কাজল ভট্টাচার্য, কার্টুনিস্ট ও সিনিয়র জার্নালিষ্ট, কলকাতা:

গল্পের গরু গাছে ওঠে, জানতাম। সেই গরু এবার গোত্তা মেরে ঢুকে পড়েছে রাজনীতিতেও। গরুর নাম মুখে আনলেই একপক্ষের 'তোবা তোবা'। আর গরু খেলে অন্যপক্ষের 'হায় হায়'। উভয় ক্ষেত্রেই আপনি বিজাতীয়।
বাঙালি পেটে কোনও দিনই মোষের দুধ সহ্য হতো না।
বাঙালি মায়ের দুধের পাশাপাশি, অপশন হিসেবে গরুর দুধ খেয়েই মানুষ। প্রয়োজনে একটু জল মিশিয়ে দুধ আরেকটু পাতলা, ট্যালটেলে করে নেওয়া হতো। বাঙালি পেট খুব সহজেই হজম করে ফেলতো গরুর দুধ। তবে কদর ছিলো বেশি কালো গাইয়ের দুধের। তবে মা ভগবতীর মর্যাদা পেত শ্বেতধবল গাই।

বাঙালির ঐতিহ্যই বোধহয় দ্বিচারিতা। ছেলের মাথা নিরেট। বকেঝকে যাও বা পড়ানো, অঙ্ক ইংরেজি বাংলা কোনটাই মাথায় ঢোকে না। সেই মন্দবুদ্ধির সন্তানকে মা বাবা বলতেন গরু। তখন অবশ্য বাঙালির মজ্জায় মজ্জায় এত রাজনীতি ঢুকে পড়েনি। তাই সন্তানকে গরু বলার আগে বিশেষ কিছু ভাবতে হতো না। বললেই চলতো। একদিকে দেবী অন্যদিকে গাভী। তাও গবেট চারপেয়ে।

আগে গৃহস্থ বাঙালির অভ্যাস ছিলো গরু পোষার। জলের ভেজাল ছাড়াই নির্ভেজাল গোদুগ্ধ। কর্তা থেকে নিয়ে সর্বস্তরের লিঙ্গ নিরপেক্ষ পরিবার সদস্যরা বাড়ির গরুর দুধ শেয়ার করতেন। একদা এই গরুর দুগ্ধপোষ্য বাঙালির উদ্দেশ্যেই স্যার গোপাল কৃষ্ণ গোখলে বলেছিলেন, "হোয়াট বেঙ্গল থিঙ্কস টুডে, ইন্ডিয়া থিঙ্কস টুমরো।"
এরপরেই  কখন যেন গরুবিদায়! বাঙালির অন্দরমহলে সেঁধিয়ে গেছিলো কুকুর। ভোলবদল বাঙালির। দেখতে না দেখতে, এক সময় কুকুর হয়ে দাঁড়ালো স্টেটাস সিম্বল। বাবুর বাড়ির সেই অভিজাত কুকুর নামপালটে হয়ে গেল ডগি। যে বাবুর যত বড় খটমটে নামওয়ালা কুকুর, তার স্টেটাস তত উঁচুতে।
ব্যাপারটা এমন দাঁড়ালো যেন কুকুর পুষলেই জাতে উঠবেন। আর গরু পুষলে জাত যাবে। ওই বাংলা বনাম ইংরেজি স্কুলে ছেলেমেয়ে পড়ানোর স্টেটাস রক্ষার লড়াইয়ের মতো।

বাঙালি যে আগে সারমেয় বিদ্বেষী ছিল, মোটেই এমনটা নয়।
পাড়ার কালু ভুলুর ঘরবাঁধা ছিলো। দুপুরে এর বাড়ির নিমন্ত্রণ তো রাতে ওর বাড়ির। মোটা চেনে বাঁধা না পড়লেও, এমনিতেই দিব্য বাঁধা পড়ে যেত মানুষে কুকুরে। তবে সভ্য শিক্ষিত বাঙালির ঐতিহাসিক টান সাত সাগর তেরো নদীর পাড়ের দেশে। তাই বাঙালির কুকুর পোষার শখ বাড়লেও, কপাল ফিরলো না তথাকথিত রাস্তার নেড়িদের। ওরা তো কুকুর না কুত্তা। কুকুর হওয়া চাই বিদেশি। বাঙালির গরুপ্রীতি কমা, কুকুরপ্রীতি বাড়া নিয়ে এক অদ্ভুত ব্যাখ্যা শুনেছিলাম এক অবাঙালি সহকর্মীর কাছে।
কমপক্ষে পনেরো বছর আগের সেই কথা, আজ যেন ভীষন সমসাময়িক হয়ে উঠলো কিছু ঘটনায়।
বিহার রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনের হিড়িক। তখন আমি পাটনায়। কাজ করি এক ইংরেজি দৈনিকে। ভোটের সমীকরণ, রাজ্যবাসীর মানসিকতা এসব নিয়ে জমিয়ে আসর বসেছে। লালুপ্রসাদ যাদব ফের কুর্সিতে বসতে পারবেন কিনা তা নিয়ে জোর জল্পনা কল্পনা।
কথায় কথায় বাংলার প্রসঙ্গ এসে পড়লো। তখন বাংলায় জ্যোতি বসু জমানা। লালুপ্রসাদের সঙ্গে বাংলার বামজোট সরকারের বেশ খাতির। বিহারের অনেকেই তাই বাংলা বাঙালি নিয়ে অনেককিছুই জেনে ফেলেছেন। তাঁদের ধারনা, লালু বসু রাজনীতির হাত ধরে বাঙালি বিহারীর অনেক ভুল বোঝাবুঝিও কমে আসছে। কমে আসছে দুই রাজ্যবাসীর মানসিকতার ফারাক।

আমাদের সেদিনের মজলিশে এমন অবাঙালি দু- একজন ছিলেন, যাঁরা কলকাতায় কাজ করেছেন। তাঁদেরই একজন প্রীতম সুহানা। তিনি আচমকাই উল্টো সুর গাইলেন। "যাই বলুন না কেন, বাঙালি বিহারীর লাইফস্টাইল একেবারেই আলাদা। ও কিছুতেই মিলবে না।"
- "কেন কেন"? অনেকেই আবার সরাসরি বিরোধিতাও করে বসলেন। নানা যুক্তি। ঐতিহাসিক, সামাজিক। আড্ডা তখন সিরিয়াস। যে এই বাঙালি বিহারী অনৈক্যের ব্যাপারটাকে উসকে দিয়েছিল সেই প্রীতম আমাকে জিজ্ঞেস করে বসলো, "আপকো কেয়া লগতা হ্যায় দাদা?"
বেশ গোলগোল কথা সাজিয়ে আমি দুই প্রতিবেশি রাজ্যবাসীর ঐক্যের পক্ষেই জবাব দিলাম।
"বাস্তব কথা বলুন দাদা," একটু হেসেই বললো প্রীতম। আর তারপরেই যেন এক দমকা হাসির অ্যাটম বোম ফাটালো। "বঙালিকা পাস পয়সা আনেসে, জরুর এক বিলায়তি কুত্তা পাল লেতা হ্যায়। অউর বিহারি কা পাস পয়সা আনে সে, ঘরমে এক গাই বাঁধ লেতা হ্যায়।"
পকেটভারী হলেই বাঙালির ঘরে বিদেশি কুত্তা। আর বিহারীর ঘরে গরু। এই নির্মম সত্যের সামনে পড়ে আমিও সেদিন কেমন 'গরু' হয়ে গেছিলাম।

আজ যখন দিলীপ ঘোষের গরুর সোনাদুধ নিয়ে এত ট্রোল দেখি, সেই কথাটা মনে পড়ে যায়। কে গোমাংস খেলো, তা নিয়ে খুনোখুনি। আবার কলকাতার অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসের বাইরেই, বিফ উৎসবে প্রকাশ্যে গোমাংস খাওয়াও দেখেছি। সেকুলারিজিমের প্রচার। শুধু হিরো হওয়ার লোভে অনেক বন্ধুকে বলতে শুনতাম, শালা বিফের শিক কাবাবটা যা বানিয়েছিলো না!
এই ট্রেন্ড আজকের না, বহুদিনের। ঐতিহ্য ফৈতিহ্য সব ভেঙেচুরে ফেলার ট্রেন্ড। তবে এরা কেউ বাংলার সেই 'মধুকবি' না। রামমোহন বিদ্যাসাগর বা ঠাকুরবাড়ির দামালও না। এঁদের পাতি মানসিকতা। ভাঙার জন্যই ভাঙে। হিন্দু সমাজের প্রচলিত ধর্মবিশ্বাসের উল্টো পথে হেঁটেই এঁরা নিজেদের মুক্তমনা, উদারবাদী বলে জাহির করতে চান। আবার কেউ চান ভোট কুড়িয়ে কুর্সিতে চড়ে বসতে।
এঁরাই প্রয়োজনে মনিষীদের কথা কেটেছেঁটে পেশ করেন। এঁরা কেউ গড়ার জন্য ভাঙেন না। ভাঙনের শেষে কোনও সৃষ্টির রাস্তা খুলে যায় না। ভাঙনেই এঁদের কর্তব্য শেষ। সেই ব্রিটিশ মহাপ্রভুদের 'ডিভাইড অ্যান্ড রুল'-এর আধুনিক ভারতীয় সংস্করণ। তাই এই ভাঙনকে ঠিক কতটা প্রশ্রয় দেওয়া যায়, তা নিয়ে চিন্তাভাবনার অবকাশ আছে বৈকি। কারণ এঁদের এই জেহাদিপনার অজুহাতে মাথাচাড়া দিতে পারে, সেই আদি রক্ষণশীল সমাজ।

তবে রাজনীতিতে গরুর ঢের আগে ঢুকে পড়েছিল বলদ। এই প্রজন্মের অনেকেই হয়ত সে খবর রাখেন না। স্বাধীন ভারতবর্ষে জাতীয় কংগ্রেসের নির্বাচনী প্রতীক ছিলো জোড়া বলদ। ১৯৫২ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত আসমুদ্র হিমাচল চষে বেড়াতো তারা। আর ওই জোড়া বলদের দৌলতে বারবার দিল্লির মসনদে ফিরে আসতে, তেমন কোনও বেগ পেতে হয়নি কংগ্রেসকে।

গরু এখন আর গরু নয়। আগে গপ্পের গরু গাছে উঠতো, এখন গরু রাজনীতির মুখ। গরু, বলদ, ষাঁড়ের বিরোধিতা করা মানে দেশের শাসকদল, পদ্মশিবিরের বিরোধিতা করা। দেশের গো বলয়ের গোপ্রীতি নিয়ে জমিয়ে হাসিমস্করা করেন বাংলার বিদ্বজ্জন। কিন্তু বাংলা বাঙালির গোপ্রেম অতীত হলেও, তা ছিলো অন্য এক মাত্রার। আবেগের সেই গল্প শুনিয়েছিলেন অমর কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। ষাঁড় নিয়ে লিখে ফিলেছিলেন আস্ত একখানা গল্প।
শরৎচন্দ্রের হাত ধরে বাংলার কালজয়ী সাহিত্যের আঙিনায় ঢুকে পড়েছিল 'মহেশ' নামের এক ষণ্ড। আর মহেশের পেছন পেছন এসে হাজির হয়েছিল ষাঁড়ের মালিক গফুর জোলা আর তার বছর দশের ছোট্ট মেয়ে আমিনা। পশুতে মানুষে মানবিক সহবাসের গল্প। বাবামেয়ের সংসারে ভাত, এমনকি ভাতের ফ্যানও বাড়ন্ত। তাই নিজের ভাগের ভাত গফুর তুলে দেয় মহেশের মুখে।
আজও হয়ত বাংলার অজ পাড়াগাঁয়ে আরও কত মহেশকে নিয়ে বেঁচে আছে গফুর আমিনারা। অভুক্ত সবাই। তবু ষাঁড়ের গলায় দড়ি বেঁধে রাখতে হয়। ছাড়া পেলেই পেটের জ্বালায় পাছে জমিদারবাবুর মাঠের সবজি, গোশালার খড়ে মুখ দিয়ে ফেলে। ফের চাবুকের মারে গা হাতপা ফুলে ধুমজ্বরে পড়ে গোফুররা। শাসকের গোপ্রীতি আটকে নিজের খাটালেই।
বাবুদের মতোই আবার আছেন তর্করত্নরাও। যাঁরা গোমাতা, শিবের বাহন ষণ্ডের চিন্তায় মাথার ঘাম পায়ে ফেলেন। কিন্তু পেটেপিঠে লেগে যাওয়া অভুক্ত শিববাহনের জন্য এক আঁটি খড় দেন না। সরকারি গোশালায় গরু মারা যায়। তদন্ত বসে।
আর সেই ফাঁকে জমে ওঠে গরু নিয়ে আমাদের গুঁতোগুঁতি।
আয় দেখি, তোর গরুর জোর কতো?

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours