শ্বেতা ঘোষ, ফিচার রাইটার, নৈহাটি, উত্তর ২৪ পরগনা:

একটিমাত্র টয়ট্রেন। বন্ধন হল তিন প্রজন্মের!
শীতের দুপুরের জড়তা কাটিয়ে এক্কেবারে নিয়ম মেনেই চক্কর দিতে দিতে টয়ট্রেন এসে থামল নির্দিষ্ট জায়গায়। উফ সেকি চওড়া হাসি সারা মুখ জুড়ে অনন্যা চক্রবর্তীর। টয়ট্রনের আদুরে যাত্রাপথ শেষ করেই তিনি বলে উঠলেন, "ছেলে বৌমা ও নাতিকে নিয়ে টয়ট্রেনে চাপলাম। কিছুক্ষনের জন্য তিন প্রজন্মের এই স্বপ্নের অনুভূতি আমার সমস্ত অন্তরাত্মাকে কাঁপিয়ে দিয়েছে।" তাঁর মন্তব্য, বর্তমানে আমি ম্যাঞ্চেস্টারে থাকি। দুর্গাপুরে ছেলের কাছে এসেছি। এখানে আসবো আর সবাইকে নিয়ে টয়ট্রেনে ভ্রমণ করবো না এটা হতে পারে না। বিদেশে বসবাস করে দুর্গাপুরের টয়ট্রেনকে খুব মিস করি। অনন্যা দেবীর এই উচ্ছ্বাস বাস্তবিক অর্থে টয়ট্রেনের ঐতিহ্যকে আজও উজ্জ্বল করে রেখেছে।
সেকি টয়ট্রেনের ঐতিহ্য আবার কিরকম? উত্তর যেন তৈরি ছিল কলেজ ক্যাপেল সুমন যাদব ও রানি সেনের কাছে। টয়ট্রেনের থেকে নেমে তাঁরাও জানান, এই বিনোদন দক্ষিণবঙ্গে এই একটি। তিন দশকের বেশি সময় যাবৎ টয়ট্রেনের চাকা আজও ঘুরেই চলেছে দুর্গাপুর শিল্পশহরে। মানতেই হবে এটা দেশের চিমনি শহরের এক ঐতিহ্য।
দুর্গাপুরের প্রানকেন্দ্র সিটিসেন্টারে অবস্থিত আনন্দ অ্যামিউজমেন্ট অ্যান্ড ওয়াটার পার্ক। একদা এর সাবেকী নাম ছিল টয়কা পার্ক। এই পার্কের বুক চিড়ে বন বনানী ও লেকের টই টম্বুর জলকে পাশ কাটিয়ে টয়ট্রেন যে প্রতিদিন এখানে চক্রাকারে বনবন ঘুরেই চলেছে। শুধুই কি টয়ট্রেনের মাধুর্য্যে এই পার্কের বিনোদন সম্পন্ন নাকি?
আরে না না! চাকুম চুকুম খাসা খাসা বিনোদনে ঠাসা ঠাসা দুর্গাপুরের সিটিসেন্টার স্থিতি এই আনন্দ অ্যামিউজমেন্ট অ্যান্ড ওয়াটার পার্ক। আট থেকে আশি বললে ভুল হবে। বরং অনায়াসে বলা যায় কোলের ছোট্ট শিশুটি থেকে শতাব্দী উর্ধ প্রাচীন মানুষটির বিনোদনের জন্য এখানে রয়েছে রকমারি আনন্দ গ্রহণের আধুনিক মানের পসরা। মন খারাপ করা মানেই আপনি একাই চলে আসুন এখানে। পরিবার বা বন্ধু বা একান্ত সঙ্গী সঙ্গে আনতে চান? কোনও দিদ্ধা না করে চলেই আসুন এই পার্কের অন্দরমহলে। আপনার জন্য অপেক্ষা করে আছে কমিউনিটি হল, বাহারি গাছ গাছালির পাশে ঝাঁ চকচকে সবুজ ছোট ছোট মেঠো পরিসর, মাঝে মধ্যে বসার জায়গা। সেখানে একটু জিড়িয়ে নেওয়া যেতেই পারে। একটু এগোলেই একদম টাটকা ফাস্টফুডের স্টল চোখে পড়বেই। সেখানে জমিয়ে পেট পুজো সাঙ্গ করা যেতেই পারে।
সবুরে মেওয়া ফলে। দাঁড়ান দাঁড়ান। পার্কের বিনোদন বাগিচায় আরও অনেক ফোটা ফুল রয়ে গেছে। থ্রিলিংসের রাজা ওয়াটার পার্কের উপকরণ জ্যোৎস্না চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো আনন্দ দেয় জনতা জনার্দনকে। এছাড়াও প্রতিদিন সকাল দশটা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা পর্যন্ত আপনি উপভোগ করতেই পারেন বুল রাইড, হর্স রাইড, বোটিং, ব্রেক ডান্স রাইড সহ অজস্র মন মাতানো মন-পছন্দ পরিষেবা।
বছর দশ আগে এডিডিএ থেকে এই পার্কটি লিজে নিয়েছিলেন আনন্দ অ্যামিউজমেন্ট অ্যান্ড ওয়াটার পার্কের কর্ণধার পবন কুমার শাহ। এই আনন্দ অ্যামিউজমেন্ট অ্যান্ড ওয়াটার পার্ক যেন শিল্পনগরীর উল্টো স্রোতের কিং ফিস। বছর দশেক আগে যখন দুর্গাপুর একের পর এক বিনিয়োগের সাক্ষী তখন শুধুই গাছে ভরা এই পার্ক অনেকটাই ছিল দুয়োরানীর মতো উপেক্ষিত। আবার বর্তমানে যখন রূঢ় শহরের হৃদপিন্ড মিশ্র ইস্পাত কারখানা ধুঁকছে তখন রূপে গুনে পল্লবীত ও প্রসারিত এই অনন্য সুন্দর পার্ক।
এই ক্রমবর্ধমান বৈপরীত উন্নতি সাধনের একটাই মন্ত্র। যা পার্ক সৌন্দর্যের নিরিখে নিজের হৃদয়টাকেই দিয়ে বসেছেন পবনবাবু। কলকাতা নিবাসী এই যুবকের একটাই বক্তব্য, ব্যবসায়ীক দৃষ্টিভঙ্গিতে আমি পার্কটি রক্ষণাবেক্ষণ করি না। এটিকে নিজের সন্তানের মতো ভালবাসি।
দুর্গাপুর কিন্তু আদি শহর নয়। ছয় দশক আগে এখানে ছিল শুধুই গহন জঙ্গল। সেই জঙ্গল সমাজের স্মৃতি আজও বহন করে চলেছে এই পার্কে অবস্থিত একটি বটবৃক্ষ। হ্যাঁ ঠিকই পড়ছেন। স্থানীয় প্রবীণদের বক্তব্য, গাছটি তিন শতাব্দী পুরোনো অবশ্যই। আনন্দ অ্যামিউজমেন্ট অ্যান্ড ওয়াটার পার্কের কর্ণধার জানান, এই প্রাচীন বট গাছের আকর্ষণেই তিনি মোহিত হয়ে পার্কটি লিজে নিয়ে ফেলেন।
সম্প্রতি এই পার্কে কিছু অভিনব বিষয় প্রণয়নের কথা ভাবা হয়েছে। শুধু বিনোদনে যে একটা সমাজ পূর্ণতা পায় না তা বিলক্ষণ উপলব্ধি করেছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। আগামী প্রজন্মকে সঠিক ভাবে প্রশিক্ষণ দিলে তবেই যে সার্বিক সফলতা সম্ভব। যেই ভাবা সেই কাজ। তাই এই পার্কে শীঘ্রই পর্যায়ক্রমে চালু করা হবে স্টাডি ট্যুর প্রোগ্রাম। মূলত পড়ুয়াদের কথা মাথায় রেখে রাখা হবে গাইড। পার্কে আগত ইচ্ছুক ছাত্রছাত্রীদের এখানে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে হটি কালচার, ফ্লোরি কালচার সহ সবুজায়ন এবং জল সংরক্ষণের মতো বিভিন্ন বিষয়ে। এর জন্য উপযুক্ত পরিকাঠামো উন্নয়নের কর্মযজ্ঞ শুরু হয়ে গেছে। এমনকি পড়ুয়াদের উৎসাহের কথা মাথায় রেখে এখানে তৈরি হবে হ্যাঙ্গিং গার্ডেন। এপ্রসঙ্গে পবনবাবুর বলেন, "এই দুর্গাপুর আমাকে ভালবাসার পার্ক উপহার দিয়েছে। আমারও তো ক্ষুদে নান্নেমুন্নের কিছু উপহার দিতে ইচ্ছে করে। পার্কে পরিকল্পিত স্টাডি ট্যুর প্রকল্প হবে সবুজ কচিকাঁচার জন্য আমার তরফে পুরস্কার।"
একি পবনবাবু যে সেই পরিচিত গানটি গাইতে শুরু করেছেন--"লাল নীল সবুজের মেলা বসেছে আয় আয় আয়রে, ছুটে খেলবি যদি আয়..."

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours