরা থাকে তোমার মনে,
তোমার গল্পে তুমি সেরা মনের গহীন কোণে।
আমার গল্প তুমি বোঝনা তোমায় বুঝিনা আমি,
আসলে দুজনের গল্পটাই যে সমানভাবে দামি। 

উপরিউক্ত কথাগুলি পুরুষ ও নারী উদ্দেশ্যে বলা।
যুগে যুগে পুরুষ ও নারী এই দুই বিপরীতধর্মী, অথচ একে অপরকে ছাড়া অসম্পূর্ণ মানুষের জরুরী সহাবস্থান নিয়ে কম তর্ক-বিতর্ক হয়নি। এ বলে আমি শ্রেষ্ঠ ও বলে আমি। নারীর দায়িত্ব এক, আবার পুরুষের আরেক ধরনের। দুজনের কাজ দায়িত্ব একরকম নয়। কিন্তু ওজন করতে গেলে কারো দায়িত্ব কারো চাইতে কম নয়।  পুরুষ যদি একটি পরিবারের মাথা হয়ে থাকে, নারী হয় সেই পরিসরের হৃদয়। কিন্তু তবু কেউ তা মানতে চায় না, লড়াই তো চলেই আসছে দীর্ঘদিন ধরে, প্যারোডিও তার ব্যতিক্রম নয়।

স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্র সংস্কৃত মূল চরিত্র রচনা করেছিলেন। যেখানে ছড়িয়ে আছে পরিহাস কৌতুক ও ঠাট্টা।
বলাই বাহুল্য বিষবৃক্ষ থেকে পৌরাণিক চন্ডী স্তব এর অনুকরণে এই প্যারোডি রচিত।
নমস্তস্যৈ নমো নমঃ-    

*নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ ।* 
*যা দেবী বটবৃক্ষেষু ছায়ারূপেন সংস্থিতা ।।* 
*নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ ।* 
*যা দেবী দত্তগৃহেষু হীরারূপেন সংস্থিতা ।।* 
*নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ ।* 
*যা দেবী পুকুরঘাটেষু চুপড়িহস্তেন সংস্থিতা ।।* 
*নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ ।* 
*যা দেবী ঘরদ্বারেষু ঝাঁটাহস্তেন সংস্থিতা ।।* 
*নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ ।* 
*যা দেবী মম গৃহেষু পেত্নীরূপেন সংস্থিতা ।।* 
*নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ ।*

 বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

বহুমুখী প্রতিভাধর দ্বিজেন্দ্রলাল রায় বিখ্যাত ছিলেন তার witty প্যারোডির জন্য।
গোবিন্দ চন্দ্র অধিকারীর "শুকসারী সংবাদ" অনুসারে অনায়াসে লিখলেন মজাদার প্যারোডি "কৃষ্ণ রাধা কথা"।

কৃষ্ণ রাধা কথা

কৃষ্ণ বলে, "আমার রাধা বদন তুলে চাও"
আর রাধা বলে, "কেন মিছে আমারে জ্বালাও --মরি নিজের জ্বালায়।"
কৃষ্ণ বলে,"রাধে দুটো প্রাণের কথা কই"
আর রাধা বলে, "এখন তাতে মোটেই রাজি নয় সরো ধোঁয়ায় মরি।"
কৃষ্ণ বলে, "সবাই বলে আমার মোহন বেণু"
আর রাধা বলে, "ওহো শুনে মরে গেনু"।
"আমায় ধরো ধরো।"
কৃষ্ণ বলে," পিতধড়া বলে আমায় সবে"
আর রাধা বলে, "বটে! হলো মোক্ষলাভটি তবে--
থাক আর খাওয়া-দাওয়া"।
কৃষ্ণ বলে, "আমার রূপে ত্রিভুবনটি আলো"। 
আর রাধা বলে,
"তবু যদি না হতে মিশকালো
রূপ তো ছাপিয়ে পড়ে"!!
আবার নারীরাও কিছু কম পিছিয়ে নেই, ডি এল রায়ের ভাষায় নারীদের শ্লেষ:-

এসো হে, বঁধুয়া আমার

এসো হে, বঁধুয়া আমার এসো হে,
ওহে কৃষ্ণবরন এসো হে
ওহে দন্ত মানিক এসো হে,
এস সরিষা তৈল স্নিগ্ধ কান্তি,
পমেটম চুলে এসো হে।
ওহে লম্পট এসো হে,
ওহে বক্কেশ্বর এসো হে,
ওহে কলম জিবি নভেল পাঠক 
ঘরে ঝাঁটা খেতে এসো হে।
ওহে কম্ফর্ট গলে এসো হে
ওহে পেড়ে ওড়নায় এসো হে,
ওহে অঞ্চল দড়ি বন্ধন গরু গোয়ালেতে ফিরে এসো হে।
এসো পূজার ছুটিতে এসো হে
ওহে বড়দিনে ফিরে এসো হে,
এস good Friday তে privilege leave, 
French leave নিয়ে এসো হে।।

(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের "এসো এসো ফিরে এসো"র অনুসরণে।)

ডি এল রায়ের "তোমরা ও আমরা" রবি  ঠাকুরের "তোমরা ও আমরা" অনুসরণে পরলে এই মিঠে বিবাদ, প্রতিদ্বন্দ্বিতা, কলহ খুব প্রকটভাবে চোখে পড়ে

তোমরা ও আমরা
       
তোমরা হাসিয়া খেলিয়া বেড়াও সুখে
(ঘরে )আমরা বন্ধ রই;
তোমরা কিরূপে কাটাও দীর্ঘ বেলা
(তাই )ভাবিয়া অবাক হই;-
আপিসে কাটাও তামাক গল্প-গুজবে
পরে হজগজ সাহেবকে দুটো বুঝোবে
পরে আপনার কাগজপত্র গুছোবে
(শেষে) ক'রে গোটা কত সই।

দুধের সরটি ক্ষীরটি তোমরা খাও
(আর )মোরা খাই তার দহি;
যতক্ষণ কি তোমরা না বাড়ি ফেরো
(ঘরে) মোরা উপবাসী রহি।
তোমরা খাইবে আমরা বসিয়া রাধিবো,
না খাইলে দিয়া মাথার দিব্যি সাধিবো,
তোমরা বকিবে আমরা বেচারী কাদিবো,
তাও তোমাদের সহে কই?

এর প্রত্যুত্তরে কবি নিজেই আবার লিখলেন, "আমরা ও তোমরা"

আমরা ও তোমরা

আমরা খাটিয়া বহিয়া আনিয়া দেই
আর তোমরা বসিয়া খাও।
আমরা দুপুরে আপিসে ঘামিয়া মরি--
আর তোমরা নিদ্রা যাও।
বিপদে-আপদে আমরাই প'ড়ে লড়ি,
তোমরা গহনাপত্র ও টাকা কড়ি
অমায়িক ভাবে গুছায়ে পালকি চড়ি
দ্রুত চম্পট দাও।

সম্পদে ছুটে কোথা হতে এসে পড়ো
আহা! যেন কত কাল চেনা;
তোমরা দোকানী, স্যাকরা পসারী ডাক--
আর আমাদের হয় দেনা
সুখেতে সোহাগে গায়েতে পড়িয়া ঢলি
--নব কার্তিক আর কি!! --আদরে গলি।
"প্রাণবল্লভ" , "প্রিয়তম", "নাথ" বলি
কৃতার্থ করে দাও।

কবি রজনীকান্ত সেনের অনুপম শ্রুতিনন্দন  প্যারোডি "তোমরা ও আমরা" আজও সমান জনপ্রিয়।

আমরা রাধিয়া বাড়িয়া আনিয়া দেই গো
আর তোমরা বসিয়া খাও
আমরা দুবেলা হেঁসেলে ঘামিয়া মরিগো
আর (খেয়ে দেয়ে ) তোমরা নিদ্রা যাও।
আজ এ বিপদ, কাল ও বিপদ, করি গো,
হাতের দুখানা গহনা ও টাকা কড়ি গো
"না দিলে পরম প্রমাদে, প্রেয়সী পড়ি গো!" বলি লয়ে চম্পট দাও।
স্বাধীন চিত্ত নিত্য রাত্রে ঘুরিবে,
কত পায়ে ধরি ,শুনিবে না;
বিষবৃক্ষের চণ্ডীর শ্লোকের প্যারোডি পড়ে কে বলবে যে মা চন্ডীর প্রতি বঙ্কিমচন্দ্রের ভক্তি ছিল না। সবাই জানেন গীতা চন্ডী বঙ্কিমচন্দ্রের জীবনের প্রধান উপাস্য ছিলো। বস্তুত চণ্ডীর রুপক নামের আড়ালে তিনি স্ত্রী জাতিকেই শৈল্পিক কুশলতায় প্যারোডির মাধ্যমে ঈষৎ চটাবার চেষ্টা করেছেন। কিছুটা ভয় ও ভক্তির মিশেলে।

রামপ্রসাদী "কাজ কিরে মন যেয়ে কাশি" এর অনুসরণে সুরেন্দ্র মোহন দে লিখলেন "আধুনিকার আবদার"

আধুনিকার আবদার

কাজ কিরে মন বিয়ে করে
পটের বিবি রয়েচি সেজে
কত রঙিন স্বপ্ন ধরে।
পাউডার রুজে পরিপাটি
বড়ি নাকে গোগলস আঁটি
কাফ্রি ঠোটও করেচি লাল
সুরমা পরী নয়ন ভরে।
চলি রেলে বাসে ট্রামে
যুবকেরা দেখে ঘামে,
রক ছোঁড়ারা স্বপ্নচারী
হতাশে বুক চাপড়ে মরে।
ধোপ দুরস্ত আধুনিকা
যুগের আমি প্রহেলিকা
ভাবতে আমি পারিনা রে
কি যন্ত্রণা আঁতুর ঘরে।।

কৃষ্ণ প্রসন্ন সেন রচিত "যমুনে, এই কি তুমি সেই যমুনে" অনুসরণে কালিদাস রায় ওরফে বেতাল ভট্ট রচিত ‌"বিবাহ" নামক প্যারোডিটি এ প্রসঙ্গে বিশেষ উল্লেখযোগ্য। কথায় বলে বিবাহ এমন এক মিষ্টান্ন যা লোকে খেয়েও অনুশোচনা করে, না খেয়েও আফসোস করে।

বিবাহ

বিবাহ----এই বিবাহের জন্য এত তাড়াতাড়ি
ও যার গুঁতোর ঠেলায় সকালবেলায়
ছাড়তে বুঝি হয় গো বাড়ি।
কোথা সেই-- চন্দ্রমুখের
রসের কথা-- সুখের দুঃখের চাঁদের সুধা নিয়ে কোথায় কাড়াকাড়ি
(কোথায় শুধু কাড়াকাড়ি)
আর---কোথা এই ছিন্নমস্তা, খড়গহস্তা কন্যা প্রসবিনী নারী।
জ্বলেই আছে তেল বেগুনে
ছেলে-মেয়ের মারছে খুনে
যদুর পিসি, মধুর মাসি আসে শুনে
(পাড়ার লোকে আসে শুনে)
রাত্রে ঘ্যানঘ্যানানি প্যানপ্যানানি গয়না তরে মুখ হাঁড়ি। (ক্রমশঃ)
Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours