আনন্দিতা রায়, লেখিকা ও সঙ্গীতশিল্পী, দুর্গাপুর:

শিবরাম চক্রবর্তী (ডিসেম্বর ১৩, ১৯০৩--আগস্ট ২৮, ১৯৮০) প্রখ্যাত বাঙালি রম্যলেখক। কবিতা-রচনা দিয়ে সাহিত্য-জীবনের শুরু। প্রথম কবিতা বেরোয় ভারতী পত্রিকায়। প্রথম প্রকাশিত বই দুটিও -- 'মানুস' ও 'চুম্বন' -- কবিতার। দুটিই প্রকাশিত হয় ১৯২৯ সালে। তারপর অজস্র লেখা লিখেছেন। প্রবন্ধ, নাটক এবং তুলনাহীন অজস্র হাসির গল্প। লিখেছেন ঈশ্বর পৃথিবী ভালবাসা ও ভালবাসা পৃথিবী ঈশ্বর নামের অনন্য স্মৃতিকথামূূলক দুটি বই। প্রবন্ধের বই : মস্কো বনাম পন্ডিচেরি ও ফানুস ফাটাই। নাটকের গ্রন্থ : যখন তারা কথা বলবে। বিচিত্র জীবন ছিল তার। রাজনীতি করেছেন, জেল খেটেছেন, রাস্তায় কাগজ ফেরি করেছেন, ফুটপাথে রাত্রিবাস করেছেন, সাংবাদিকতা করেছেন, আজীবন মেস-জীবন যাপন করেছেন। করেন নি যা, তা হল বিয়ে।
তার বিখ্যাত প্যারোডি গুলির মধ্যে অন্যতম:-

আবার তোরা বামুন হ

কিসের শোক করিস ভাই
আবার তোরা বামুন হ'
গিয়াছে মান দুঃখ নাই
আবার তোরা বামুন হ'।
রাখিয়া টিকি কাটিয়া ফোটা
হাজার দুয়েক পত্নী জোটা
কুলিনতার কররে ঘটা
আবার তোরা বামুন হ'।
যেথায় পাবি পোলাও লুচি
দক্ষিণা ও মর্তমান
সবান্ধব ও সবান্ধবী
সেথায় হ  রে বর্তমান।।

(দ্বিজেন্দ্রলালের "মেবার পতন" নাটকের শেষ দৃশ্যের "কিসের তরে শোক করিস ভাই, আবার তোরা মানুষ হ" অনুসরণে রচিত)

একটি স্তবক

বাঘাযতীন ছিল বাংলাদেশের রাজা
শিবরাম ছিল কোন ভ্রমে।
একদা কি করিয়া মিলন হল দোঁহে
নাতি ও নাতনি মাধ্যমে।।

(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দুই পাখি কবিতা অনুসরণে)।
বাংলা সাহিত্যে সে যুগের তুলনায় বর্তমানে গঠনমূলক প্যারোডির উপস্থিতি নেই বললেই চলে। তবে রম্য পত্রিকাগুলো কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে প্রায়ই এর টুকরো টুকরো উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।
কল্যাণ কুমার মুখোপাধ্যায় সাধক কবি রামপ্রসাদ সেনের "মন তুই বাঙালি কিসে"র অনুসরণে লিখলেন "মন তুই বাঙালি"

মন তুই বাঙ্গালি

মন তুই বাঙালি কিসে।
ও তুই জানিস নারে সর্বনেশে।।
বিবিধ ভারতী লয়ে রেডিওতে শুনছো বসে
ও তোর ফিল্মি নেশা সর্বনাশা
গাঁজা দম দিচ্ছ কষে।।
সাহিত্য তোর দেউলে হল পরের নকল করছ বসে।
যেমন গান তার তেমনি ছবি পরবাসী আপন দেশে।।
কি সুকৃতি সঙ্গে যাবে
শমন যখন ধরবে কেশে
দিন দ্বীজের শোন মিনতি রতন পাবি এই স্বদেশ।।

পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে বাংলা সাহিত্যে কাব্য প্যারোডির মূলাধার ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি স্বয়ং ব্যঙ্গ রসাত্মক প্যারোডির সমর্থন করেছেন নিশ্চিতভাবে, কখনো কখনো উল্লাস প্রকাশ করেছেন স্বজনদের কাছে। খামখেয়ালী সভায় অনেক  বিদ্বজনের উপস্থিতিতে ডি এল রায়ের প্যারোডি শুনে যারপরনাই আনন্দ প্রকাশ করেছেন। নিজে রচনা করেছেন  প্যারোডি প্রচলিত ছড়া "এ তো ভারি রঙ্গ" অনুসরণে।
এত বড় রঙ্গ জাদু, এত বড় রঙ্গ।
চার মিঠে দেখাতে পারো যাব তোমার সঙ্গ।

চিরকুমার সভা প্রকাশিত হয় তেরোশো সাত সালে ভারতী পত্রিকায় উপন্যাসের চেহারায়। ১৩০৭ সালের ১৩ই ভাদ্রের সংখ্যায় সাংস্কৃতিক মুখপাত্র নাচঘর লিখল। মনোমোহন নাট্য মন্দিরে শীঘ্রই রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত রচনা চিরকুমার-সভা অভিনীত হবে। সকলেই জানেন চিরকুমার-সভা এতদিন আধা উপন্যাস ও আধা নাটকের আকারে বর্তমান ছিল। কিন্তু শিশিরকুমারের  অভিনয়ের সুবিধার জন্য রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং তাকে পুরো দস্তুর নাটকে রূপান্তরিত করেছেন। ওয়াজেদ আলী শাহ স্মৃতিধন্য "যব ছোড় চলি লখনৌ নগরী" এর আদলে লেখা হয়েছিল হিন্দু মেলার গান কত কাল পরে বল ভারত রে। তার অনেক পরে নবযুবা রবীন্দ্রনাথের গানে এই কলিটি ফিরে এলো স্বতন্ত্র চেহারায়----
গান:- "কতকাল রবে বলো ভারতরে"

নির্মল হাস্যরস রঙ্গ ব্যঙ্গ রসিকতা এই নিয়েই প্যারোডি। কখনো কখনো ব্যক্তিগত হিংসা আক্রোশেও যে প্যারোডি রচিত হয়নি এমনটা নয়। কিন্তু সেগুলো মানুষের মনে স্থায়ীও হয়নি। প্যারোডি শুনতে শুনতে বা পড়তে পড়তে হাসি পাওয়া ও হাসিয়ে দেওয়া ও কিছু প্যারোডিতে হাসির মোড়কে অনেক গভীর জনচেতনা মূলক  বার্তা ও জনমত তৈরি করার অভিলাষাই প্যারোডি রচনার মূল উদ্দেশ্য। এর রস এর মর্ম রসিকেই বোঝে।  কিছু সংখ্যক মানুষ আছেন যাঁদের হাস্যরসের সিক্সথ সেন্স বা যাকে বলে জ্যোতিরিন্দ্রিয় --সেটা হয়তো তথ্য সূক্ষ্ম নয়। টুকরো টুকরো প্যারোডির চলনে হাসির খোরাকে তাদের টাকরায় হাসি আসে না। মজাও খুঁজে পান না তারা। এটা রুচি ও অভিরুচির বিষয়।

এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্র কবিতার একটি প্যারোডি শুনুন

ছোট মজা ছোট হাসি ছোট ছোট সুখরাশি
নেহাতই তরল সরল
হাজার কৌতুক রাশি প্রতিদিন যায় ভাসি
তারই কয়টি রঙ্গ দল
নাহি বর্ণনার ছটা
অঘটন আছে ক'টা
নাই তত্ত্ব নাহি উপদেশ
পরান তৃপ্ত যবে
হেসে হেসে মনে হবে
অবশেষে থাকে হাসি -রেশ।

আসুন বাংলা সাহিত্যের রত্ন খনির মধ্যে হতে প্যারোডি বিষয়টিকে আমরা বাঁচিয়ে রাখি আমাদের মুখের হাসির মতো অক্ষয় করে রাখি। মূল্যবোধে হাস্যরসে রঙ্গ ব্যঙ্গে সম্পৃক্ত সুকুমার প্যারোডি আরো রচিত হোক জনমানসে জনচেতনা আনন্দ দেবার জন্য। (সমাপ্ত)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours