আনন্দিতা রায়, লেখিকা ও সঙ্গীতশিল্পী, দুর্গাপুর:

ধ্বনিটিরে প্রতিধ্বনি সদা
ব্যঙ্গ করে
ধ্বনি -কাছে ঋণী সে যে পাছে 
ধরা পড়ে

প্যারোডি সম্পর্কেও একই কথা বলা চলে।  যে গান বা কবিতার প্যারোডি করা হয় দেখা গেছে সেগুলি শ্রোতা বা পাঠক উভয়ের কাছেই অতি পরিচিত অর্থাৎ বিখ্যাত। মূল কাব্য বা গদ্য বা গানটি বিখ্যাত না হলে প্যারোডি সুখ্যাত হবে না এবং তার রসবোধ কিছুতেই আনন্দ দেবে না। অতএব প্যারোডি তখনই জনপ্রিয় হবে যদি তা বিখ্যাত গানের সুখ্যাত প্যারোডি হয়।
এটি উচ্চশ্রেণীর কাব্য নয় ইহা বড় কঠিন শিল্প; ছন্দ-বাণীশিল্প।  কঠিন এই অর্থে মানুষকে প্রাণ খুলে হাসানো বড় কঠিন কাজ, কিন্তু প্যারোডি পাঠ করে বা কানে শুনে পাঠক বা শ্রোতা হেসে গড়িয়ে পড়বেন না বটে, কিন্তু মূল রচনাটির সাথে ছন্দ বাণীর প্রতিরূপ এর নির্মল আনন্দ তাকে ছত্রে ছত্রে বিস্মিত ও হাসতে বাধ্য করবেই প্যারোডিকারের রসবোধের গুনে। সকল প্যারোডিই যে নির্মল হাস্যরসের তা নয়, এমন অনেক প্যারোডি আমরা পাই বাংলা সাহিত্যে যা তৎকালীন সামাজিক অর্থনৈতিক রাজনৈতিক ধর্মীয় বৈষম্য অসামঞ্জস্য অধঃপতনকে humour এর মোড়কে বেঁধে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় ব্যঙ্গ বিদ্রুপ ছলে। যা পড়ে পাঠক প্রথমে হাসবেন তারপরে ভাবতেও বসবেন নাড়িয়ে দেবে তার চেতনা। সমাজ সচেতন ব্যঙ্গ বিদ্রুপকারী প্যারোডিকার‌ হলেন আসলে নীতি শিক্ষক ।  মূল্যায়নে তিনি যা ত্রুটি-বিচ্যুতি দেখেন সেখানেই হানেন ব্যঙ্গের তীর। তবে আঘাতটি যেন হাস্যরসের মলমের আড়ালে প্রচ্ছন্ন ভাবে থাকে। তীব্রভাবে প্রকট আঘাত প্যারোডির গোত্রে পড়ে না বলেই সাহিত্য সমালোচকরা মনে করেন।

প্যারোডির হাস্যরস wit শ্রেণীর হাস্যরস। তাই এটি সৃষ্টি করতে গেলে রচয়িতাকে পন্ডিত রসজ্ঞ ও ছান্দসিক হতে হবে। এই wit শ্রেণীর প্যারোডিতে সিদ্ধহস্ত ছিলেন সুখ্যাত কবি নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। একেবারে স্বতন্ত্র স্বতঃস্ফূর্ত তার রচিত প্যারোডি গুলি।  "এখনো তারে চোখে দেখিনি", "সে আসে ধেয়ে", "শুক সারি সংবাদ", "কেন যামিনি না যেতে" ইত্যাদি তার অনন্য সৃষ্টি।
আবার রজনীকান্ত সেন "তোমরা ও আমরা" শিরোনামে লিখছেন, "আমরা রাধিয়া বাড়িয়া আনিয়া দেই গো, তোমরা বসিয়া খাও", যখন ডিএল রায় লিখছেন, "আমরা খাটিয়া বহিয়া আনিয়া দেই আর তোমরা বসিয়া খাও"। রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত" তোমরা আমরা "অনুসরণে। রবি ঠাকুরের "আমি নিশিদিন তোমায়"  গানটির অনুসরণে রসিক- প্রাণ‌ ডিএল রায় লিখলেন----

আমি নিশিদিন তোমায় ভালোবাসি,
তুমি leisure মাফিক বাসিও।
আমি    নিশিদিন রেঁধে বসে আছি
তুমি      যখন হয় খেতে আসিও।
আমি    সারাদিন তব লাগিয়া
      রব চটিয়া মটিয়া রাগিয়া,
তুমি    নিমেষের তরে প্রভাতে এসে
       দাঁত বের করে হাসিও।

বাংলায় কাব্য নির্ভর প্যারোডির মুলাধার ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্র পূর্ববর্তী যুগে মাইকেল মধুসূদন দত্ত।  গদ্য প্যারোডির ক্ষেত্রে বটবৃক্ষের মতো সবাই আশ্রয় করেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে। বঙ্কিম রচনা এর প্যারোডি করেছিলেন যারা তার মধ্যে অন্যতম জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর অমৃতলাল বসু ও কুমারেশ ঘোষ। বঙ্কিমচন্দ্রের  উৎকৃষ্ট গদ্যশৈলী সম্মোহনী ভাষা প্রয়োগ ও অপূর্ব ভাবগম্ভীর  জনপ্রিয় রচনাগুলি প্যারোডিকারদের যারপরনাই প্রভাবিত করে উদ্বুদ্ধ করেছিল প্যারোডি রচনায়। যেমন:-

কুমারেশ ঘোষ
      মস্তান
জনমেজয় কহিলেন, হে মহর্ষে, আপনি কহিলেন যে, কলিযুগে বাবু নামে এক প্রকার মানুষেরা আবির্ভূত হইবেন। তাহারা কি প্রকার মনুষ্য হইবেন এবং পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করিয়া কি কার্য করিবেন, তাহা শুনিতে বড় কৌতুহল জন্মিতেছে। আপনি অনুগ্রহ করিয়া সবিস্তারে বর্ণনা করুন।
বৈশম্পায়ন কহিলেন , হে নরবর, সেই বাবু ও বাবু কালচার এর যুগ চলিয়া গিয়াছে। এক্ষণে যাহারা ধরাধামে বিরাজ করিতেছেন, তাহারা মস্তান নামে খ্যাত। ইহাদের মস্ত মান। ইহারা চশমা অলংকৃত, উদার চরিত্র, আহার নিদ্রা  কুশলী, হিন্দভাষী এবং ড্রাগ প্রিয়। ইহাদের চরিত্র কীর্তন করিতেছি শ্রবণ করুন।
হে রাজন, যাহারা চিত্র-বিচিত্র পোশাকাবৃত, বোম-হস্ত, উগ্র কুন্তল, দাড়ি গোঁফ শোভিত, স্যান্ডেল পরিহিত, তাহারাই মস্তান।
যাহারা বাক্যে অজেয়, পরভাষা পারদর্শী, বঙ্গভাষা বিরোধী তাহারাই মস্তান।
মহারাজ, এমন অনেক মহাবুদ্ধিসম্পন্ন মস্তান জন্মাইয়াছেন এবং জন্মিবেন যে, তাহারা বঙ্গভাষা বা মাতৃভাষায় বাক্যালাপে অসমর্থ হইবেন।
যাহাদিগের রসনেন্দ্রীয় পরজাতি নিষ্ঠিবনে পবিত্র তাহারাই মস্তান। (ক্রমশ)

(মূল রচনা:-বঙ্কিমচন্দ্রের বাবু অনুসৃত কুমারেশ ঘোষ  রচিত প্যারোডির কিছু অংশ)


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours