আনন্দিতা রায়, লেখিকা ও সঙ্গীত শিল্পী, দুর্গাপুর:

এই যে ছড়া কেটে কেটে কবিতার ছন্দে বলা শ্রুতিমধুর অথচ অর্থপূর্ণ ইঙ্গিতবাহী বাক্যবিন্যাস একে আমরা ছড়া বলব কিনা এটা একটা প্রশ্ন। এইগুলো অনেকটা প্রবাদ বা প্রবচন ধর্মী। তবে ছড়া বলতে সাধারণত আমরা কি বুঝি? ছড়া কাদের জন্য লেখা হয়? এখানে একটা বিতর্ক অবশ্যই উঠতে পারে। আমরা প্রাথমিকভাবে বলতে পারি ছড়া সব সময় শিশুদের জন্য শিশুদের মতো করেই লেখার চল ছিল। বর্তমানে অবশ্য বড়দের জন্য বড় ছড়া লেখা হয়েছে বা হচ্ছে সে কথা পরে বলা যাবে।

শিশুদের জন্য রচিত ছড়া তাদের স্বভাব অনুসারে না হলে শিশুরা তা নেবে না। ওদের স্বভাব এর মধ্যেই রয়েছে ছটফটে ভাব। অত্যধিক দ্রুত তার মানসিক পট বদল হয়, একটা জায়গায় বসতে বললে হঠাৎ একটা প্রজাপতি দেখে ঝাঁপিয়ে পড়া, সবাইকে টেনে সেটা দেখাতেই হবে--যেন একটা অপার বিস্ময়। আবার নতুন একটা কিছু দেখে তার আগ্রহ হওয়া সেখানে দৌড়ে যাওয়া, বড়দের কোন আগ্রহই তাদের টানে না কিন্তু পিঁপড়ে দেখে অবাক বিস্ময় সেটাই দেখবে, পাখি তাকে টানে আকাশ ও। প্রতিমুহূর্তে তার মনের পট বদল হচ্ছে, পরিস্থিতি পাল্টাচ্ছে এবং সে তার মানসিক ভাবাবেগের সঙ্গে সঙ্গে মতির পরিবর্তন করছে, তার রূপ বদল হচ্ছে, তার এক্সপ্রেশন ভিন্ন ভিন্ন হচ্ছে। এই যে মুহূর্তে মুহূর্তে তার মনের মধ্যে পট পরিবর্তন তার যে ছটফটানি ভাব ছড়ার মধ্যে তার ই যদি reflection না থাকে তবে শিশু সে ছড়া কে গ্রহণ করবে না। সে কাব্য বোঝেনা সাহিত্য ও বোঝেনা; তার গল্প চাই----রূপকথার গল্প। রূপকথার মধ্যে কখনো কারুণ্য থাকবে, কখনো ভয় থাকবে, কখনো বিস্ময় থাকবে তাতে যুক্তিসংগত কিছু থাক বা না থাক ,সব মজাদার ঘটনা ঘটছে, কখনো হাসছে কখনো অবাক বিস্ময়ে চোখ বড় করে বক্তার দিকে তাকিয়ে আছে; অর্থাৎ পরিবর্তনশীলতা, ছড়ার মধ্যেও যেটা থাকতে হবে।

দ্বিতীয়তঃ  থাকতে হবে একটা সংগীত, একটা ছন্দ অথচ এই দুইয়ের মধ্যে থাকবে অবাক করা গল্প--একটা চিত্রকল্প। তার রং পাল্টাবে, ধরন পাল্টাবে প্রতিমুহূর্তে অর্থহীন প্রলাপের মত কিছু কিছু নতুন জিনিস থাকবে যার কেউ মানে খুঁজবে না অথচ তার সঙ্গে শিশু একাত্ম হয়ে যাবে অতি সহজে:-যা বড়রা পারে না। দর্শনে বলে যে জন্মের সময় মন থাকে কোরা কাগজ এর মত। সেখানে আসে পছন্দসই অভিজ্ঞতার ছাপ। তাই শিশুমনের পরিবর্তনগুলো ছোট্ট হয়, যাতে পট পরিবর্তন করে তার আবার একটা আগ্রহ টেনে আনা যায়। ছড়ার মধ্য দিয়ে শিশুর কল্পনা প্রবণতা কে বাড়িয়ে দেয়, যা তার ভবিষ্যৎ জীবনের ভিত্তিভূমি। নতুন দৃষ্টি এবং সৃষ্টি ছড়ার মধ্য দিয়ে তার মনের ভেতর পৌঁছে যায়। সে নতুন করে সৃষ্টি করতে শেখে--সাহসী হয়। সৃজনশীলতা প্রকাশ পায়। কাজেই ছড়ার যে দায়িত্ব সেটা কিন্তু বিরাট। শিশুমনের সুকুমারবৃত্তি কে ফুটিয়ে তুলতে ছড়াকারকেও তাই শিশু হতে হয়। যে কারণে রবীন্দ্রনাথ অতুলনীয়।' বীরপুরুষ'কবিতার মধ্য দিয়ে শিশুর মানসিক চেতনা এত অসাধারণ ভাবে প্রকাশ করেছেন যেটা ভাবা যায় না। একে কি আমরা ছড়া বলবো? ছড়ার পুরো ধর্মটাই এরমধ্যে থাকলেও একে হয়তো ঠিক ছড়া বলা উচিত হবে না। বিশদ বিবরণ না দিয়েও বলা যায়; দস্যু দলকে বিপর্যস্ত করে শিশুমনে কল্পনায heroism এর আবির্ভাবে একটা প্রতিকূলতাকে জয় করে উঠবার মানসিকতার উন্মাদনা সৃষ্টি করা--এটাই হচ্ছে প্রকৃত ছড়া রচনার মূল বিষয়বস্তু। একে কেন্দ্র করেই ছড়া তৈরি হয়। ছোটদের জন্য লেখা তৈরি হয়। আর এগুলো যারা লেখেন তারা সত্যি ই মহান শিল্পী।
সুকুমার রায়ের কবিতাগুলি যদি আমরা দেখি "রাম গরুড়ের ছানা হাসতে তাদের মানা"কবিতাটি পড়ে সবাই হাসছেন, শিশু হাসছে কিন্তু তার কল্পনার একটা বিরাট জগৎ বিস্তার করে যাচ্ছে---ঐরকম একটা কিম্ভুতকিমাকার প্রাণী যারা হাসে না তাদের অস্তিত্ব সম্পর্কের বিস্ময় জাগে, এটাই ছড়ার ধর্ম যা শিশুকে হারিয়ে দেয় -ভাসিয়ে দেয়- জাগিয়ে তোলে।

প্রবাদ প্রবচন গুলো গড়ে ওঠে সাধারণত আমাদের সমাজ জীবন, ব্যক্তিজীবন ও বিভিন্ন জীবন সত্যকে উপজীব্য করে। ছড়া হিসাবে এগুলি অতুলনীয় হলেও অভিজ্ঞতা এবং নৈতিকতার বিচারে ই এর গুরুত্ব। এগুলি একপ্রকার নির্দেশিকাও যা বড়দের জন্য ই সাধারণত ব্যবহৃত হয়। ছড়া কেটে কেটে প্রবচন গুলিকে বলার কারণ দুটো। এক, দুটি লাইনে ছোট করে একটা সত্য কে প্রকাশ করা যা মনে রাখা সহজ। দুই, প্রচলিত শব্দে গ্রামীণ কোথায় বা বাক্যে সাধারণ মানুষের ধ্যান ধারনার সঙ্গে খাপ খাইয়ে সত্য বা তথ্য কে এক জায়গায় করে মন্ত্রের মতো তারমধ্যে ছন্দ মিলিয়ে ঢুকিয়ে দেওয়া। আমরা জানি ছন্দময়তা ছড়ার একটি বৈশিষ্ট্য, এখানে খুঁজলে ছড়ার ধর্ম হয়তো পাওয়া যাবে--তবে তা ছোটদের নয় ,বড়দের জন্য। বড়দের মধ্যেও একটা শিশুমন বেঁচে থাকে যে কারণে সত্তর/আশি বছরের বৃদ্ধ/ বৃদ্ধা যখন  নাতি/নাতনির সাথে গল্প করেন তখন তিনিও সাময়িকভাবে শিশু  হয়ে পড়েন। শিশু মন কখনো হারিয়ে যায় না-- একটা খোলস তৈরি হয় মাত্র। বয়সের অভিজ্ঞতা বাস্তব পরিস্থিতি হয়তো তাকে বৃদ্ধ/বৃদ্ধা তৈরি করে, শারীরিক সামর্থ্যহীনতা হয়তো তাকে পীড়া দেয় কিন্তু ভেতরের শিশুটি সতেজ হয়ে বেঁচে থাকে---তার বয়স বাড়ে না।

ছড়ার মধ্যে মাদকতা আছে। একটা সুর একটা নাচের ছন্দের মতো যা শিশু মনকে টানে তারমধ্যে একটা কল্পনার বিস্তার ঘটাতে সাহায্য করে। যেখানে বোয়াল মাছে নৌকা নিয়ে যায়---তার কল্পনায় নৌকা চড়ার ভয়াবহতা তাকে গ্রাস করে। যদি সে বোয়াল মাছ না দেখে থাকে তবে ভাবে বোয়াল মাছ কত বড় যে অত বড় একটা নৌকা সে অক্লেশে গিলে ফেলতে পারে!! আবার তা দেখে দেখে ভোঁদড় নাচছে---এই ভোঁদড়ের সাথে নৌকা খেয়ে ফেলার কি সম্পর্ক তা সে ভেবে পায় না। যুক্তিতর্ক এখানে অচল। কবি বলছেন "ওরে ভোদড় ফিরে চা, খোকার নাচন দেখে যা"। অর্থাৎ তোরা কি নাচ নাচছিস আমার খোকার নাচন দেখ। অর্থাৎ আবেগ। আবেগময়তা ছড়ার আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। রবীন্দ্রনাথ এর ওপর জোর দিয়েছেন সবচেয়ে বেশি।
যেমন"খোকা এল নায়ে/লাল জুতুয়া পায়ে
জুতা এখানে জুতুয়া হয়েছে। জুতা দোকানে কিনতে পাওয়া যায়-কিন্তু জুতুয়া পাওয়া যাবে কোথায়? এখানে আমরা পাই মায়ের মনের স্নেহ মমতা আবেগ কে। ঠিক তেমনি "আয় আয় চাঁদ মামা টি দিয়ে যা"। 'টি' শব্দটির প্রকৃত অর্থ কি? কোথায় পাওয়া যায়? বাংলা অভিধানে এরকম কোন বিশেষ্য পদ আছে কি? ধারাবাহিক অর্থময়তা ছড়ায় নাও পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু একটা রহস্যময়তা থাকবে। (ক্রমশ)


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours