শেখ ফরিদ, প্রগতিশীল লেখক, বাংলাদেশ:

স্যার সৈয়দ আহমেদকে বৃটিশ দালাল বলা হতো। কারন তিনি বৃটিশ ভারতকে দারুল হারব মনে করতেন না। এবং বৃটিশ ভারতের মুসলিমদের জেহাদি হতে অনুৎসাহীত করতেন। যদিও তিনি প্রথম জীবনে কট্টর মুসলিম ছিলেন। অনেকেই মনে করে তার প্রতিষ্ঠিত আলী গড় মুসলিম ইউভার্সিটিতেই ভারত বিভাগের বীজ অংকুরিত হয়েছিলো। যে বীজের বৃক্ষটির নাম পাকিস্তান।
তবে বিচিত্র বিষয় হলো, তার প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে তৎকালীন ভারতবর্ষের আলেম ওলামারা অনৈসলামিক কার্যকলাপ মনে করতো। তার বিরুদ্ধে শত নয় হাজারের অধিক  কাফের ফতোয়া পাশ করা হয়। এমন কি মক্কার ঈমামের নিকট থেকে স্যার সৈয়দ আহমদের নামে ওয়াজিবুল কতল ফতোয়াও আনা হয়। অথচ এই সৈয়দ  আহমদ ভারতবর্ষের পিছিয়ে পরা মুসলিমদের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে চেয়েছিলেন। যাতে তারা, হিন্দুদের মত চাকরী ও ব্যবসায় এগিয়ে যেতে পারে। স্যার সৈয়দ আহমেদও কিন্তু অসাম্প্রদায়িক ছিলেন না। তিনি কেবল সাম্প্রদায়িকই ছিলেন না। প্রথম দিকে কট্টর মুসলিমও ছিলেন। তিনি মনে করতেন পৃথিবীর ঘুরে না, সুর্যই পৃথিবীর চার দিকে ঘুরে। এমনকি তিনি মনে করতেন, আম খাওয়া যাবে না। কারন প্রোফেট মোহাম্মদ কখনো  আম খাননি৷ এ বিষয়ে তিনি ত্রিশ পৃষ্ঠার ফতোয়াও লিখেন। শেষে লিখেন যারা নবীকে ভালোবেসে আম খাওয়া থেকে বিরত থাকবে কিয়ামতের দিন সেই সকল মুসলিমদের পায়ে চুমু খাবে ফেরেস্তারা!
এই ছিলো সৈয়দ আহমদের চিন্তাধারা। অবশ্য পরে তার মানসিকতারও কিছু পরিবর্তন হয়। নিজে সাম্প্রদায়িক হলেও  মুসলিমদের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার লক্ষ্যে বৃটিশ সরকারের উচ্চপদের চাকুরি ছেড়ে দেন।

ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী চায়নি ভারতবর্ষের মানুষ শিক্ষিত হোক। বৃটিশ ভারতে, বৃটিশ রাজও ভারতে  শিক্ষা বিস্তার  চায়নি। বিশেষ করে ইংরেজি শিক্ষার বিস্তার । কেন না, ইংরেজি শিক্ষা বিস্তারের কারনেই আমেরিকা, বৃটিশদের হাত ছাড়া হয়ে যায়। প্রকৃতই শিক্ষা আলো ও শক্তি।  যার সন্ধান তারা দিতে চায় নি। চা কফির দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় আমেরিকায় এক সময় বৃটিশ বিরোধী মনোভাব বেড়ে যায়। কেন না, বৃটিশ রাজ , তার কোম্পানিকে  একচেটিয়া ( মনোপলি) চা /কফির ব্যবসা করার সুযোগ দেয়। কোম্পানি সে সুযোগে দাম বাড়িয়ে দেয়। আর তাতে বৃটিশ বিরোধিতা বেড়ে যায়। যা এক পর্যায়ে গৃহযুদ্ধে রুপ নেয়। স্বাধীনতা আন্দোলনও শুরু হয়। যার কারনে বৃটিশদেরও এক সময় আমেরিকা ছাড়তে হয়।

তারপরও কিছু মহৎ হৃদয় শিক্ষানুরাগী বৃটিশ  ভারতবর্ষে আধুনিক শিক্ষা বিস্তার কামনা করেন। তারা ভারতে শিক্ষা বিস্তার করতে এলে বিপত্তি ঘটে। বৃটিশ ভারতের হিন্দুরা আধুনিক শিক্ষায় আগ্রহ দেখালেও ভারতবর্ষের মুসলিম আলেম উলামরা কোলকাতায় বসে জোট বাধেন। প্রায় সাড়ে আট হাজার আলেম উলামা ফতোয়া দেন আধুনিক শিক্ষা বেদাত! মুসলমানদের অন্য কোন শিক্ষাব্যাবস্থার দরকার নেই। কেন না, তাদের হাতে সর্বশেষ কিতাব রয়েছে। এই শিক্ষাই শেষ শিক্ষা।  অর্থাৎ কোরআন  হাদীসের বাইরেরে কোন শিক্ষা নিতে অনাগ্রহী। তারা,বৃটিশদের কাছে ফান্ড চায় মাদরাসা শিক্ষার প্রসারের জন্য। স্যার সৈয়দ আহমদ মুসলমানদের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে চাইলে তাক হাজার বার কাফের ফতোয়া দেয়া হয় তা আগেই বলেছি।

 আরেক কবি আল্লামা স্যার ইকবাল ছিলেন সৈয়দ আহমদের বিপরীত। তাকেও কবিতা লেখার দায়ে কাফের ফতোয়া  দেয়া হয়েছিলো। সৈয়দ আহমদ প্রথমে আরবী ফার্সী উর্দু শিখেন। পরে নিজের চেষ্টায় ইংরেজি আয়ত্ত করেন। কট্টর মুসলিম হয়েও মুসলিমদের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে চাইতেন। আর আল্লামা ইকবাল মশহুর কবি ও  বিলাতি উচ্চশিক্ষিত হয়েও তিনি ছিলেন চরম সাম্প্রদায়িক,ধর্মান্ধ  ও আধুনিক শিক্ষা বিরোধী। যার ছায়া আজ আমরা আজেকের পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের মধ্যে দেখছি। উচ্চ শিক্ষিত ইমরান খানের বর্তমান স্ত্রী পীর! তিনি জ্বিন পোষেন! জাদু টোনা করেন। সেই বিবির পরামর্শে তিনি মক্কায় বিমান থেকে নামেন খালি পায়ে! জুতা পায়ে দিয়ে নামলে নাকি আদবের খিলাফ হবে! অনেকটা 'মোর খৃষ্টান দ্যান পোপ' এর মত। কেননা, আরবরা আগেও মক্কায় জুতা পরতো। এখনো পরে,ভবিষ্যতেও পরবে। তিনি যখন বিমান থেকে নেমে  হাস্যকর ভাবে খালি পায়ে হাটছিলেন তখনো আরবরা জুতা পায়েই তার পাশে ছিলো। এমন কি একবার  টিভিতে দেখা গেছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল ট্রাম্পের সাথে যখন কথা বলছিলেন,অক্সফোর্ড থেকে পাস করা সাবেক ক্রিকেটার ও প্লেবয়  পাকিস্তানি  প্রধানমন্ত্রীকে তখন হাতের কর গুনে  তসবি তেলওয়াত করতে দেখা গেছে!

কবি ইকবালের পুত্রের লেখা বই পড়ে যে কেউ জেনে নিতে পারেন, আল্লামা ইকবাল কেমন  প্রগতিবিরোধী ছিলেন। তিনি চাইতেন না কেউ দর্শনশাস্ত্র পড়ুক। তিনি মানুষের চিন্তা ও চিন্তার স্বাধীনতায় বিশ্বাস করতেনই না। বরং তিনি স্বাধীনভাবে প্রশ্ন করার বিরোধী ছিলেন
। যদিও আল্লামা ইকবাল নিজে দর্শনের উপরই ডিগ্রি নিয়েছিলেন। তিনি কেবল দর্শন শাস্ত্রের বিরোধিতা করেননি। তিনি গণিত, বিজ্ঞান বিরোধীও ছিলেন। একাধারে সীনা এবং রুশদকে গালি দিতেন দর্শনের ছাত্র হয়েও। আবার বিজ্ঞানের 'ব' না জেনে আইষ্টাইনকে গাল-মন্দ করতেন। উল্লেখ্য তিনি গ্রাজুয়েশন করেছিলেন কলা বিভাগে। আর কলা বিভাগে তো বিজ্ঞান পড়ার সুযোগই নেই।  ফার্সী ভাষায় নারীর পক্ষে একটি কবিতা লিখে  থাকলেও অন্যান্য সময় তিনি নারী শিক্ষার বিরোধিতা করেছেন৷ তিনি পশ্চ্যাতে শিক্ষা গ্রহন করলেও নারীদের পশ্চ্যাত্য শিক্ষা নিতে নিষেধ করেছেন। তার ভাষায় পাশ্চাত্য শিক্ষা ভুল শিক্ষা। তিনি আবার কিছু বই ইংরেজিতেও লিখেছেন। আবার কোথাও বলেছেন বিজ্ঞান যা এখন আবিস্কার করেছে তা মুসলমানেরা হাজার বছর আগেই জানে!
আমরা যেমন ভারতের বিজেপি নেতা মন্ত্রীদের বিজ্ঞানের বিষয়ে বলা  কথা নিয়ে উপহাস করি। তেমনি বিজ্ঞান ও দর্শন নিয়ে আল্লামা ইকবাল  এমন কিছু বলেছেন তা হাস্যকর ও উপহাসের যোগ্য।

তিনি ভারতীয় সভ্যতা তো দুর নিজের মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধা রাখতেন না। তার দাদা হিন্দু, নানী শিখ ছিলেন। এ নিয়ে কখনো কথা বলতেন না। একজন কবি হয়েও তিনি  ছিলেন অনুদার। তার একটা উদাহারন দেই।  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল প্রাইজ পেলে তাকে আমন্ত্রণ করেন ইরানের শাহ।  তাতে আল্লামা স্যার ইকবাল ক্ষুব্ধ হন। কেন না, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একদিকে হিন্দু তার উপর বাংলায় কথা বলেন।
এটাই ভারতবর্ষের দুর্ভাগ্য যে, ঢাকা, লাহোর দিল্লীর সকল বুদ্ধিজীবী ও নেতারা কি হিন্দু কি মুসলিম তারা যতই শিক্ষিত হন বা প্রগতিশীল শেষ পর্যন্ত , মুক্তচিন্তা, বিজ্ঞান ও প্রগতীবিরোধী হয়ে উঠেন। তার জলন্ত উদাহারন বৃটিশ ভারতের  প্রখ্যাত উর্দু কবি ফয়েজ আহমেদের মত কমিউনিষ্টও শেষে ভাববাদী হয়ে ওঠেন। কবিতায় তার পরিবার থেকে পাওয়া ধর্মের ও স্রষ্টার গুন গান গেয়ে। আবার হাল আমলের হিন্দু পরিবারে জন্ম নেয়া কমরেড কানাইয়া মুসলিমদের কাছে   ভোট চান, নবীর চলার পথে এক বুড়ির কাটা ছড়ানোর গল্প বলে। যে গল্প খোদ মুসলিম স্কলারেরাই বাতিল করে দিয়েছে। আবার চকলেট হিরো কানাইয়ার উত্তরসূরী বামপন্থী নেত্রী ঐশি ঘোষ বাজুতে তাবিজ বাধেন সে কথা নাই বা বললাম। এ রকম বহু কারনেই এ উপমহাদেশ তথা ভারত বাংলাদেশ ও পাকিস্তান কুসংস্কার ও সাম্প্রদায়িকতার উপরে  উঠতে পারছে না। মুক্তচিন্তা, বিজ্ঞান ও আবিষ্কারের পথ সরু হয়ে আসছে৷ মোঘল আমলে  এ উপমহাদেশ  অর্থনৈতিক ভাবে  শক্তিশালি ছিলো । যদিও হাতে গোনা কজনের কুক্ষিগত ছিলো ভারতবর্ষের অর্থসম্পদ।   অথচ শিক্ষা ও বিজ্ঞানে অবদান নেই। মুসলিম শাসকেরাও উপাসনালয়, মিনার, দূর্গ, বাগান, প্রাসাদ, হেরেম আর কবর তৈরীতে পারদর্শী দেখিয়েছেন। শিক্ষা ও বিজ্ঞানে তাদের অবদান চোখে পরে না। এ উপমহাদেশের মানুষদের সামাজিক অর্থনৈতিক রাজনৈতিক,শিক্ষাব্যাবস্থা ও  চিন্তা চেতনার আসু পরিবর্তন না ঘটলে। প্রায় ১৫০ কোটি মানুষের জীবন যৌবন হুমকির মুখে থাকবে। যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে তরবারী ঘোড়া উট, হাতি তো এখন  বাতিল হয়েই গেছে। এমন কি আগামী দিনের যুদ্ধ ও বাজার দখল; বন্দুক কামান বিমান বোমা দিয়েও নাও হতে পারে। তার প্রমান চীন থেকে খুজে পাওয়া  কোনাভাইরাস! এ ছাড়া  আমেরিকা, চায়না, রাশিয়া ও জাপান কৃত্রিম বুদ্ধিমত্ত্বা নিয়ে ব্যাপক গবেষনা করে চলছে। যা এ উপমহাদেশ তো দুরের কথা অনেক দেশের কাছেই অজানা। এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্ত্বার বহুমাত্রিক ব্যবহার করে সারা পৃথিবী নিয়ন্ত্রণে নেবে কোন কোন রাষ্ট্র।  একটা উদাহারন দেই; ভারত দখলদার বাবর, আরেক দখলদার ইব্রাহিম লোদীর সাথে যুদ্ধে জিতেন এই জন্য নয় যে, লোদী থেকে বাবর অনেক বড় বীর ছিলো। লোদী অনেক বড় বীর ছিলো এবং  তার দক্ষ ও যোগ্য সেনাবাহিনী ছিলো। বাবর সম্মুখ যুদ্ধে কখনোই লোদীকে হারাতে পারতো না। যদি যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে বাবরের হাতে কামান না থাকতো। যা ইব্রাহীম লোদীর নিকট ছিলো নতুন একটি অপরিচিত যুদ্ধাস্ত্র। বাবরের হাতে  কামান  না থাকলে ভারতের দখলদারের ভারত শাসন করার ইতিহাস অন্য রকম হতে পারতো। তাই পরাধীন না হতে চাইলে আধুনিক শিক্ষা, বিজ্ঞান, চিকিৎসা বিজ্ঞানে জানা বুঝা ও পৃষ্ঠপোষকতা জরুরী।
এ উপমহাদেশের মানুষদের ভাবতে হবে নতুন করে নতুন কিছু।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours