কাজল ভট্টাচার্য, কার্টুনিস্ট ও সিনিয়র জার্নালিষ্ট, কলকাতা:

চেনা মুখগুলোও যেন সেদিন কেমন বদলে যায়।
রাজনীতিওয়ালাদের ধর্মঘটের দিন।

ঠিক কতদিন আগের ঘটনা মনে নেই।
তবে প্রায় বছর দশেক আগের ঘটনাই হবে।
তখন বাম জামানা। বামপন্থী শ্রমিকদের ডাকা বনধ। দাবী ইসকো আধুনিকীকরণের।

সকাল সকাল বেরিয়ে পড়েছি। খবর করতে হবে। বাইকের পেছনের সিটে ফটোগ্রাফারও তৈরি।
ইস্কো শহর কুলটি। বেশ জমিয়ে বনধোৎসব যাপনের ছবি সর্বত্র। এর তার সঙ্গে কিছু কথাবার্তা বলে, বন্ধ দোকানপাটের ছবি তোলা হলো।
তারপর টার্গেট ইসকোনগরী বার্নপুর। সেখানকার ধর্মঘটের হাল হকিকত দেখতে ফাঁকা জিটি রোডে বাইক ছোটালাম আসানসোলের দিকে। আসানসোল ছুঁয়ে বার্নপুরে ঢুকে পড়া। মিনিট দশেকের মধ্যেই পৌঁছলাম সীতারামপুর চৌরাস্তার মোড়।

রাস্তা আটকানো। ধর্মঘটীরা লাল প্লাস্টিকের চেয়ার পেতে শহরের মূল সড়ক জিটি রোডের দখল নিয়েছেন। পতাকা ফেস্টুনের ভিড়ে লালে লাল। ধর্মঘটীদের ভাবখানা জমিদারীর। রাস্তাই মঞ্চ। সেখান থেকেই কথার ফুলঝুরি ছোটাচ্ছেন নেতারা।
মোড়ে পৌঁছতেই বাইক থামিয়ে দিলেন কমরেডরা। বলতে গেলে খানিকটা তেড়েই এলেন। কার সাধ্যি সেই জনদরদী কমরেডদের ব্যূহ পেরোয়?

ব্যাপারটা কিলিয়ে কাঠাল পাকানোর মতো।
সব বন্ধের পাকাপাকি বহুমুখী ব্যবস্থা। এলাকায় নজরদারি চলেছে। একটি দোকানপাটও যেন ঝাঁপ না তোলে। উড়ে না যায় একটিও পাখি। ক্লান্ত কুকুর শুয়ে দোকানের সিঁড়িতে।
আর তারপরেই শেষ বিকেলে দল, সংগঠন নেতাদের বুক চেতানো দাবি, "মানুষ ধর্মঘটের ডাকে সাড়া দিয়েছেন। বনধ স্বতঃস্ফূর্ত।"
বুকের পাটা না থাকলে এমন 'নির্জলা মিথ্যা' উচ্চারণ করা সম্ভব না।

অগত্যা, আমিও আমার রণকৌশল নিলাম।
ধর্মঘটীদের ভিড়ে খুঁজতে লাগলাম চেনাজানা কমরেডের মুখ। অভিজ্ঞতায় জানি, পুলিশকে বলে এ সময় কাজ হয় না। শাসকের বিরুদ্ধে কিছু করার মতো বোকা নয় তারা।

শুরু করলাম ধর্মঘটীদের বোঝানো। বাইকের "প্রেস" লেখা দেখিয়ে বললাম, "আমি সাংবাদিক। না ঘুরলে ধর্মঘটের খবর করব কিভাবে?"
নাছোড়বান্দা ধর্মঘটীরা। সাফ কথায় জানিয়ে দিল, "ওসব প্রেস-ফেস দেখিয়ে চমকানো চলবে না। বনধ মানে বনধ।"
এদিকে আমিও ছাড়ব না। সাংবাদিক বলে কথা।
"ইগো" বলে তো ইংরাজিতে একটা কথা আছে নাকি! তা ওরা নেতা তো আমিও সাংবাদিক। দু'পক্ষই একে অন্যের হাঁড়ির খবর রাখি।

হাওয়া ক্রমেই গরম হয়ে উঠতে লাগল।
আমি যাবোই। বনধওয়ালারাও যেতে দেবে না। সব বনধেই কিছু অত্যুৎসাহীরা থাকেন। এরা দলের নীচুতলার কর্মী। এমনিতে ওপরতলার নেতাদের দাপটে পাত্তা পান না। বনধের দিনগুলিই ব্যতিক্রম। সেদিন ওই নীচুতলার কর্মীরাই বলতে গেলে ফরওয়ার্ড লাইনে খেলেন। প্রবল প্রতাপশালী। তাঁদের সঙ্গে তর্ক- বিতর্ক জমে উঠতেই এগিয়ে এলেন দু-চারজন উঁচুতলার কমরেড। এই কমরেডদের অনেকের সঙ্গেই হামেশা কথাবার্তা হয়। কিন্তু বনধের দিনে ছবিটাই আলাদা। সেদিন ওই পরিচিত কমরেডদের মুখও বদলে যায়। তাঁদের মুখে কেমন যেন একটা নির্লিপ্ত ভাব। গোমড়ামুখো। মনেই হয় না যে তাঁরা আগে কোনও জায়গায়, কোনদিন আমায় দেখেছে। সুতরাং চলতেই লাগল সাংবাদিক বনাম নেতাদের সওয়াল জবাব।

হঠাতই ভিড় ঠেলে আবির্ভাব, হুইল চেয়ারে বসা জনৈকর। বয়স তিরিশের কোঠায়। এসেই তিনি হাতজোড় করে একমুখ হাসি উপহার দিলেন। বললেন, "আজকের দিনটা একটু কষ্ট করুন। আমাদের সঙ্গে থাকুন।"

ধর্মঘটিদের ধমক ধামক, নরমে গরমে চুপ করালেন। দলের কর্মী, কমরেডদের বোঝালেন, সাংবাদিকদের বাধা দিতে নেই। এরপরেই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, "আমাদের ঘেরাওয়ের এই জায়গাটুকু বাইক নিয়ে হেঁটে যান প্লিজ।"
এরপর আমার আর কিছু করার ছিল না। ভদ্রলোকের কথায় এমনই একটা আন্তরিকতার সুর ছিল, যা অস্বীকার করতে পারলাম না।

জমায়েতের মাঝ দিয়েই রাস্তা করে দিল কমরেডরা। মাথা নীচু করে বাইক নিয়ে ওই জায়গাটুকু হেঁটেই পেরোলাম। শেষ পর্যন্ত ইসকো আধুনিকীকরণের দাবি মেনে নেয় মন্ত্রক। সাল 2013, কর্তৃপক্ষ সেকথা আনুষ্ঠানিক ভাবে জানিয়ে দেয়।

আজকালকার বনধে মারমুখী ধর্মঘটীদের চেহারা এতটুকুও বদলায়নি। সব যেন কপি পেস্ট হয়ে থেকে গিয়েছে। সব দলের, সব ধর্মঘটীদের চেহারাই এক ও অভিন্ন। বেপরোয়া। তবে হুইল চেয়ারবন্দি অমন কোনও সহৃদয় ধর্মঘটী কেউ কি আজও আছেন?

সম্ভবত নেই। ছবিটা আমূল পাল্টে গেছে। তবে বনধের দিনে সেই পুরনো ছবিটাই যেন ফিরে ফিরে আসে। ইতিহাসকেও পাত্তা দিতে চান না ভারতের বামপন্থীরা। গোঁয়ার্তুমি। নাগরিক বিল, কেন্দ্রের শিল্পনীতি প্রভৃতি একগুচ্ছের ইস্যু নিয়ে বুধবার, আট জানুয়ারি ফের বনধ ডেকেছিলো বামপন্থীরা। সঙ্গে জোট বেঁধেছিলো সেই কংগ্রেসীরা। একদিন যাদের বিরুদ্ধে হামেশাই "বিমাতৃসুলভ" আচরণের অভিযোগে মুখর হতো বাংলার বামজোট শাসকরা। আসলে রাজনীতিতে স্থায়ী বন্ধু বা শত্রু কোনটাই হয় না। গোটাটাই ক্ষমতার কানামাছি খেলা।

তবে সেই হুইল চেয়ারে বসা নেতার মতো নেতা থাকলে, বনধের ডাকে আর কেউ সাড়া দিক না দিক, বিরোধিতায় নামার পথ থাকে না।
ধর্মঘটীদের সম্মানে সামনের পথটুকু, সবাই বাইক ঠেলতে ঠেলতে হেঁটেই পেরতো।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours