গৌতম দাস, অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার, রাজ্য আবগারি দফতর ও লেখক, কলকাতা:

কিছুদিন বা কিছুমাস আগের একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল, 'গুমনামী' বলে একটি বাংলা সিনেমা নিয়ে বিতর্ক তখন তুঙ্গে! অবশ্য সিনেমাটা তখনও পর্যন্ত রিলিজই হয়নি, আমরা কেউ তখনও জানিই না পুরো সিনেমায় পরিচালক ঠিক কি কি বলেছেন নেতাজীর অন্তর্ধান নিয়ে! এমন এক সময় একটি টেলিভিশন চ্যানেলে চোখে পড়েছিল, যেখানে নেতাজিকে নিয়ে এই ছবি প্রসঙ্গে ছবির পরিচালককে রীতিমতো আক্রমণের মুখে পড়তে হয়েছিল নেতাজীর পরিবারের এক স্বনামধন্য সদস্যের কাছে, দৃশ্যতই খুব বিধ্বস্ত ও উত্তেজিত লাগছিল নেতাজী পরিবারের সেই সদস্যকে, কোনো যুক্তি বা তর্কের কথা বাদই দিলাম, কিন্তু নেতাজী অন্তর্ধান নিয়ে বাঙালীর আবেগেকে উনি প্রশ্রয় দেয়া তো দুরে থাক, উনি ওনার যুক্তিতে অটল থেকে, নেতাজী যে 1945 এই তাইহোকু বিমান দুর্ঘটনাতেই মারা গেছেন সেকথা প্রমাণ করতেই সারাক্ষণ উদগ্রীব দেখলাম! তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম উনিই ঠিক বলেছেন, বা সবটাই উনি ভালো করে জানেন অর্থাৎ ওনার যুক্তি অনুযায়ী নেতাজীর মৃত্যু নিয়ে কোনো রহস্যই নেই!  তাহলে নিছকই একটা সিনেমা নিয়ে এত বিতর্কে জড়িয়ে পরার আদৌ কি কোনও প্রয়োজন ছিল! যারা এই সিনেমাটি এতো দিনে দেখে ফেলেছেন, তারা জানেন, যেখানে পরিস্কার করে বলা হয়েছে যে ছবিটির অন্যতম প্রধান অনুপ্রেরণাই হলো, নেতাজী গবেষক অনুজ ধর এবং চন্দ্রচূড় ঘোষের লেখা বই "Conundrum: Subhas Bose’s Life after Death", যেখানে নেতাজীর বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যুর বিপক্ষেই যুক্তি খাড়া করা হয়েছে! এবং এই দুজনের গবেষণালব্ধ বইয়ের বক্তব্য অনুযায়ী, '1945 এর 18  অগাস্টে তাইহোকু বিমানবন্দরের কাছে বিমান দুর্ঘটনায় মারা যাননি সুভাষচন্দ্র বোস! সেদিন আদৌ কোনও বিমান ওড়েই নি সেখান থেকে! নেতাজীরই নির্দেশেই অতি সযত্নে বিমান দুর্ঘটনার কাহিনী সাজিয়েছিলেন জাপানি সেনাবাহিনীর শীর্ষ আধিকারিকরা'। সেই বই এর বক্তব্য অনুযায়ী নেতাজী মাঞ্চুরিয়া হয়ে  রাশিয়ায় প্রবেশ করেছিলেন, সেখান থেকে শেষমেশ নেপাল হয়ে ফিরে এসেছিলেন এই ভারতের মাটিতেই। যাইহোক এসব প্রমাণসাপক্ষে বিষয় কিন্তু একটা বিষয়ে আজ আর কারোর মনে কোনো দ্বিধা নেই যে, সমস্ত ভারতবাসীই নেতাজীর মৃত্যু নিয়ে ঘোর সন্দিহান এবং সত্তর বছর ধরে স্পষ্ট একটা উত্তর খুঁজছে কিভাবে, কখন, কোথায় নেতাজীর মৃত্যু হয়েছে!  প্রশ্ন তো উঠবেই কারণ নেতাজীর মৃত্যু নিয়ে রহস্য আছে বলেই তো তিন-তিনটে কমিশন গঠন করা হয়েছিল! রহস্য আছে বলেই তো বারবার নেতাজীর মৃত্যু নিয়ে জনমানসে এখনও এতো কৌতূহল! বারবার নানান কাহিনী ভেসে আসে তার অন্তর্ধান নিয়ে! এই সব ঘটনাই হয়তো ভিত্তিহীন হয়ে যেত যদি সরকারি ভাবে নেতাজীর মৃত্যু সম্পর্কে পরিস্কার তথ্য মানুষের সামনে আসতো! তার মৃত্যুদিন পালান করা হতো!   তা যখন এতো বছরেও হয়নি তাহলে তো গুমণামী সিনেমার পরিচালক কোনো অন্যায় করেননি!  শুধু চেনা জানা চালু প্রশ্ন গুলো আর একবার তার সিনেমার মাধ্যমে দর্শকদের দিকে ছুড়ে দিয়েছেন মাত্র!  আর ভারতীয় সেন্সার বোর্ড এর কর্তারাও তো এই সিনেমা চলার ছাড়পত্র দিয়েছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও এটাই সত্যি যে ভাবে নেতাজী পরিবারের একজন হয়েও সেই ভদ্রলোক পুরো অনুষ্ঠান জুড়ে এই সিনেমা বানানোর জন্য পরিচালকে ধিক্কার ও তিরস্কার জানালেন, পরিচালকে অত্যন্ত ঔদ্ধত্য বললেন,  এমনকি তার যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন তুললেন! এরপর হতবাক হওয়া ছাড়া আমাদের আর কিছুই করার নেই!  যতোই হোক আমারা হলাম সামান্য নেতাজী প্রেমিক সাধারণ মানুষ, আর উনি হলেন পে-ডিগ্রি ধারী নেতাজীর তুতো বংশধর!  তাই হয়তো অজান্তেই সিনেমা রিলিজের আগে থেকেই এই বিতর্কে জড়িয়ে, তিনি যেন আবারও উস্কে দিলেন নেতাজীর মৃত্যু নিয়ে জমে থাকা ছাই চাপা আগুনকে!                                                  আমরা কম বেশী সবাই জানি, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নেতা, বাঙালীর প্রাণপুরুষ সুভাষ চন্দ্র বসুর নিখোঁজ হয়ে যাওয়া বা নেতাজী সম্পর্কিত কিছু গোপন ফাইল রয়েছে স্বাধীন ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ে, কান পাতলে শোনা যায়, ওইসব গোপন নথি প্রকাশ্যে এলেই, কিছু বিদেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক নাকি এতটাই খারাপ হয়ে যেতে পারে!  আর তাতে আমাদের দেশ ভয়ংকর বিপদে পড়ে যেতে পারে! এই আশঙ্কায় ওই গোপন নথিগুলি কোনো দিনই নাকি প্রকাশ করা যাবে না! সারা দেশের মানুষ যখন জানতে চায় নেতাজীর মৃত্যু নিয়ে তাহলে কেন এই গোপনীয়তা!  কাকে বা কাদের আড়াল করতে এই সংক্রান্ত কোনও প্রশ্ন দেশের সংসদেও ওঠানো যাবে না!  শোনা যায় কংগ্রেস আমলে, অন্য দলের এক সংসদ সদস্যকে চিঠি দিয়ে এই কথা আরও স্পষ্ট করে জানিয়েছিল নাকি মনমোহন সিংয়ের সচিবালয়! আরও উল্লেখ করা যেতে পারে, রাজ্যসভায় সুভাষ চন্দ্র বসুর বিষয়ে প্রশ্ন করতে চাওয়ার পরেও কেন সেই প্রশ্নগুলি করতে দেওয়া হচ্ছে না, সে বিষয়ে খোঁজ করতে গিয়েই, পার্লামেন্ট সচিবালয় থেকে এই নোট নাকি পাঠানো হয়েছিল কোনো এক রাজনৈতিক দলের সংসদকে!                    আমাদের দেশ তো এখন স্বাধীন! আমরা তো এখন আর কোনো বিদেশী রাষ্ট্রের অধীনে নেই! কাগজে পত্র-পত্রিকায় এবং বিজ্ঞাপনেও দেখছি ভারতবর্ষ এখন নাকি আন্তর্জাতিক মঞ্চে অনেক শক্তিশালী,  তাহলে এখনও কেন সুভাষ চন্দ্র বসুর অন্তর্ধান সংক্রান্ত নথি গোপন রাখা হচ্ছে! স্বাধীনতার এত দশক পরেও কেন আমাদের স্বাধীন সরকার এই তথ্য গোপন করে যাচ্ছে !  আর এসব থেকেই ক্রমশ জন্ম নিয়েছে অবিশ্বাস্য!  তৈরী হচ্ছে ক্রোধ!  গবেষকদের কথা তো ছেড়েই দিলাম একদম সাধারণ মানুষের চোখেও পড়ছে চরম অস্বাভাবিকতা!                         
সম্প্রতি চাঞ্চল্যকর নতুন কিছু তথ্য উঠে এসেছে  "বোস: দ্য ইন্ডিয়ান সাম্যুরাই , নেতাজি অ্যান্ড দ্য আইএনএ মিলিটারি অ্যাসেসমেন্ট" বইটিতে, নেতাজির মৃত্যু নিয়ে সেখানে অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল জিডি বক্সি যা লিখছেন মোটামুটি এরকম, নেতাজির মৃত্যু আদৌ বিমান দুর্ঘটনাতে  হয়নি, ওই দুর্ঘটনা সাজানো ঘটানো ছিল, যাতে করে তিনি ব্রিটিশদের চোখে ধুলো দিয়ে লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যেতে পারেন!  জাপানের গোয়েন্দা দফতর থেকেই নাকি এই বিমান দুর্ঘটনার খবর ছড়ানো হয়েছিল। সেই সময় নেতাজি পালিয়ে যান সোভিয়েত ইউনিয়নে, টোকিওর তৎকালীন সোভিয়েত রাষ্ট্রদূত জেকব মালিকের সাহায্যে চলে যান সাইবেরিয়ায়, আবার সেখানে থেকেই আজাদ হিন্দের শাখা নির্মাণ করতেও নাকি সমর্থ হন , সাইবেরিয়া থেকে তিনি রেডিওতে তিনবার ব্রডকাস্ট-ও করেন! এরপরেই সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে যোগাযোগ করে ইংরেজরা, নেতাজীকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে ব্রিটিশদের পোষা 'হায়না' বাহিনী সেখানেও পৌছে যায় , এবং এই জিজ্ঞাসাবাদের সময়ে তাঁকে এতটাই শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছিল যে, সেই নির্যাতনের ফলেই মৃত্যু হয় নেতাজির!....                                                              মাঝে মাঝে গভীর প্রশ্ন জাগে, জাতীয় কংগ্রেসের দুবারের নির্বাচিত সভাপতি সুভাষচন্দ্র বসুকে কি কারণে, ছদ্মনামে, ছদ্মবেশে, জীবন বাজি রেখে ভারতবর্ষকে স্বাধীন করতে গোপনে মাতৃভূমি ত্যাগ করতে হয়েছিল ! আচ্ছা সেই সময়ের আর কোনো বিখ্যাত বরেণ্য নেতাকে তো স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য আত্মগোপন করে থাকতে হয়নি, বলা যেতেই পারে "under-cover" এ থেকে ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করতে হয়নি !  হায়নার মতো ব্রিটিশ গোয়েন্দা বাহিনীর নজর এড়িয়ে এক দেশ থেকে আর এক দেশ ঘুরে ঘুরে আজাদ হিন্দ যোদ্ধাদের জন্য রসদ সংগ্রহ করতে হয়নি!  এই ব্রিটিশরা কিন্তু তাদের পথের একমাত্র কাঁটা নেতাজীকে পৃথিবী থেকে চিরদিনের জন্য সরিয়ে দেওয়ার সবরকম কৌশল বারবার করেও ব্যর্থ হয়েছে, কুখ্যাত স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের উপর নির্দেশ ছিল যে কোনো উপায়েই হোক গোপনে দেশত্যাগী নেতাজীকে হত্যা করতে হবে! নেতাজী কে দেখামাত্র গুলি করে মেরে ফেলারও নির্দেশও ছিল!  কিন্তু বারবার ব্রিটিশরা ব্যর্থ হয়েছে!   ব্রিটিশরা তখন আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল বিশ্বব্যাপী নেতাজির নানা স্তরে সুকৌশলে তৈরী করা নেটওয়ার্ক দেখে!
বিশ্বাস করতে খুব কষ্ট হয় যে নেহরুর ক্ষমতায় আসার পথ নিষ্কণ্টক করতেই কি 'জাতীর পিতা' নেতাজীর বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ঘটনা প্রথমে না মানলেও ধীরে ধীরে পরে মেনে নিয়েছিলেন!  শুধু ব্রিটিশ নয়, সয়ং নেহরুজিও কি আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন নেতাজীর সেই অগ্রাসন দেখে !   ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট অ্যাটলিকে চিঠি লিখে তবে কেন নেহেরু জানিয়েছিলেন "আপনাদের যুদ্ধাপরাধী বোসকে রাশিয়া আশ্রয় দিয়ে বিশ্বাসঘাতকতার কাজ করেছে"!!!!!  কি এতো বাধ্যবাধকতা ছিল নেহেরুজির ভারতমাতার  শত্রু ব্রিটিশদের প্রতি! নেহেরুর কথা বাদ ই দিলাম, জানতে ইচ্ছে করে তৎকালিন বাকি নেতাদের ভুমিকাও ঠিক কি ছিল!  নেতাজি অনুগত কয়েকজনকে হাত করে,  বিপুল ধনসম্পত্তি, (আজাদহিন্দি-ফান্ড ও ব্যাংকের কোটি কোটি টাকার) বাঁটোয়ারা কি ভাবে করা হয়েছিল! কারা কারা এর ভাগ পেয়েছিল!   তারপর পরবর্তী তিরিশ বছরের জন্য কেনোই বা পাকাপোক্ত একটা ব্যবস্থা করতে বাধ্য হয়েছিলেন নেহরু অ্যান্ড কোম্পানি, ব্রিটিশদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে এইরকম একটা চুক্তিতে সম্মত হতে:- "পৃথিবীর যেকোনও প্রান্তে 'সুভাষচন্দ্র বোস' যদি স্বনামে ও স্বপরিচয়ে আত্মপ্রকাশ করার চেষ্টা করেন তাহলে নিয়মানুযায়ী যুদ্ধ অপরাধী (ব্রিটিশ সাবজেক্ট) সুভাষচন্দ্রকে আন্তর্জাতিক বিচারের সামনে দাঁড়াতে হবে এবং ভারতকে সেখানে অংশগ্রহণ করতেই হবে" !!!!   হ্যাঁয় ঈশ্বর সহ্য করার শক্তি দাও!  ভাবলেই রক্ত গরম হয়ে যায়!  এটাই কিন্তু সুকৌশলে করা হয়েছিল!   স্বাধীনোত্তর ভারতবর্ষে নেতাজী কে খুঁজে পাওয়া গেলে, কে বলতে পারে সুভাষচন্দ্রের পরিণতিও হয়তো শ্যামাপ্রসাদের মতোই হতো!  রহস্যজনক ভাবে শেষ হয়ে যেতে পারতো তারও জীবন!  তাহলে আর 'বিমান দুর্ঘটনায় মৃত সুভাষচন্দ্র বসু' এই বিষয়  নিয়ে ভারতবর্ষে নতুন করে আর কোনও ঢেউ ওঠার সম্ভাবনা থাকতো না! নেতাজীর বিদেশি পরিবারের কিন্তু বেশ যত্ন নিয়েছিলেন তৎকালিন সরকার!  ভারত সরকার নিয়মিত টাকা পাঠাতো নেতাজীর স্ত্রী ও কন্যার কাছে!  উদ্দেশ্যে অবশ্যই কিছু একটা ছিল এর মধ্যে!  হয়তো বা যাতে ওই বিদেশিনি মুখ বন্ধ রাখেন! আর দুম করে নেতাজীর স্ত্রীর মর্যাদা দাবি করতে ভারতে চলে না আসেন!  কথাও রেখেছিলেন হয়তো বিদেশিনী স্ত্রী বা নেতাজী পরিবার! রহস্যজনক ভাবে তার স্ত্রী ও কন্যা কোন দিনই নেতাজির অন্তর্ধান তদন্ত নিয়ে তেমন আগ্রহ দেখাননি। বলা ভালো আশ্চর্যজনক ভাবে তারা বারবার এই প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেছেন, পরোক্ষে বিমান দুর্ঘটনার তত্ত্বকেই মেনে নিয়েছেন এবং সেই বিতর্কিত ‘চিতাভস্ম’ ভারতে আনার জন্য দাবিও জানিয়েছেন!  দুঃখের বিষয় আজও অধিকাংশ বুদ্ধিজীবী বা বিশিষ্ট মানুষজন সম্পূর্ণ নীরব এবিষয়ে! যারা যেকোনো বিষয়েই যখন তখন পথে নেমে পড়েন!  অথচ যে এগারোটি রাষ্ট্র আজাদ হিন্দ সরকারকে সেসময় স্বীকৃতি দিয়েছিল, আজও তারা নেতাজির ‘মৃত্যুদিন’ ঘোষণা করেনি।  একমাত্র ব্যতিক্রম ব্রিটিশ কমনওয়েলথ সদস্য ভারতবর্ষ !  অর্ধসত্য নথিপত্র সামনে রেখে আজও সরকারি ভাবে শুধুমাত্র সেই বিমান দুর্ঘটনার গল্পই বলে চলছে! আর নেতাজী পরিবারের কিছু সদস্যও সেই গল্প প্রতিষ্ঠার জন্য গলা ফাটাচ্ছেন সর্বত্র!  যখন নাকি ব্রিটিশ ও মার্কিন গোয়েন্দারা সন্দেহের বসে রেনকোজিতে রেখে দেওয়া ভস্ম পরীক্ষাও করে ফেলেন এবং শোনা যায় যথারীতি হতাশও হয়েছিলেন!  তারা নাকি বুঝতে পারেন ওই ভস্ম আদৌ সুভাষ বোসের তো নয়ই এমনকী আদৌ কোনও মানুষেরও না ! জাপানে এই ছাইভস্ম রক্ষার জন্য একসময় গোপনে ভারত সরকার থেকে নিয়মিত টাকাও পাঠানো হতো!  এটা কি ধরনের ভক্তি না ভণ্ডামি ঈশ্বর ই জানেন!   আরও আশ্চর্যজনক কিছু তথ্য, 1946 এর ব্রিটিশ নথি থেকে জানা গেছে:- "যুদ্ধাপরাধী" বোস ভারতে ফিরলে কী কী ভাবে তার বিচার হবে!  সিদ্ধান্তে আরও লেখা হয়েছে, তিনি যেখানে আছেন সেখানেই থাকুন। তাঁকে আত্মসমর্পণ না করতে বলাই ভালো!.... কি নিদারুণ পরিণতি এক মহান এবং ভারতের শ্রেষ্ঠ স্বাধীনতা সংগ্রামীর! সাম্প্রতিক কালে প্রকাশিত নেতাজি সংক্রান্ত নতুন ফাইলগুলি থেকে ক্রমশ আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে সুভাষচন্দ্র রাশিয়া ও চীনে বেশ সক্রিয় ছিলেন, একাধিক বেতার ভাষণও দেন সেখান থেকেই।  যদিও এখনও এসব জোরের সঙ্গে বলার সময় আসেনি! অনেক ফাইল তো রহস্যজনক ভাবে নিখোঁজও হয়ে গেছে, তাই পাকানো জট সম্পূর্ণ ভাবে খোলা আদৌ সম্ভব হবে কিনা কে জানে!  আর যদি কখনও সব রহস্যের সমাধান হয়ও তখন এই জঘন্য অপরাধের মুল অভিযুক্তদের শাস্তি দেওয়া আর হয়তো সম্ভব হবে না! আর নেতাজীকে নিয়ে এই মিথ্যার ব্যবসা চালিয়ে অনেকেই করে খাচ্ছে! যেমন নেতাজি...... ব্যুরো!  আর নেহেরু পরিবারের কৃপাধন্য কিছু কিছু ঐতিহাসিক গবেষকেরা
আরও একটু মন দিয়ে পড়ুন 1971 এর 12 জানুয়ারি ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী চোদ্দোটি রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রসংঘের যুদ্ধাপরাধ সংক্রান্ত চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেন, সে সময়ে ভারতের তরফে যুদ্ধাপরাধী কে ছিলেন জানেন?  যদিও সব তথ্য আপ্রাণ গোপন রাখার চেষ্টা হয়েছিল, আরও মজার ব্যাপার হলো প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর এক আরটিআইয়ের জবাবে জানিয়েছিল  'নেতাজি সেই যুদ্ধাপরাধী নয়'  অথচ আশ্চর্যজনক ভাবে এটা পরিস্কার করে জানাতেও  পারেনি 1971 এ কে ছিলেন এই যুদ্ধপরাধী!!!  কিসের এতো ভয়!  কাকে এতো ভয়!!!  যদিও যুক্তি আর অনুমান থেকে এতটুকুও অসুবিধা হয় না, তিনি ছিলেন নিশ্চয়ই "সুভাষচন্দ্র বসু" হ্যাঁ আমাদের হৃদয়ের নেতাজী, ছোট বেলায় জীবনের আদর্শ চরিত্র রচনায় যার নাম লিখতাম।  এরপর নতুন চুক্তি অনুযায়ী আর শুধু তিরিশ বছর নয়, যত বছর বাদেই তিনি ধরা পড়বেন তাঁর বিচার হবে! তার যত বয়সই হোক ফাঁসি কিংবা গুলিতে তাঁকে প্রাণ হারাতে হবে!   এর মানে যে ছবিটা উঠে আসছে তা প্রায় জলের মতো পরিষ্কার, জীবিত থাকলে নেতাজী কে নিয়ে কোনো ঝুঁকিই নেওয়া যাবে না !!!                                  এবার একটু ফ্ল্যাশব্যাকে যাওয়া যাক, কিছুটা তথ্য কিছুটা যুক্তি আর বাকিটা অনুমানের ভিত্তিতে!  1945 এর প্রথমদিক থেকেই পৃথিবীর রাজনৈতিক সমীকরণ দ্রুত পাল্টাতে শুরু করে, প্রথমে বৃটিশদের মালয় আক্রমণের হুমকি আর তারপর আকাশপথে প্রত্যেক দিন আমেরিকার  বোমা বর্ষণ!  ফলতো নেতাজীর সিঙ্গাপুরে থাকাটা ক্রমশই সংকটজনক হয়ে পড়ছিল! আজাদ-হিন্দ বাহিনীর সেনাপ্রধান জে আর ভোঁসলে নেতাজীকে সিঙ্গাপুর ত্যাগ করার জন্যে প্রস্তুত থাকতেও পরামর্শও দেন!  এরপর হঠাৎ নেতাজী 1945 এর 03 অগস্ট জেনারেল ইসোদার মাধ্যমে সমুদ্রগর্ভে পাঠানো এক তারবার্তা পান, হয়তো তেরাউচির কাছ থেকে বা  জাপানের ইম্পিরিয়াল জেনারেল হেডকোয়ার্টার্স এর কাছ থেকে!  অনুমান করা যায় সেই তারবার্তা ছিল নেতাজীর পরবর্তী পদক্ষেপ কি হবে সেই সংক্রান্ত বিষয়ে!   তাকে সম্ভবত পরামর্শ দেওয়া হয়, তিনি যেন খুব তাড়াতাড়ি জাপান নিয়ন্ত্রিত ফরাসি ইন্দো-চিন (বর্তমান ভিয়েতনাম) স্থিত  সায়গন শহরের চলে যান! এরপর 10 অগস্ট নেতাজী জানতে পারেন, সোভিয়েত-ইউনিয়নও যুদ্ধে অংশ নিয়েছে এবং  মাঞ্চুরিয়া আক্রমণ করেছ, একই সঙ্গে তিনি আরও একটি চরম দুঃসংবাদ পান যে আমেরিকা হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা বর্ষণ করছে!  তারপর 16 আগস্ট জাপানের নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের খবর জানতে পারেন, এই একটি ঘটনাই হয়তো ভারতবর্ষের স্বাধীনতা দুবছর পিছিয়ে দেয়! বা বলা ভালো ভারতবর্ষের ইতিহাসটাই অন্য রকম করে দিয়েছিল!  যাইহোক জাপানের আত্মসমর্পণের খবর জানার পর, নেতাজী আর দেরী করেন নি, তাঁর সঙ্গে একান্ত প্রয়োজনীয় কিছু সামগ্রী নিয়ে সায়গনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন!  এই পর্যন্ত মোটামুটি ঠিকই ছিলো!  কিন্তু তারপর সবকিছুই যেন ধোঁয়াশা!
নেতাজীর বিতর্কিত শেষ বিমানযাত্রা গুলো নিয়ে অনেক প্রশ্ন চিহ্ন রয়েছে !  1945 এর 16 অগস্ট তিনি সিয়াম (বর্তমান থাইল্যান্ড), ব্যাংককে   যাওয়ার উদ্দেশ্যে সিঙ্গাপুর ছাড়েন!  সেই 16 তারিখেই মতান্তরে 17 তারিখ সকালে তাঁর উড়ান ব্যাংকক থেকে সায়গন (বর্তমানে হো চি মিন সিটি) যায়!  17 অগস্ট বিকেলে তিনি সায়গন থেকে ফরাসি ইন্দো-চিন তৌরেন এ (বর্তমান ভিয়েতনামের দানাং) উড়ে যান, আবার  পরদিন ভোরেই আবার তৌরেন থেকে তাইহোকু,  ফরমোসা, (বর্তমান তাইপেই, তাইওয়ান) যাত্রা করেন। এবং শেষ গল্প অনুযায়ী 18 অগস্ট, বেলা দুটো নাগাদ তিনি দাইরেন, মাঞ্চুকুও, (বর্তমান দালিয়ান, চিন) যাত্রা করেন, কিন্তু তাঁর বিমান নাকি মাটি ছেড়ে আকাশে ওঠার অল্প সময়ের মধ্যেই ধ্বংস হয়ে যায়!!!!!  অগ্নিদগ্ধ সুভাষ চন্দ্র বসুকে একটি জাপানি সেনা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে, কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সেখানে তিনি নাকি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন!  পক্ষান্তরে ওই বিমান যদি ধ্বংস না হয়ে থাকে, সম্ভবত ওই বিমান নেতাজীকে দাইরেনে নামিয়ে দিয়েছিল !!!                 
যে বিমান দুর্ঘটনায় পড়ে বলে কথিত আছে, সেটা ছিল মিৎসুবিশি কেআই- 21,  জোড়া-ইঞ্জিন সম্পন্ন হেভি বোম্বার বিমান, সেই যুদ্ধ-বিমানে তিন অথবা চার জন বিমান চালক, জাপানি সেনা, বিমান বাহিনীর কয়েকজন অফিসার, লেফটেন্যান্ট-জেনারেল  সুনামাসা শিদেই, জাপানি কোয়াংতুং সেনাবাহিনীর সহ-প্রধান সহ একমাত্র ভারতীয় কর্নেল হাবিবুর রহমান কে সঙ্গে নিয়ে সুভাষ চন্দ্র বসু সায়গন বিমান বন্দর থেকে 1945 এর 18 অগাস্টে আনুমানিক বেলা দুটো নাগাদ চড়ে বসে ছিলেন! তারপর অনেক রহস্য!  সব কিছু যেন অন্ধকারে !  ঐতিহাসিক জয়েস চ্যাপম্যান লেব্রার মতে, সুভাষ চন্দ্র বসুকে বিমানে চড়ার সময় স্থানীয় ভারভীয়রা উপহার হিসেবে বিপুল ধনসম্পদের দুটো অত্যন্ত ভারী বাক্স দেন, যা ছিল বিমানের বিধিবদ্ধ ওজনের থেকে অনেক বেশী! তারপর নির্দিষ্ট সূচি অনুযায়ী ওই বিমানটি দুই ঘণ্টার যাত্রাবিরতি নেওয়ার   পর জ্বালানি ভরে, ইঞ্জিন পরীক্ষা করার পর ফের দুপুর দুটো নাগাদ সেই জোড়া ইঞ্জিনের বিমান মোট বারো অথবা তেরো জন যাত্রীকে নিয়ে মাটি ছেড়ে আকাশে উড়ে যায় মাঞ্চুরিয়ার উদ্দেশে! শেষপর্যন্ত বেলা দুটো তিরিশ নাগাদ মিৎসুবিশি কেআই- 21 মাটি ছেড়ে আকাশে ওঠার কিছুক্ষণের মধ্যেই ধ্বংস হয়ে গেল! কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে:- সুভাষ চন্দ্র বসুর পাশের আসনে বসা কর্নেল হাবিবুর রহমান কিন্তু বিমান দুর্ঘটনার পর অক্ষত রয়ে গেলেন!  স্থানীয় ভারতীয়দের উপহার হিসেবে দেওয়া ধনসম্পদের দুটো ভারী বাক্স হারিয়ে গেল! নেতাজীর বিমান-দুর্ঘটনার পর নেতাজীর মৃতদেহের কিম্বা দুর্ঘটনার আহত  হতাহতদের কোনো প্রামাণ্য ছবি প্রকাশ হলো না! তাছাড়া জাপানের আত্মসমর্পণের কয়েকদিন পর থেকে কিছুদিন পর্যন্ত যে সমস্ত বিমান ওই পরিস্থিতিতে ওঠা নামা করেছিল, সেই অবস্থায় কি কি ঘটছে তাতে স্পষ্টতার ও স্বচ্ছতার যথেষ্ট অভাব ছিল!                             
18 আগস্ট ওই রহস্যময় বিমান দুর্ঘটনার দীর্ঘ পাঁচ দিন পর 23 আগস্ট জাপানের একটি সংবাদ সংস্থা 'দোমেই' এর খবর অনুযায়ী প্রথম জানা গেল যে তাইহোকুতে এক বিমান দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে সুভাষ চন্দ্র বসুর মৃত্যু হয়েছে!  এই খবর তার পরের দিনই অর্থাৎ 24 আগস্ট পরাধীন ভারতবর্ষের প্রায় সব কাগজে হেডলাইন হয়ে যায়!  শোকে দুঃখে সারা ভারতবর্ষ স্তব্ধ হয়ে যায়,  ঘটনার আকস্মিকতায় সমস্ত জাতি বিহ্বল হয়ে পড়ে।  জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধীজিও শোকে স্তব্ধ হয়ে যান, শোনা যায় নেহরুও নাকি কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন! এমনকি গান্ধীজিও প্রাথমিক ভাবে মানতে চাননি এই খবরের সত্যতা, বলেছিলেন কেউ সুভাষের চিতাভস্ম এনে দেখালেও তিনি মানতে রাজি নন সুভাষ মৃত!  এমনকি গান্ধীজি নেতাজির পরিবারকে টেলিগ্রাম পাঠিয়ে লিখেছিলেন, "সুভাষচন্দ্র বসুর শ্রাদ্ধ যেন না করা হয়" , শরৎচন্দ্র বসু সহ নেতাজির পরিবারের অধিকাংশ সদস্যই তখন এই মৃত্যুসংবাদ মেনে নিতে রাজি হননি,  কারণ এর আগেও 1942 এও একবার রয়টার্স মারফত খবর এসেছিল সুভাষচন্দ্র বসু বিমান দুর্ঘটনায় মারা গেছেন!  পরে অবশ্য সেটি ভুল বলে প্রমাণিত হয়ে যায়। তথাকথিত এই 'শেষ' বিমানযাত্রায় নেতাজির বিশ্বস্ত সঙ্গী ছিলেন কর্নেল হাবিবুর রহমান যিনি দুর্ঘটনার পর অক্ষত ছিলেন, পরবর্তী কালে ইঙ্গ-মার্কিন গোয়েন্দারা তাদের নিজস্ব স্বার্থেই এই হাবিবুর রহমানকে এক বছর ধরে লাগাতার জেরা করেও বিশেষ কিছু উত্তর পাননি, যদিও এই গোয়েন্দারা বারবার বলেছেন, হাবিবুর রহমান গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য গোপন করছেন এবং তার বক্তব্য অসঙ্গতিপূর্ণ!  যাইহোক গোয়েন্দাদের এই জেরা থেকে মুক্তি পেয়ে, 1946 এর আগস্টে হাবিবুর রহমান কিন্তু প্রথমেই চলে আসেন কলকাতায় নেতাজির বাড়িতে, সুভাষচন্দ্র বসুর দাদা শরৎচন্দ্র বসুর সঙ্গে দেখা করে প্রায় আড়াই ঘণ্টা দুজনের মধ্যে রুদ্ধদ্বারে কথাবার্তা হয় ! কিন্তু সবথেকে আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো যে হাবিবুর রহমান চলে যাওয়ার পর শরৎচন্দ্র বসু তাঁর পরিবারের সদস্যদের নাকি বলেছিলেন, "হাবিবুর রহমান সত্য কথা বলছে না" !!!   এর পরেই হাবিবুর রহমান সোজা চলে যান দিল্লিতে মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করতে।  তাঁদের  কথাবার্তাও একই ভাবে  গোপনে শেষ হলে, সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে গান্ধীজি রহস্যজনক ভাবে জানিয়ে ছিলেন "হাবিবুর আমাকে সেটাই বলেছে, যেটা তার লিডার তাকে বলতে আদেশ করেছে"!!  এর মানে জলের মতো পরিষ্কার,  আবার জল ঘুলিয়ে দিলে ভিষন অপরিষ্কার!!!  তাই মহাত্মা গান্ধীর এই মন্তব্যে দেশবাসীর মনে আরও  সন্দেহ দানা বাঁধতে থাকে!!
আরও কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে পরবর্তী কালে, 1945 এর অক্টোবরে (অবশ্যই বিমান দুর্ঘটনার পর) ব্রিটিশ মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ত এটলি নাকি তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন সুভাষ বসুকে কিভাবে ধরা যায় তা নিয়ে!! (‘Transfer of Power’ Volume VI) যদি  বিমান দুর্ঘটনায় সুভাষচন্দ্র বসু মারা গিয়েই থাকেন  তাহলে নতুন করে ব্রিটিশদের এই অনর্থক কৌতূহল বা ভয় পাওয়ার কারণ কি ছিল !!   আবার 1948 এ  মার্কিন ও ইঙ্গ গোয়েন্দা নথি থেকে জানা যায়, তাদের কাছে এমনও খবর এসেছিল সুভাষচন্দ্র বসু নাকি ছদ্মবেশে ভারতে প্রবেশ করতে পারেন যেকোনো মুহূর্তে!  কেন ই বা সুভাষ চন্দ্র বসুর দাদা শরৎ বসু তাঁর সম্পাদিত 'নেশন' পত্রিকায় 1948 এ লিখেছিলেন যে সুভাষ চন্দ্র চীনে আছেন!!!  আরও এক মার্কিন গোয়েন্দা দপ্তরের নথি থেকে আবার  জানা যায়, সুভাষচন্দ্র বসু 1964 এ ভারতে ছিলেন! আবার এক সুইস গোয়েন্দা 1949 এ নেতাজির দাদা শরৎ বসুকে চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন যে বিশ্বস্ত সূত্রে (এক জাপানি গোয়েন্দা মারফত) তিনি জানতে পেরেছেন যে সুভাষচন্দ্র বসু জীবিত রয়েছেন!!!!  এরকমই ভুরিভুরি রহস্যময় ঘটনার সাক্ষী আমরা!!   তাই তো গভীর রহস্য থেকেই যায় কেন প্রথমে ভুল নামে ডেথ সার্টিফিকেট ইস্যু করা হয়েছিল !!  তারপর তথাকথিত মৃত্যুর সঠিক সময় নিয়েও নানান বিভ্রান্তিকর বিভিন্ন রকম তথ্য পাওয়া গেছে!! আগাগোড়া সন্দেহের চাদরে মোড়া বিমান দুর্ঘটনার ঠিক আগে বা নেতাজীর মৃত্যুর সময়, নেতাজীর সঙ্গে দেশী-বিদেশী কারা উপস্থিত ছিলেন একদম অস্পষ্ট অর খুব বিতর্কিত !!   আজও ভারত কিংবা ব্রিটেন কেউ সরকারি ভাবে নেতাজীর  মৃত্যু দিন প্রকাশ করেনি !!!  উল্টে শুধু ধোঁয়াশাই তৈরি করে যাচ্ছে!!!
এবার একটু 'গুমণামী' প্রসঙ্গে আসি, যেখান থেকে লেখা শুরু করেছিলাম, নেতাজীকে নিয়ে বহু সিনেমা বা তথ্যচিত্র হলেও এই সিনেমা নিয়ে কিছু মানুষের হৃদস্পন্দন অবশ্যই বেড়ে গেছিলো! কেন নেতাজী রিসার্চ বুরোর সহায়তা না নিয়েই এই রকম স্পর্শকাতর বিষয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করার দুঃসাহস দেখিয়েছিলেন ওই পরিচালক!   ষাটের দশক থেকেই উত্তর প্রদেশের অযোধ্যার কাছে এক সুদর্শন ও দীর্ঘদেহী  সাধুবাবার কথা লোক মুখে ঘুরতে থাকে,  তিনি নাকি কারো সঙ্গে দেখা করতেন না, পর্দার আড়ালেই থাকতেন, যে কারণে তাঁর নাম হয়ে যায় পর্দাবাবা, কেউ কেউ আবার তাঁকে বলতেন ভগবানজি, পরবর্তীতে গুমনামী বাবা নামেও তাকে ডাকা হতো। সেই গুমণামী সাধুবাবার  গোপনীয়তার পর্দা ভেদ করে সামান্য কয়জনের বাঙালি বিপ্লবীর সৌভাগ্য হয়েছিল তার সঙ্গে সাক্ষাতের,  তাঁরা কিন্তু তাঁকে আশ্চর্যজনক ভাবে নেতাজি বলেই শনাক্ত করেছিলেন, তাঁরা হলেন নেতাজির স্নেহধন্যা বিপ্লবী লীলা রায়, সমর গুহ প্রমুখ।  যদিও প্রায় এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বা বলা ভালো ওই গুমণামী বাবার মৃত্যু পর্যন্ত তাঁরা সবাই কোন এক রহস্যময় কারনে সেই সব তথ্য গোপন করে রেখেছিলেন!! তাছাড়া উত্তরপ্রদেশ আদালতের নির্দেশে গঠিত 'সহায় কমিশন' ভগবানজির বা গুমণামী বাবার প্রকৃত পরিচয় জানার জন্য তদন্ত চালাচ্ছে! যদিও সেই তদন্তও শেষপর্যন্ত অশ্ব-ডিম্ব প্রসব করে!  তবু মাঝে মাঝেই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে কিছু রাজনৈতিক রাজ পরিবারের লোকজন! তাঁর বলতে চাইছেন  ভগবানজি কিছুতেই নেতাজি হতে পারেন না,  চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে  কমিশনের ওপর বিভিন্ন ভাবে!!  আরও আশ্চর্যের বিষয় হলো এই সহায় কমিশন এতদিনেও কলকাতায় এসে ভগবানজির ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের সাক্ষ্য গ্রহণের ব্যাপারে এখনও পর্যন্ত একটুও এগোতে পারেননি! কেন কি কারণ আছে এর পেছনে ? কীসের অসুবিধে?  সহায় কমিশনের হাতে নাকি অজস্র চাঞ্চল্যকর প্রমাণ আছে বলে তাঁরা দাবি করেছেন!  এখন শুধু দেখার নতুন শক্তিশালী ভারতবর্ষের সরকারের কতটুকু সদিচ্ছা বা সাহস আছে, নেতাজি অন্তর্ধান রহস্য উন্মোচনে আদৌ কি তারা উৎসাহি!!!!
পরিশেষে বলতে চাই 1945 এ তাইহোকুতে বিমান দুর্ঘটনায় সুভাষ চন্দ্র বসুর মৃত্যু হয়েছিল বলে শুধু মাত্র ধারণাই করা যায় তার বেশি কিছু নয় !  হ্যাঁ ঠিক, শুধু ধারণাই করতে পারি তার বেশি কিছু নয়!  কারণ কোনো clenching evidence নেই, যা থেকে একশো ভাগ সত্যি প্রমাণ করা যাবে বিমান দুর্ঘটনার তথ্য সঠিক কিনা!  এই মৃত্যুকে প্রমাণ করতে গত সত্তর বছরে একাধিক তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়েছে, যার মধ্যে প্রথম দুটি কমিশন ওই দুর্ঘটনায় নেতাজীর মৃত্যুর পক্ষেই মতামত দিয়েছে!  আচ্ছা তাহলে তো কথাই নেই, কিন্তু এরপরও কেন নেতাজীর চিতাভস্ম ভারতবর্ষে ফেরত এলো না!!  আর কেনই বা নেতাজীর মৃত্যু দিবসে ছুটি ঘোষনা করে জাতীয় শোক দিবস পালন করা হচ্ছে না!!  আরও অদ্ভুত ব্যাপার, ওই দুটি কমিশনের মতামত যদি সঠিক হয়েই  থাকে, তাহলে তৃতীয় আর একটি কমিশন নতুন করে কেন গঠন করার প্রয়োজন হয়েছিল আর কেনইবা ওই কমিশনের প্রতিবেদন কোনও কারণ না দেখিয়েই বাতিল করা হয়েছিল!  প্রশ্ন অনেক উত্তর দেবার মতো সাহসী দেশনেতার অভাব!  এসবই ধাঁধার মতো জটিল প্রশ্ন! গুজব হোক বা অর্ধ সত্যিই হোক! নেতাজীর অন্তর্ধান নিয়ে চর্চা চলতেই থাকবে। পঞ্চাশের দশকে শাহনওয়াজ কমিশন জানিয়েছিল তাইহোকু বিমান দুর্ঘটনাতেই নেতাজীর মৃত্যু হয়েছে, এবং সেই প্রতিবেদন সরকার সানন্দে মেনে নিয়েছিল কিন্তু তারপরে  আবার কেন যাটের দশকে খোসলা কমিশন গঠন করা হল! তাহলে কি এটাই প্রমাণ হয় না যে সরকারের মনেও শাহনওয়াজ কমিশনের প্রতিবেদন নিয়ে কিছু সন্দেহ ছিল! অনেক দ্বিধা ছিল!  তারপর দ্বিতীয় খোসলা কমিশনও যখন ঠিক একই কথা জানল, তাহলে নতুন করে আবার কেন মুখার্জি কমিশন গঠন করা হলো !  এ রহস্য ভেদ করা তো ফেলু মিত্তিরের পক্ষেও সম্ভব নয়!
এর মধ্যেই আবার একবার নেতাজির অন্তর্ধান নিয়ে বোমা ফাটালেন অনূজ ধর, নেতাজিকে নিয়ে গবেষণা করা এই মানুষটি তাঁকে নিয়ে বইও লিখেছেন, সম্প্রতি 'ওয়ানইন্ডিয়া' কে এক সাক্ষৎকারে তিনি জানিয়েছেন, 1945 এ নেতাজি রাশিয়ায় ছিলেন সে ব্যাপারে যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ রয়েছে!     
সম্প্রতি এই বিষয়ে নেহেরুর লেখা তৎকালিন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী Clement Attle কে 27.12.1945 এ লেখা একটি চিঠি কি করে যেন বাজারে বেরিয়ে পড়েছে, যদিও সেই চাঞ্চল্যকর চিঠির বৈধতা কে চ্যালেঞ্জ করে কেউ কিছু করছে কিনা যানা যায় নি!  এটা শুধু চমকে দেওয়ার মতো ঘটনা নয় বরং বলা ভাল শুনে অজ্ঞান হয়ে যাবার মতো অবস্থা!  মিথ্যার অবসান হোক! সত্য প্রকাশিত হোক!                                 
নেতাজী অন্তর্ধান রহস্যের সমাধানে রাশিয়াও সাহায্য করতে প্রস্তুত শোনা যাচ্ছে, এমনটাই তো জানিয়েছেন অনূজবাবু।  এই অনূজবাবু আরও চাঞ্চল্যকর ভাবে জানিয়েছেন:- "নেতাজির ফাইল প্রকাশ্যে এলে জওহরলাল নেহরুর ইমেজ হয়তো ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে তার ধারণা তৈরি হয়েছে, তিনি আরও বলেছেন, মহাত্মা গান্ধী ও সর্দার প্যাটেলও নাকি নেতাজির গতিবিধি সম্পর্কে সব জানতেন।" এই অনূজবাবু কেন্দ্রের বক্তব্যের সম্পূর্ণ বিরোধিতা করে জানিয়েছেন:- "নেতাজির নিখোঁজের পরে সাত দশক কেটে গিয়েছে, এখন আর কোনও নথি প্রকাশ্যে এলে অন্য দেশের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই" ।                    বিতর্কিত তথ্যগুলিকে অন্ধকারে রেখে, এতো দিন পরও নেতাজির ফাইল প্রকাশ না করে ভারত সরকার কি আড়াল করতে চাইছে? নাকি এটাই ধরে নিতে হবে সমস্ত রহস্য উন্মোচিত হলে অন্য দেশের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার থেকেও বড়ো কোনো আশঙ্কা আছে যা কিনা এক লহমার ভেঙে চুরমার করে দিতে পারে কারুর রচনা করে মনগড়া স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস! পাল্টে যেতে পারে ভারতবর্ষের অনেক কল্পনার মহাপুরুষদের রূপকথার গল্প!  এখন এটাই দেখার নেতাজি অন্তর্ধান রহস্যে যে চাঞ্চল্যকর মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে বর্তমান সরকার তাতে কতটা সাহসিকতার পরিচয় দিতে পারে। কি জানি বৃহত্তর কোনো ষড়যন্ত্রের পর্দা সরিয়ে কোন দিন নতুন কোনো সত্যি সামনে আসবে কিনা! নেতাজীর মৃত্যু না অন্তর্ধান!!! আসলে কি ঘটেছিল!                      আপাতত সবার চোখ জাতীয় তথ্য কমিশনের দিকেই, কারণ নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু সংক্রান্ত নানা ফাইলগুলির উপর থেকে রহস্যের পর্দা উন্মোচন করা হবে কিনা তা নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন এই কমিশনের আধিকারিকেরাই, কি জানি কি সংবাদ নিয়ে আসে ভবিষ্যত,                                                                    "বিমান দুর্ঘটনায় না রাশিয়ার কারাগারে নাকি এই ভারতবর্ষেই গুমণামী বাবা রুপে স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছিল নেতাজির!"
অপেক্ষায় আছি ....

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours