কাজল ভট্টাচার্য, কার্টুনিস্ট ও সিনিয়র জার্নালিষ্ট, কলকাতা:

সম্পর্ক ভাঙে সন্দেহ।
সন্দেহের লাভাস্রোত জমে অবিশ্বাস।

মুখোশ খসে পড়ে আপনজনের। একে একে। তারা থেকে উল্কা খসে পড়ার মতো। তাতে অবশ্য আকাশের কিছু আসে যায় না। তাজ্জব বনে যেতে হয় মুখোশ খসে পড়া মুখগুলির আসল চেহারা দেখে। ভ্রুহীন, পাতাহীন চোখ। মেকাপের পলেস্তারা খসা গাল। তাতে অজস্র কুঞ্চন। পিম্পলসের ছোট বড় ক্ষত। যেন অতীতের স্মৃতি। শুকনো খটখটে ঠোঁট। কেমন পোড়া পোড়া রং তাদের।

সম্পর্ক শিথিল হতে হতে একসময়, খুলে যায় গিঁট। খসে পড়ে আপনজনের বাঁধন। ভোরের শিউলির মতো টুপটাপ ঝরে পড়ে মায়া, মমতা, স্নেহ, আশা ভরসা। খানখান হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে, দুর্বলতার মান অভিমান। ঝরে পড়ার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত মিষ্টি সুবাস বিলায় শিউলি। বৃন্ত থেকে খসে পড়লেই সব শেষ। ধুলায় গড়াগড়ি। ঠাকুরঘরে ভক্তির আসনে আর জায়গা হয় না। এসবকিছু ছাপিয়ে জেগে থাকে এক নিঃস্ব, অন্তঃসারশূন্য মানুষ। ভক্তিহীন। শ্রদ্ধাহীন। বসন্তের আবেগ হয়ত তখনও সম্পূর্ণ শুকায় না। সময় নেয়। বুকের তলে বয়ে চলে ফল্গুধারা। পরিবার স্বজনহীন একা 'এক মানুষ'। সে পুরুষও হতে পারে, আবার নারীও।

সব ভাঙনেরই গর্জন আছে। মেঘ ভেঙে পড়ে বজ্রধ্বনিতে। নদীর কূল ভাঙে বিকট শব্দে। হয়ত বা প্রতিবাদের কন্ঠ। যন্ত্রণার প্রকাশও হতে পারে। যন্ত্রণা চিরবিচ্ছেদের। মেঘ আর আকাশের। কূল আর জমিনের।
একমাত্র ব্যতিক্রম সম্পর্কের ভাঙন। নিঃশব্দে ভাঙে। বৃন্ত থেকে ফুল, ডাল থেকে শুকনো পাতার সম্পর্ক ভাঙার মতো। সম্পর্ক ভাঙার যন্ত্রণা হয়ত বা বাষ্প হয়ে উবে যায়, চোখ বেয়ে গালে ঝরে পড়ার আগেই।
বন্ধন শেষ ঘরের, পরিবারের। এবার চোখ মেলে বাইরে তাকানো। সেখানেও পান থেকে চুন খসলেই বিপদ। বাইরের দুনিয়ায় চলাও যা, রশির ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়াও তা। মারাত্মক ঝুঁকির। সাবধানী পদক্ষেপ। গোটা মন কেন্দ্রীভূত রশিতেই। লক্ষ্যে পৌঁছতে গেলে এছাড়া উপায় নেই। পা পিছলালে ধরার কেউ নেই। পথচলার আনন্দ, আবেগ উধাও। বেনিয়ার মতো। নিশানা একমাত্র মুনাফা। তা সে যে পথেই পেটি ভরুক না কেন ! শুধু প্রাপ্তির আশায় রশি বেয়ে এগিয়ে চলা। আগে পিছে, ডাইনে বাঁয়ে নিয়ে নির্লিপ্ত। যোগীর সাধনা। রসিকজনের অসাধ্য।

জীবনরসে ঘাটতি। তীব্র অভিমান জমে জীবনের ওপরে। জীবন ওসব পাত্তা দেয় না। সরলরেখায় তার গতি। মনের চোরাগলির রাস্তাঘাট সে চেনে না। জীবন অনুভূতিহীন এক নিরেট বাস্তব। শক্তিমানরাই পারে তা নিংড়ে রস বের করে আনতে। বিধ্বস্ত সেই 'একা মানুষ'-এর সাধ্যে তা কুলায় না।

জীবন থেকে ক্রমেই সরে আসে সেই 'একা মানুষ'। ক্রমেই দূরত্ব বাড়তে থাকে তার চেনা, এতদিনের পরিচিত বাইরের দুনিয়া থেকেও। সন্দেহের ছায়া গ্রাস করে তাকে। সন্দেহ তখন আতঙ্ক। এক সর্বনাশা ঝড়ের পূর্বাভাস। থমথমে চারিদিক। জলে স্থলে অন্তরীক্ষে গুমড়ে ওঠা টলটলে আবেগে বিস্ফোরণের কাউন্ট ডাউন।

সন্দেহ, অভিমানের সেই ঝড়ে আবার কাউকে হারানোর ভয়। তছনছ স্বপ্নদুনিয়া। ঝড় নিজেও খবর রাখে না, কী হতে চলেছে। হয়তবা মরমে অবিরত ঘূর্ণিপাক খায় পুরনো আবেগ। পথ আগলে দাঁড়ায় সন্দেহ। ফেরার পথ নেই। ফিরলেও স্বপ্নবাসর রুদ্ধদ্বার। অভিমানের তালা আর খোলে না।

অবিশ্বাসের অপরাধে মুখ লুকায় সেই 'একা মানুষ'। সবার অজান্তে। একে একে সরে যায় ঘনিষ্ঠরাও। একসময় নিজেরই টানা সন্দেহ, অবিশ্বাস, আতঙ্কের বৃত্তে এক 'একামানুষ'।
নিকষ আঁধার তাকে ধীরে ধীরে শেখায় বেঁচেবর্তে থাকার বিদ্যা।
একাই এক নির্জন দ্বীপের মানুষ। সেই দ্বীপে সে নিজেই প্রজা। নিজেই রাজা। কারুর শাসন মানে না। শাসনও করে না কাউকে।
সহজে মেলে না, জীবন থেকে মুক্তি। বড় লোভের এই বেঁচে থাকা। রোজ সকালে উঠে সূর্যপ্রণাম। সন্ধে নামলেই জোনাকির সঙ্গে লুকোচুরি খেলা। তবে মায়াবী চাঁদের আলোয় ছাতির ভেতরটা আজও টনটন করে। দিশাহীন সাগরপারে অনিমেষ তাকিয়ে থাকা। হারিয়ে ফেলা কাউকে খোঁজা, নাকি নিজেকেই খুঁজে মরা? 'একামানুষ' নিজেও হয়ত তা বলতে পারবে না। আর বলবেই বা কিভাবে, হারিয়ে গেছে মুখের ভাষাও। কথা বলায় দীর্ঘকালের অনভ্যাস। রাত নামে সাগরবুকে। ক্লান্তি ভর করে চোখের পাতায়। তারার মশারি খাঁটিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে 'একামানুষ'।

দুনিয়া হাততালি দেয়। এতদিনে মানুষটা স্বাবলম্বী হলো তবে!

চারদিকে অথৈ জল। চার দেওয়ালে ঘেরা সেই দ্বীপ। সেখানেই স্বেচ্ছা- নির্বাসিত এক 'একামানুষ'।বিশ্বব্রহ্মাণ্ড থেকে আলাদা। হারিয়ে যাওয়া জীবন থেকে।
সেই হারিয়ে যাওয়ার খবর, কেউ রাখে না।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours