আনন্দিতা রায়, লেখিকা ও সঙ্গীতশিল্পী, দুর্গাপুর:

"দাদাঠাকুর" 

দাদাঠাকুরের নাম শুনেছেন অনেকেই কিন্তু তাঁকে নিয়ে সেই ভাবে মাতামাতি আজও পর্যন্ত হয়নি। তাঁর জন্ম ১২৮৭ বঙ্গাব্দের ১৩ বৈশাখ বীরভূম জেলার শিমলন্দি গ্রামে। মৃত্যু ১৩৭৫ বঙ্গাব্দের ১৩ বৈশাখ রঘুনাথগঞ্জে। তাঁর আসল নাম শ্রী শরৎচন্দ্র পণ্ডিত।
দাদাঠাকুর ইংরেজ ভক্ত ছিলেন না। যেখানেই শাসকের অত্যাচার ও নীতিহীনতা দেখেছেন, সেখানেই তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গাত্মক লেখনীর মাধ্যমে আঘাত হেনেছেন। কিন্তু হাস্যরস ছিল তাঁর জীবনজয়ের মন্ত্র। অসম্ভব চরিত্রের দৃঢ়তা, অনমনীয় মানসিক শক্তি, কঠোর কর্তব্যপরায়নতা... যেসব গুণগুলো আজকাল মূর্খতার পর্যায়ে পড়ে বলে ধরা হয়, বিধাতা তাঁকে সেইসব গুণে ধনী করেছিলেন।

এক অর্থে তিনিই বাংলার শেষ কবিয়াল।
কলকাতা থেকে ২৫০কি.মি. দুরের রঘুনাথগঞ্জ শহর থেকে প্রকাশ করেছেন ‘জঙ্গিপুর সংবাদ’ পত্রিকা। প্রকাশ করেছেন ‘বোতল পুরাণ’, ‘বিদূষক’ নামের পুস্তিকা আকারে পত্রিকাও। দাদাঠাকুর ছিলেন স্বভাব কবি এবং তীক্ষ্ণধী, সমাজ সচেতন লেখক। নিজেকে জাহির করেননি কোনও দিন। স্বদেশী আন্দোলন ও স্বদেশীয়ানার ব্যাপারে দাদাঠাকুরের আবেগ কোনও অংশেই কারও থেকে কম ছিল না। বিপ্লবীদলের লোক নলিনীকান্ত সরকারকে তাঁর বাড়িতে যথা সময়ে আশ্রয় দেন এবং সর্বোতভাবে সাহায্য করেন। কাজি নজরুল ইসলামের ‘ধূমকেতু’ পত্রিকাতে পাঠান শুভেচ্ছা- "ধূমকেতুর প্রতি বিষহীন ঢোড়ার অযাচিত আশীর্বাদ"।

দাদাঠাকুর ছিলেন '‘একাই একশো'’- তিনি ‘জঙ্গিপুর সংবাদ’-এর কম্পোজিটার, প্রুফ-রিডার, মুদ্রক, প্রকাশক, সম্পাদক এমনকি বিক্রেতাও ছিলেন। দাদাঠাকুর ছিলেন সাংবাদিক, সম্পাদক, সর্বোপরি কবি। দাদাঠাকুরই মনে হয় ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের সুযোগ্য উত্তরসূরি এবং শেষ কবিয়াল।

চৌষট্টি দিন রোগভোগের পর দাদাঠাকুরের এক পুত্র মারা যায়। তার অন্তিম সংস্কার সম্পন্ন করে বিকালে তিনি পূর্বনির্দিষ্ট একটি সভায় যোগ দিয়েছিলেন। অন্তঃকরণ তাঁর বিধ্বস্ত ছিল। কিন্তু সভায় জানিয়েছিলেন শুধু এইটুকু বলে, ‘একটা খেলা সাঙ্গ হল। চৌষট্টি দিন ঠেকিয়ে রেখেছিলাম, আজ পেনাল্টি কিকে গোল খেয়ে গেলাম!’
মনের ঐশ্বর্য কতখানি হলে মানুষ বাহ্যিক দারিদ্রকে নিজের অলঙ্কার করতে পারে দাদাঠাকুর তার আবেগময় নিদর্শন। আমি দেখিনি, কিন্তু এইরকম একটা মানুষকে দেখতে বড় সাধ জাগে। কথায় পাক্কা, আদর্শে অটল অথচ বিশাল হৃদয় সব সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে। 

দাদাঠাকুরের প্রেসে এক কম্পোজিটর ছিল। বড্ড হাবাগোবা। ‘ফ’ উচ্চারণ করতে পারত না। যতবারই তাকে ‘ফ’ বলানোর চেষ্টা করেন দাদাঠাকুর, ততবারই সে বলত, ‘প’। একসময় ওই কম্পোজিটরই বিরক্ত হয়ে বলেছিল, আমাকে দিয়ে হবে না।
দাদাঠাকুর বললেন, হতেই হবে।
দাদাঠাকুর যখন বলেছেন হতেই হবে, তখন তাকে ‘ফ’ না শিখিয়ে যাবেন না। যেভাবেই হোক ‘ফ’ উচ্চারণ তাকে শেখাবেনই। শুরু হলো অদ্ভুত শিক্ষা। কী শিক্ষা?
দাদাঠাকুর একটা মোমবাতি কিনে আনলেন। মোমবাতি জ্বালালেন। ছেলেটিকে বললেন, ফু দিয়ে নেভাও।
এবার কিন্তু ‘ফু’ দিয়েই নেভাতে হলো মোমবাতি। ‘পু’ করে তো আর নেভানো যাবে না।
দাদাঠাকুর বারবার মোমবাতি জ্বালেন, আর ছেলেটি বারবার ‘ফু’ দিয়েই নেভাল। অনেক বার। তারপর একসময় এমনিতেই ফু করতে বললেন। ছেলেটি মুখ দিয়ে ফু করল। তারপর ফু থেকে ফ-তে আসতে আর বেশি সময় লাগেনি ছেলেটির।

সে সময় কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের দারুণ নামডাক। একের পর এক বই বেরুচ্ছে তার।
পাঠক তার ভক্ত হয়ে উঠছে। ‘চরিত্রহীন’ প্রকাশিত হলে চারদিকে আলোড়ন সৃষ্টি হলো। সেই শরৎচন্দ্র আর দাদাঠাকুর একই সভায় আমন্ত্রিত হয়েছেন।
সভায় সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র আগে এলেন। পরে আসা দাদাঠাকুরকে দেখে সাহিত্যিক বললেন, ‘এসো, এসো বিদূষক শরৎচন্দ্র।’
দাদাঠাকুর ব্যাপারটা উপলব্ধি করলেন এবং হা করে সাহিত্যিকের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
সাহিত্যিক আবার রসিকতা করলেন, ‘কি দেখছ হে বিদূষক শরৎচন্দ্র?’
দাদাঠাকুর এবার বললেন. ‘আজ্ঞে, ‘চরিত্রহীন’ শরৎচন্দ্রকে দেখছি।’

(দাদাঠাকুরকে নিয়ে রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মুখে শোনা এই গল্প)

দাদাঠাকুর তখন নিতান্তই নব্য যুবক, তাঁর ক্ষুরধার মস্তিষ্ক ও সাহিত্য প্রতিভার কথা খুব অল্প লোকেই জানে। একবার পুজোর সময়ে ইন্টেলেকচুয়ালদের আড্ডা বসেছে নির্মলচন্দ্রের বাড়ীতে। মধ্যমণি হয়ে বসে আছেন রসরাজ অমৃতলাল, তিনি তখন খ্যাতির মধ্যগগনে। এক অত্যুৎসাহী অমৃতলালের সঙ্গে দাদাঠাকুরের আলাপ করিয়ে দিয়ে বললে, “বড় ভালো লেখে ছেলেটি, মুখে মুখে ছড়া-কবিতা-গান রচনা করতে ওর জুড়ি নেই।’ রসরাজ বাঁকা চোখে তাকালেন দাদাঠাকুরের দিকে, “তাই নাকি হে? তা শোনাও দেখি একখানি গান - না না, পুরনো রচনা হলে চলবে না, একেবারে টাটকা জিনিস চাই।’ দাদাঠাকুর হাত জোড় করে বললেন, “আজ্ঞে, আগে আপনি আশীর্বাদ করুন, নাহলে গান বাঁধব কি করে?’ রসরাজ বললেন, “আচ্ছা, কল্লুম আশীর্বাদ। এবার শোনাও দিকি!’
দাদাঠাকুর গেয়ে উঠলেন, “দুটো মনের কথা তোমায় বলি জগদম্বে’। (অরিজিনাল সুর কেমন ছিল জানি না, তবে রামকুমার এই গানটি শুনিয়েছিলেন কাফি রাগে)।

দাদাঠাকুরের মেয়ে দেখতে এসেছেন এক ভদ্রলোক। কিন্তু মেয়ে দেখার আগেই দাদাঠাকুরের হাতে দাবিযুক্ত লম্বা এক ফর্দ ধরিয়ে দিলেন পাত্রের বাবা।
দাদাঠাকুর বেশ সময় নিয়ে দাবি-দাওয়াযুক্ত ফর্দখানা দেখলেন। এত গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগলেন, মনে হলো যেন তিনি মুখস্থ করছেন ফর্দখানা। অনেকক্ষণ পর ফর্দ থেকে মুখ তুললেন। তাকালেন পাত্রের বাবার দিকে। হঠাৎ জিজ্ঞেস করে বসলেন, মশাই, ভাগা দেবেন?
পাত্রের বাবা এমন প্রস্তাব শুনে বেশ অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন। তিনি বুঝতে পারছেন না কী ভাগা দেওয়ার কথা হচ্ছে। এসেছেন মেয়ে দেখতে। সঙ্গে দাবি-দাওয়াও জানিয়েছেন; কিন্তু ভাগার কথা আসছে কেন? কী ভাগা দেওয়ার কথা হচ্ছে সেটাও বুঝতে পারছেন না। অবাক হয়ে তাকালেন দাদাঠাকুরের দিকে। তারপর আমতা আমতা করে বললেন, আপনার কথা আমি বুঝতে পারছি না। দাদাঠাকুর এবার কষ্টের একটা হাসি দিলেন। তারপর বললেন, দেখুন, আমরা গরিব গেরস্থ লোক, ইলিশ মাছ সস্তা হলে আস্ত একটা কিনি। কিন্তু আক্রার দিনে ভাগা কেনা ছাড়া তো উপায় নেই। আপনার ছেলের আস্ত দাম আমার সাধ্যাতীত, তাই ভাগার কথা বলছি...

দাদাঠাকুর ট্রাম বা বাসের তোয়াক্কা করতেন না খুব একটা। হেঁটে বেড়াতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন বেশি। খালি পায়ে দিগ্বিজয় করে বেড়াতেন। কখনো শতদল গোস্বামীদের বাড়িতে গেলে তিনিই দাদাঠাকুরের পা ধুইয়ে দিতেন। একদিন যথারীতি দাদাঠাকুরের পা ধুইয়ে দিচ্ছেন শতদল গোস্বামী, তখনই বলে উঠলেন দাদা ঠাকুর, "পায়ে ছিল ধুলো, জল দিয়ে তাই ধুলো।" 

রাজ্যপাল হরেন্দ্র কুমারের সঙ্গে দেখা করতে প্রায়ই রাজভবনে যেতেন দাদাঠাকুর। দুজন মিলতও দারুণ। রাজ্যপালের নির্দেশ ছিল, দাদাঠাকুর দেখা করতে এলে যেন তার পথরোধ করা না হয়।
একবার দাদাঠাকুরকে দেখেই হরেন্দ্র কুমার জিজ্ঞেস করলেন, এখানে আসতে কোনো অসুবিধা হয়নি তো?
দাদাঠাকুর বললেন, কিছুমাত্র না। একজন নরকের সঙ্গী আমাকে এগিয়ে দিয়ে গেছে।
নরকের সঙ্গী! কথাটা শুনেই হরেন্দ্র কুমারের চোখ উঠে গেল কপালে। অপার কৌতূহল আর বিস্ময়মাখা দৃষ্টিতে জানতে চাইলেন, নরকের সঙ্গী মানে?
দাদাঠাকুর হেসে বললেন, ওই যে, যাদের মাথায় হেলমেট থাকে, তারাই তো নরকের সঙ্গী । হেল মানে নরক আর মেট মানে সঙ্গী।

কলকাতার বেতার কেন্দ্রের সঙ্গে দীর্ঘ ১৫ বছর যুক্ত ছিলেন দা’ঠাকুর। পল্লীমঙ্গল ও ছোটদের বৈঠক--এই দুটো অনুষ্ঠানেই সাধারণত রস পরিবেশন করতেন তিনি। একদিন কবি নজরুলের প্রোগ্রামের রিহার্সাল চলছিল। হঠাৎ দা’ঠাকুর সে ঘরে ঢুকে পড়লেন। বললেন, শুনলুম তুমি আছ এখানে। তাই চলে এলুম, মানে কান টানল আর কি! কথাটা বলেই মিটিমিটি হাসতে লাগলেন তিনি।
কিন্তু কাজী নজরুল কিন্তু মিটিমিটি নয়, তাঁর স্বভাবসুলভ অট্টহাসিতে পুরো ঘর কাঁপাতে লাগলেন। ওই ঘরে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা সবাই হাসছিলেন। কেবল এক মহিলাশিল্পী না হেসে চুপচাপ চেয়ে রইলেন সবার দিকে। তাঁকে হাসতে না দেখে কাজী নজরুল জানতে চাইলেন, কি গো তুমি নিশ্চয় আমাদের হাসার কারণ ধরতে পারোনি?
মহিলা কবুল করলেন, সত্যি তিনি তাঁদের হাসির কারণ বুঝতে পারেননি।
কাজীদা মানে কাজী নজরুল বুঝিয়ে বললেন, কান হলুম আমি। অর্থাৎ কাজীর কা এবং নজরুল-এর ন। এবার বুঝেছ?
ব্যস। সঙ্গে সঙ্গেই আরো একবার হাসির ঝড় উঠল ১ নং গারস্টিন প্লেসের রেডিও অফিসে।

তৎকালীন রাজ্যপাল ড. হরেন্দ্রকুমার মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে দা’ঠাকুরের সম্পর্ক ছিল বেশ গভীর। দা’ঠাকুর নিজে অনাড়ম্বর জীবনযাপন করতেন। রাজ্যপাল হরেন্দ্রকুমারও অনাড়ম্বর জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। অনেকে মনে করেন, এ কারণেই তাঁদের মধ্যে বেশ মধুর একটা সখ্যও ছিল।
একদিন ড. মুখোপাধ্যায়কে দাদাঠাকুর বললেন, আপনার নামটা ভুল।
রাজ্যপাল অবাক। বললেন, মুরব্বিদের রাখা নাম। ভুল-শুদ্ধ বুঝি না। কিন্তু ভুল হলো কেমন করে?
দাদাঠাকুর বললেন, আপনি যা উপার্জন করেন, সব দান করেন। অথচ আপনার নাম হরেন। আপনি তো হরণ করেন না।
আরেক দিন হরেন্দ্রকুমারকে বললেন, আপনাকে একটা ধাঁধা জিজ্ঞেস করি। আচ্ছা বলুন তো, কি লাট হলে কদর বাড়ে?
রাজ্যপাল বেশ কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন। কিন্তু ধাঁধার জবাব দিতে পারলেন না। বললেন, লাট হলে কদর কমে জানি। লাট হলে কদর বাড়ে এমন তো শুনিনি। আপনিই বলুন না কি সেটা?
দাদাঠাকুর বললেন, মানুষ লাট হলে কদর বাড়ে।

২২ বছর বয়সে মাত্র ৪৬ টাকায় একটা পুরোনো প্রেস কিনে মুর্শিদাবাদের জঙ্গীপুর মহকুমায় রঘুনাথগঞ্জের দফরপুরে “পণ্ডিত প্রেস” চালু করেন।
দাদাঠাকুরকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল:- আপনার প্রেসের নাম “পণ্ডিত প্রেস”কেন? উত্তরে তিনি সহাস্যে বলেছিলেন:- ,”হবে নাই বা কেন? বস্তু যখন খন্ড খন্ড হয় তখন তাকে বলি খন্ডিত। আমি যেখানেই যাই সব কাজ করি পন্ড, তাই আমি পন্ডিত ,এই জন্য “পণ্ডিত প্রেস”।”
কিভাবে তিনি সব “কাজ” পণ্ড করতেন তার একটা নমুনা দেখা যাক!
“পণ্ডিত প্রেস” থেকে বেরুত “জঙ্গীপুর সংবাদ”। এই পত্রিকার প্রধান আয়ের উৎস ছিল- মুন্সেফ আদালতের বিজ্ঞাপন। কিন্তু তিনি সরকারকে আক্রমণ করতে ছাড়েননি!
মহকুমা হাকিমের এক অন্যায়ের বিরুদ্ধে লিখেছিলেন:-
চোরে চোরে মাসতুতো ভাই হাকিমে মুনসেফে কেসতুতো ভাই। 

একবার তাঁর প্রতিবেশী কার্ত্তিক চানাচুরওয়ালার ত্রৈমাসিক পুরকর বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে গেল। দাদাঠাকুর কার্তিকের হয়ে দরখাস্ত দিলেন। কোনো কাজই হলো না। বরং ছয় আনা (।৵০) থেকে বেড়ে দেড় টাকা (১।।০) হয়ে গেল।
সুযোগ ধরা দিল যেচে এসে । পুরসভার চেয়ারম্যানের মৃত্যুতে একটি পদ খালি হলে, পৌরসভাতে উপনির্বাচনের ঘোষণা হল।
দাদা ঠাকুর কার্তিককে সেই নির্বাচনে দাঁড় করিয়ে দিলেন। ছড়া ছাপা হল “জঙ্গীপুর সংবাদ”-এ:-
ভোট দিয়ে যা---আয় ভোটার আয় সুদ দিলে টাকা দিবো ফি দিলে উকিল হব চাল দিলে ভাত দেব মিটিংয়ে যাব না অবসর পাব না কোনো কাজে লাগবো না যাদুর কপালে আমার ভোট দিয়ে যা!
কার্ত্তিক জিতল। কিন্তু অভিজাত পুরপিতাদের আর জাত- কুল- মান বলে কিছুই থাকল না! ছ্যা ছ্যা! একটা চানাচুরওয়ালার কাছে হার!!!
তারা প্রেসিডেন্সি কমিশনারের কাছে গিয়ে একযোগে পদত্যাগ করবেন বলে হুমকি দিলেন। আবার দাদাঠাকুর নামলেন আসরে। প্রেসিডেন্সি কমিশনারকে কোলকাতায় গিয়ে বুঝিয়ে বলাতে, আসল ব্যাপারটা বুঝে কমিশনার সাহেব, ক্যালকাটা গেজেটে কার্ত্তিকের নাম বের করে দিলেন। মহুকুমা হাকিম পরে একদিন গেজেটের কপি নিয়ে স্বয়ং কার্তিকের হাতে দিয়ে অভিনন্দন জানালেন আর মহকুমা আদালতের স্থানীয় ছোটখাটো মামলার তদন্তের ভার কার্ত্তিকের ওপর সঁপে দিলেন।
অভিজাত পুরপিতাদের জাত- কুল- মান, সব চুপসে গেল।
মদ্যপান বিরোধী একটা কাগজ বের করলেন বোতোলের আকারে। নাম দিলেন “বোতল পুরাণ”!!!!
প্রতি সপ্তাহে রঘুনাথ গঞ্জ থেকে কোলকাতায় এসে হাতিবাগানে নেচে নেচে ফেরি করতেন ঐ কাগজ। সাথে থাকতো “বিদূষক” বলে আরও একটা কাগজ।
একদিন তাঁর পরিচিত একজন তাঁকে নিয়ে এল আর্ট থিয়েটারের ম্যানেজার অপরেশ মুখোপাধ্যায়ের ঘরে। সে ঘরে আড্ডা দিতেন অপরেশবাবু, জীবনবাবু, তিনকড়ি চক্রবর্তী, প্রবোধ গুহ, দানীবাবুরা।
দাদাঠাকুরকে দেখে দানীবাবু হাত তুলে নমস্কার করে বললেন, “আজকাল আর চোখে ভাল দেখি না। আমার প্রনাম নেবেন।“
দাদাঠাকুর দানীবাবুর পাশে বসে গল্প জুড়ে দিলেন।
তাই দেখে তিনকড়িবাবু বললেন,” পন্ডিত মশাই, আমাদের দিকেও একটু কৃপাদৃষ্টি নিক্ষেপ করুন।”
দাদাঠাকুর হাসতে হাসতে উত্তর দিলেন, ”গরীব ব্রাহ্মণে দানী দেখলেই তাঁর কাছে যাই। আপনার ও তিনটি মাত্র কড়ি একমাত্র বামুনের হুঁকায় লাগানো ছাড়া আর কোনো কাজে লাগে না।”

বঙ্গ “বিদূষক” দাদাঠাকুরের আরও একটা গুণ ছিল- হাজির জবাব বা ইংরেজীতে যাকে বলে “রিপার্টি”।
তার একটি নমুনা :-
দাদাঠাকুরকে তাঁর পরিচিত একজন জিজ্ঞাসা করলেন, “ আপনি রবি ঠাকুরকে দেখেছেন ?”
দাদাঠাকুর উত্তরে বললেন, “না দেখিনি, তবে দেখা হলে বলতুম আপনি যেমন ঠাকুর, আমিও তেমন পন্ডিত ।”

একবার নলিনী সরকারের বাড়িতে এসে দাদাঠাকুর বললেন, “বুঝলে হে নলিনী তোমাদের এই শহর কলকাতা বড় অদ্ভূত।” নলিনীকান্ত বললেন, “কেন এই শহরের হলটা কি?”
দাদাঠাকুর বললেন, “হবে আবার কি? রোজ যা হচ্ছে! পাঁজিতে লেখা বছরে একদিন রাস, একদিন ঝুলন। কিন্তু এই শহর কলকাতায় নিত্য রাস, নিত্য ঝুলন।”
নলিনীকান্ত - “কোথায় দেখলেন নিত্য রাস আর নিত্য ঝুলন?”
দাদাঠাকুর - “কেন তোমাদের ট্রামে বাসে যেমন রাস তেমন ঝুলন।”

একবার নলিনীকান্ত সরকারের বাড়ি দাদাঠাকুর এসেছেন, তাঁর মেয়ের জন্মদিনে। ছানার ডালনা পরিবেশন করা হচ্ছে। নলিনীকান্ত একটু রসিকতা করলেন - “দাদা একটু গরুর ছানার ডালনা দিই?”
সঙ্গে সঙ্গে দাদাঠাকুর বললেন, “দে ভাই, গরুর ছানার ‘অকেশনেই’ তো এসেছি।”

দাদাঠাকুর আর নলিনীকান্ত সরকার একদিন পাশাপাশি ঘুমোচ্ছেন।
হঠাৎ গভীর রাত্রিতে নলিনীকান্তকে জাগিয়ে দাদাঠাকুর বললেন, “ওরে নলিনী, একটা বড় জিনিষ আবিষ্কার করেছি। নলিনী পন্ডিতের (সাহিত্যিক ও সাহিত্য পরিষদের চির সদস্য) সব সম্পত্তি তোর আর আমার।”
ঘুম ভাঙ্গা চোখে নলিনীকান্ত- “কি করে হবে ?”
দাদাঠাকুর — “কেন তুই নলিনী আর আমি পন্ডিত! দুজনে মিলে নলিনী পন্ডিত।”

বহরমপুর পৌরসভায় ভোট হবে । লড়াই দুজন সদস্যের মাঝে ।
একজন রমনীমোহন, অন্যজন নীলমণি ভট্টাচার্য্য । দুজনেই দাদাঠাকুরের সুপরিচিত ।
ভোটের আগে দাদাঠাকুর বললেন,” রমনীর জয় হবে আর নীলমণি হেরে যাবে ।”
ভোটের ফল বের হলে দেখা গেল দাদাঠাকুরের কথাই মিলে গেছে ।
সবাই তখন তাকে বললে, “এমনটা যে হবে সেকথা আপনি আগে থেকে জানলেন কিভাবে?”
দাদাঠাকুর বললেন, “এ তো খুব সহজ, রমনীর (Raw Money-র) সাথে নীলমণি (Nil Money) পারবে কেমন করে?”

একদিন এক ধনীর বাড়ি নিমন্ত্রণ খেয়ে পরদিন ছাপাখানায় এসে একটা ঢেঁকুর তুলে নলিনীকান্ত সরকারকে বললেন,  "একটু তামাক সাজ, শরীরটা আজ ভালো নেই"।
নলিনীকান্ত জিঞ্জাসা করলেন, “কেন আবার কি হল?”
দাদাঠাকুর বললেন,” কালকের ঐ ব্রাহ্মণ ভোজনের জের, সারা রাত্রি পেট্রিয়ট হয়ে বিছানায় ছটফট করেছি ।”
নলিনীকান্ত - “পেট্রিয়ট হয়ে, সে আবার কি ?”
দাদাঠাকুর - “পেটের মধ্যে রায়ট বাধলে লোকে পেট্রিয়ট হয়। আর বলিস কেন, পোলাও, লুচি, মাছ, মাংস, মন্ডা-মিঠাই সব পেটের মধ্যে ঢুকে পড়ায়, সেই সব অপরিচিতদের দেখে, যারা স্থায়ী বাসিন্দা, ডাল-ভাত, শাক-চচ্চড়ি একত্রে উচৈঃস্বরে Who are you. Who are you? করে রায়ট বাধিয়ে দিল। সারা রাত্রি পেটের মধ্যে ভারি অশান্তি। তোর কাছে যখন এলুম তখনও Who are you? (ঢেঁকুর) বলে একবার হাঁক ছাড়লে।”

রামকুমার চট্টোপাধ্যায় তখন সবে নাম-টাম করতে আরম্ভ করেছেন। রেডিওয় প্রোগ্রাম ছিল গানের। গান করে বেরিয়েই, দেখেন শরৎচন্দ্র পন্ডিত (দাদাঠাকুর) রেডিও স্টেশনে ঢুকছেন। দাদাঠাকুর রামকুমারকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমাকে তো ঠিক চিনলাম না!” রামকুমার জবাব দিলেন, ‘আজ্ঞে, আমি গাই’। দাদাঠাকুরের প্রশ্ন, “অ, তা কত সের দুধ দাও?”
দাদাঠাকুরের রেডিওর প্রোগ্রাম শেষ হবার মুখে, পরের প্রোগ্রাম বাংলা খবর। দাদাঠাকুর আজকের মতন এই বলাতেই কাঁচের ওদিক থেকে প্রোগ্রাম শিডিউলার গোছের কেউ হাত নাড়িয়ে দাদাঠাকুরকে জানালেন নিউজ রিডারের তৈরী হতে আরো মিনিট খানেক দেরী আছে।
দাদাঠাকুর এক ঝলকে সেটা বুঝে নিয়েই বলতে থাকলেন –
এর পরে হবেই সংবাদ। তোমরা সবাই জানো কি সংবাদকে ইংরিজিতে NEWS কেন বলা হয় ? কারণ North, East, West আর South প্রতিটি দিক থেকে লোকজনের আর দেশদশের খবর পরিবেশন করা হয় সংবাদে !

দাদা ঠাকুর কৃত প্যারোডির সংখ্যাও বাংলা সাহিত্যে কম নয়। তারমধ্যে ডি এল রায়ের রচনার প্যারোডি কয়েকটি:--

বর্ত্তমান না মর্ত্তমান

আজি এসেছি আজি এসেছি এসেছি বধু হে নিয়ে এক ছড়া মর্ত্তমান
আজি আমার যা ঝুটা আছে
এনেছি তোমার কাছে  
সাচ্চা কভু না করিব দান।
আজি তোমার নরম গলে
রাখি এর সভ্যতা হার
বিষম করের ভারে দম ফেলা হবে ভার
মদিরা অধরে ধরি, ঢুক করে পান করি
দাও সিগারেটে এক টান।
আজি মেয়ের বিয়ের জ্বালা সাহেবের কান মলা
এক ঢোকে হবে অবসান।

(ডি এল রায়ের "আজি এসেছি আজি এসেছি এসেছি বধু হে" গান অনুসরণে)
আবার দেখি

বিশ্বপ্রেমের আহ্বান

ওই সপ্ত সিন্ধুর ওপার থেকে কি আহ্বান ভেসে আসে
কে ডাকে আকুল তানে, বিপুল টনে, আয় ছিঁড়ে আয়
ওরে আয় ছিঁড়ে আয় মোহ পাশে
বলে আয়রে ছুটে আয়রে ত্বরা
হেথা নাইকো আবরু নাই পাহারা
হেথা বাতাস বিলাস গন্ধ ভরা, আর্টের বাহার বারো মাসে
হেথা চির মধু চন্দ্র ধারা চির যুগল মিলনাশে।
(দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের "ওই মহাসিন্ধুর ওপার থেকে কি সঙ্গীত" গান অনুসরণে)

কিম্বা ,

চাষার ম্যালেরিয়া বিলাস

আমি সারা সকালটি শুয়ে শুয়ে এই ম্যালেরিয়া জ্বরে কেঁপেছি,
আমি সারা সকালটি করি নাই কিছু করি নাই কিছু প্রভু আর,
শুধু মাদুরেতে শুয়ে কাঁথা মুড়ি দিয়ে ম্যালেরিয়া জ্বরে কেঁপেছি।
তখন ধুকিতেছিল সে ম্যালেরিয়া বিষে
চি চি করে পাশে পড়িয়া
তখন বাড়িতেছিল সে উদরের প্লীহা পেটটা ডাগর করিয়া। (ক্রমশঃ)
Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours