দেবর্ষি মজুমদার, লেখক, বীরভূম:

হারিয়ে যাওয়া পুতুল নাচকে ফিরিয়ে এনেছে লাভপুরের বীরভূম সংস্কৃতি বাহিনী। তাদের যাতায়াত কখনও মঙ্গলকাব্য, আবার কখনও আরব্যরজনী।  রবিবার ছিল বীরভূমের মুরারই উতসব। সেখানে মুরারই উচ্চবিদ্যালয়ে ক্ষীরোদ প্রসাদ বিদ্যাবিনোদের লেখা নির্ভর “আলিবাবা” মানবপুতুল নাচ মঞ্চস্থ হয়।  রবিবার সন্ধ্যা আটটায় “আলি বাবা” মানব পুতুল নাচের এক ঘন্টার অনুষ্ঠানে মেতে ওঠে এলাকার মানুষ।  রাঢ বঙ্গে পুরানো দিনে যারা দেখেছেন তাঁবুতে  সুতো টেনে মাটির পুতুলের নাচ। আর সাথে হরবোলার একাধারে পুরুষ ও বামাকণ্ঠের অভিনয়, যা ছিল তাক লাগানোর মত। যাদের বলা হত “মাস্টার”। তাঁরা সেই পুরানো স্বাদ পাবেন নতুন আঙ্গিকে।  যার স্বাদ অনবদ্য। হয়ত নেই সেই মাস্টার, বা সুতোর টান। তবে আছে সেই কারসাজি। যা অভূতপূর্বভাবে ফুটে ওঠে “মানব পুতুল” নাচের মাধ্যমে।
মানব পুতুল নাচ আরও কঠিন। সাবেক পুতুল নাচের ঐতিহ্যের আদলে যে মানুষগুলো পুতুলের মত অভিনয় করেন তাঁদের শিল্প স্বস্ত্বা তাঁদের পুতুলে পরিণত করে। তাঁদের চোখের পাতা পড়ে না। ঠোঁট খোলে না। শারীরিক সৌষ্ঠব অঙ্গভঙ্গী এক্কেবারে পুতুলের মত। আর অভিব্যক্তি ভাবলেশ হীন।  আলিবাবার “মোস্তফা” চরিত্রের কথা যদি ধরা হয়, তাহলে দেখা যাবে তিনি পা মোড়া অবস্থায় মঞ্চে এক মাথা মাথা থেকে নড়ছেন, কিন্তু চলাফেরা করছেন না। মনে হবে অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা অবস্থায় তিনি মঞ্চে নড়ছেন। পুতুল নাচের মঞ্চের আদলে তৈরী বক্সের আকারে ফ্রেম থেকে দেখতে হবে দর্শকদের।  কারো পা দেখা যায় না। নিচের অংশ থাকে বক্সের আকারের পোশাকে ঢাকা। পুতুলের গায়ে যেমন ঘাগড়া পড়ানো থাকে, তেমনি সব চরিত্রকে পোশাক পড়ানো থাকে। মোস্তাফার কথা ধরলে বলা যেতে পারে, তার নিচের অংশ বক্সের মত কাপড়ে ঢাকা ছিল, আর সামনে  থাকে মুড়ে থাকা নকল পা। যা দেখে মনে হয় মোস্তাফা পা মুড়ে আছেন। মঞ্চের পিছনে হারমোনিয়াম, ঢোল, পারকাসন যন্ত্রানুসঙ্গ। এবং তাদের সাথে সেই কুশীলবেরা যাঁরা নারী পুরুষ চরিত্রকে কণ্ঠ দান করেন।  “কমিক রিলিফ” হিসেবে আগের মতই হালফিলের সিনেমার নাচ গানের ব্যবস্থা ছিল পুতুল নাচের মধ্যে দিয়ে। ছিল রাক্ষস মুখের গুহা, যা চিচিং ফাঁক বললেই খুলে যাচ্ছে।  ছিল পুতুল ঘোড়ার ব্যবস্থা। মর্জিনার গান—ছি ছি এত্যাজঞ্জাল। পুরো মঞ্চ অন্ধকার। মঞ্চের নিজস্ব আলোয় কারো মনে হবে না, চরিত্রগুলো মানব পুতুল। মনে হবে সত্যি পুতুল। মনে করিয়ে দেয় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুতুল নাচের ইতিকথার কথা। যেখানে “সবাই যেন কার হাতের পুতুল… কেউ যেন নিদারূণ কৌশলে নাচাচ্ছে সবাই”।     

বীরভূম সংস্কৃতি বাহিনীর কর্ণাধার উজ্জ্বল মুখোপাধ্যায় বলেন, ২০০৭ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর প্রথম আলিবাবা পুতুল নাচ মঞ্চস্থ হয়। সর্বমোট ১২ জন শিল্পী আলিবাবায় অংশ গ্রহণ করেন। ১২ বছর ধরে বেহুলা লক্ষ্মীন্দর মানব পুতুল নাচ মঞ্চস্থ  হয়ে আসছে। তবে শুধু মানব পুতুল নাচ নয়, নাটক করে থাকি আমরা। পুরানো দিনের হরিশচন্দ্র শৈব্যা,  সাবিত্রী সত্যবান যেসব রজনীর পর হতো, সেগুলো তো এখনকার প্রজন্ম দেখতে পায় না।  সেই পুরানো দিনকে ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours