কাজল ভট্টাচার্য, কার্টুনিস্ট ও সিনিয়র জার্নালিষ্ট, কলকাতা:

স্মৃতি সততই সুখের।
একেবারে বাজে কথা।
বছরের শেষদিন। প্রতি বছরের মতো এবারেও মেসেঞ্জার, হোয়াপে মেসেজের বান ডেকেছিলো। সব্বাই ব্যস্ত। নেচেগেয়ে, মহাউল্লাসে 2019 কে বিদায় জানাতে। সেকি বিদায়ঘটা !
কিন্তু রাতারাতি এত ফেসবুক ফ্রেন্ড এলো কোত্থেকে? অধিকাংশই অচেনা, অজানা। কস্মিনকালে এদের সঙ্গে কোনও কথা হয়নি। সব আটকে ছিলো জুকারবার্গের জালে। ফেসবুকের পাতায়।
এদিন হঠাত করেই যেন খাঁচার দরজাটা হাট খুলে দিয়েছিলো বর্ষবিদায়। হুড়মুড়িয়ে সব বন্দিপাখির দল বেরিয়ে এসেছিলো খাঁচা থেকে। আজাদি। হমকো চাহিয়ে আজাদি।

আচমকাই মেসেঞ্জারে এক মেসেজ ঢুকলো- আমাকে আটশোটা টাকা দিতে পারো, প্লিজ?
না। আগে কোনদিন এই মহিলা ফেসবুক ফ্রেন্ডের সঙ্গে কথাবার্তা হয়নি। প্রথমেই 'তুমি' বলাতে সন্দেহ। একি তাহলে শুরুতেই ইঙ্গিত দিয়ে রাখলো ঘনিষ্ঠ হওয়ার? আপনির মধ্যে না গিয়ে সরাসরি তুমি।
এই টাকাটা জোগাড় না হলে তার বাচ্চা মেয়ের পড়াশোনা আটকে যাবে। এদিকে আমিও তখন শহরের বাইরে। জানালাম। মহিলা হয়ত ঠিক বিশ্বাস করতে পারলেন না।
ফের অনুরোধ। "টাকাটা ব্যাবস্থা করে দাও নাগো।" "নাগো"! ফের সন্দেহের পারদ চড়লো। সে একেবারে নাছোড়বান্দা। কিন্তু সে মুহূর্তে আমিও যে অবস্থায়, তাতে টাকাটা দেওয়া সত্যিই সম্ভব ছিলো না।
কিন্তু কলকাতায় থাকলেও কি টাকাটা দিতাম? সন্দেহ আছে। কারণ অবিশ্বাস। প্রেম করতে, ভালবাসতে, যৌনকর্ম করতে, সবই ইচ্ছা করে। কিন্তু বিশ্বাস আর কাউকেই করতে ইচ্ছা করে না। এমনকি ওই প্রেমিকা, ভালবাসার জন, আদুল গায়ে বিছানায় গড়াগড়ি খাওয়া ওই যৌনসঙ্গীকেও না।
ওই মহিলাও বিশ্বাস করতে পারছিলেন না আমায়। তাই অতো বারেবারে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে টাকার আবদার। গোটা অতীত জুড়ে এই অবিশ্বাসের ইতিহাস। মিরজাফরদের আনাগোনা ইতিহাসের পাতায় পাতায়।

সে ছিলো আর এক মেয়ে।
মেয়েটা অনেকদিন ধরেই ওর আঁকা ছবি দেখাত। তারিফও করতাম, যদিও নেহাতই কাঁচা হাতের কাজ। নিজের উৎসাহেই শিখেছে। কাল ও আরও বেশ কয়েকটা ছবি দেখালো।
- "বাহ বেশ হয়েছে," বললাম আমি।
- "ওগুলো পাঁচ-ছ'বছর আগে এঁকেছিলাম।"
ছবির প্রশংসা শুনেই ও হঠাত করে বললো
- "খুব ছবি আঁকা শিখতে ইচ্ছা করে গো।"
- "বেশ তো শেখ।"
"যে মেয়েটা মাস্টার্স-এর পড়াশোনা চালায় গুগল ঘেঁটে। অতি প্রয়োজনীয় বইটাও কিনতে পারে না। কোনও স্টাডি মেটেরিয়াল পায় না। সে কিভাবে রং তুলি খাতা কিনবে বলো তো?" পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো মেয়েটা।

চুপ মেরে গেলাম। দুঃখবিলাসী আমি। সাদাকালোর জীবন। আমার ছবি থেকেও রং চলে গেছে। পড়ে পড়ে নষ্ট হচ্ছে কাড়ি কাড়ি জলরং, প্যাস্টেল, অ্যাক্রেলিক, অয়েল পেন্টিং। "তুই এগুলি নিয়ে নে," বলার স্পর্ধা দেখাতে পারলাম না আমি, বেশকিছু দিনের চেনা সেই মেয়ের কাছে।

সেই মহিলা কেন বেছেবেছে আমার কাছেই টাকা চেয়েছিলেন, জানি না। টাকা দিতে রাজি হলে, তিনি আমার ফ্ল্যাটে এসেই তা নিয়ে যেতেন। কোন সাহসে? 'তুমি', 'নাগো', শব্দগুলি কিসের ইঙ্গিত?
এক অচেনা, অজানা পুরুষের কাছে কি আদৌ এভাবে টাকা চাওয়া যায়? উত্তরটা সেই মহিলাও বিলক্ষণ জানেন। হতে পারে, অবস্থার মারে তিনি কোনও লক্ষণ রেখাই মানতে চাননি।

টাকা না পেয়ে ওই অজানা মহিলা বছরের শেষদিনটায়, ঠিক কতটা অসহায় বোধ করেছিলেন জানি না। অন্য কেউ টাকাটা দিতে এগিয়ে এসছিলো কিনা তাও জানি না। অথবা আমারই মতো অন্য কোনও পুরুষ টাকাটা দিলেও, কিসের বিনিময়ে দিলেন জানি না।

অবিশ্বাসের কাছে মাথা বিকিয়ে দিয়েছিলাম আমি। হতে পারে, আটশো টাকা মার যাওয়ার হাত থেকেও বেঁচে গেলাম। কিন্তু মনটা কোথাও যেন অপরাধী হয়ে থাকলো। ওই মহিলা সামনে এসে দাঁড়ালে, চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারবো তো? সন্দেহ আছে।
আটশোটা টাকা দিয়ে ঠকলে কিন্তু উল্টোটাই হতো। নির্ভয়ে দাঁড়াতে পারাতাম আয়নার সামনে। চোখ মিলিয়ে কথা বলতে অস্বস্তি হতো না কারও সঙ্গে।
সেই মেয়েটাকে যদি বলতে পারলাম, তোকে রংগুলি গিফট করবো, বেশ লাগাতো। কিন্তু ওতো কিছুই চায়নি। তাই উপযাচক হয়ে সেধে সেধে ওসব দিতে গেলে, ব্যাপারটা কি ঠিক হতো? ও অন্যকিছু ভেবে বসতো নাতো?
সন্দেহ সন্দেহ আর সন্দেহ।

দেশের একজন শরণার্থীরও কোনও ভয় নেই। অনবরত বুঝিয়ে চলেছেন প্রধানমন্ত্রী, গৃহমন্ত্রী। তবু অনেকের চোখে সন্দেহের গাঢ় ছায়া। তাকে উসকে দিতে তৎপর বিরোধী শিবির। রাজনীতি চলছে। কে ঠিক কে বেঠিক? সন্দেহে দ্বিধাবিভক্ত একশো তিরিশ কোটি। তাদের মধ্যেই আমরাও তিনজন। সেই মহিলা, মাস্টার্সের ছবি আঁকা মেয়ে আর আমি। সন্দেহের মড়কে মরছে মানবিকতা।

আর আধ্যাত্মিকতার দশাটাই বা কী?
যেখানে যুক্তিবুদ্ধি বিজ্ঞানের সীমারেখা শেষ, সেখানেই অবতারের ওপর ভরসা শুরু। দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো ! অবতার ভক্তরূপী সাক্ষাত ভগবান। সেখানেও বিশ্বাস, অবিশ্বাসের চরম দ্বন্দ।

আচমকাই মনে পড়ে, বছরের প্রথম দিনটায় ঠাকুরতো 'কল্পতরু'। ওই অসহায় মহিলা, তরুণী তো ঠাকুরের শরণে গেলেও পারতেন। গেলেন না কেন?
এখানেও কি ভরসার ভাঁড়ারে টান?
সেই অবিশ্বাস !

আবার শুনেছি, ঠাকুরও নাকি ভক্তের ভাক শুনতে পান? তাহলে ওই দুই অসহায়ার ডাক শুনতে পেলেন না কেন?
আবার চিড় ভক্তির বিশ্বাসে।

ফোন বেজে যায়।
ভেবেছিলাম নিউ ইয়ারে একটা উইশ করবো।কিন্তু ওপারে কেউ কল রিসিভ করে না। কোনও সাড়াশব্দ নেই। কী ব্যাপার ভালো আছে তো ফোনের ওপারের মানুষটা?
সুস্থ আছে তো?
বেঁচেবর্তে আছে তো?
ভয় হয়। ভীষন ভয়। আতঙ্ক ক্রমেই চেপে বসে। রিং হয়ে যায়। বেজে চলে ফোন।
ওপারের মানুষটার সুস্থতায় সন্দেহ হয়। বিশ্বাস গলে গলে পড়ে। অবিশ্বাস ভর করে চোখের পাতায়। মনে চেপে বসে অবিশ্বাস।

বিদায়ীবর্ষের স্মৃতি এটাই।
এক আকাশ অবিশ্বাস। হিমালয়প্রমাণ সন্দেহের ছায়া। পুরু লেনসে ঢাকা চশমার আবছা দৃষ্টি। ফিকে হয়ে বাজতে থাকা মোবাইলের রিং। আতঙ্কের হামাগুড়ি।
মানুষ আসলে মানুষের ওপরেই বিশ্বাস করতে ভালবাসে। আজও।

এরপরেও কি বলবেন- স্মৃতি সততই সুখের?
ওই স্মৃতি ঘাড়ে করেই নববর্ষের সফর শুরু।
অবিশ্বাসের আরও এক বছর।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours