আনন্দিতা রায়, লেখিকা ও সঙ্গীতশিল্পী, দুর্গাপুর:

বিশ্বসাহিত্যে প্যারোডির সংখ্যা নেহাত কম নয়। ধারণা করা হয় সবচেয়ে প্রাচীন প্যারোডির শিকার হয়েছিলেন বিশ্ব বিখ্যাত গ্রীক কবি হোমার। এরপর বিশ্বসাহিত্যের অনেক মহারথীরা প্যারোডি করেছেন ,আবার নিজেরাও প্যারোডির শিকার হয়েছেন। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের নাম। শেক্সপিয়ার তাঁর বিখ্যাত নাটক "হ্যামলেট"এর একটি দৃশ্যে আরেক বিখ্যাত ইংরেজ লেখক "ক্রিস্টোফার মার্লো"কে প্যারোডি করেছেন। অন্যদিকে জণ মারস্টন নামে আরেক ইংরেজ সাহিত্যিক তার "মেটামরফোসিস অফ পিগম্যালিয়নস ইমেজ" কবিতাটিতে শেক্সপিয়ারের লেখা "ভেনাস এন্ড অ্যাডোনিস" এর প্যারোডি করেছেন। এছাড়াও জন মিল্টন ওয়াল্টার স্কট এডগার অ্যালান পো ওয়াল্ট হুইটম্যান ও আরো অনেক খ্যাতিমান লেখকদের সৃষ্টিও তাদের সমসাময়িক এবং পরবর্তী যুগের লেখকরা করেছেন।

পরিমল গোস্বামীর মতে কাজী নজরুল ইসলাম রচিত প্যারোডিগুলিতে দাদা ঠাকুরের রচনার বিশেষ প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। বাস্তবেও নজরুল ইসলাম দাদা ঠাকুরকে খুব মান্য করে চলতেন। মজাদার pun এর ব্যবহার তার রচনাতেও আমরা দেখতে পাই।
নজরুল ইসলাম

ও হে শ্যামো হে শ্যামো নামো হে নামো

ওহে শ্যামো হে শ্যামো নামো হে নামো
কদম্বো ডাল ছাইড়ে নামো
তুমি দুপুর রোদে বৃথাই ঘামো
ব্যস্ত রাধা কাজে।

ললিতা দেবী সলিতা পাকায়
বিশাখা ঝুলে হিজল শাখায়
বিন্দা দূতী পিন্ধা ধুতি
গোষ্টে গেছেন তোমার পোস্টে
সাইজ্যা রাখা সাজে
আর চন্দ্রা গেছেন অন্ধ্রদেশে মাদ্রাজি জাহাজে।
(রবি ঠাকুরের "আমায় ক্ষমো হে ক্ষমো "অনুসরণে)।

অথবা
শালের বোন

যদি শালের বোন হত শালার বোন
আর কনে বউ হত ওই গৃহের কোণ
ছেড়ে যেতাম না গো,
আমি থাকতাম পড়ে শুধু। যেতাম না গো।
যদি শালের বোন হত শালার বোন
আমি ওই বনে যে হারিয়ে যেতাম
ওই বৃন্দাবনে গরিয়ে যেতাম।
ওই মাকুন্দ হতো যদি কুন্দ মালা
হত দাড়ি সুন্দরী দাড়িওয়ালা
আমি ঝুলে যে পড়িতাম
তার দাড়ি ধরে, ওগো দুর্গা বলে
আমি ঝুলে যে পড়িতাম
হত চিমটি শালির যদি বাবলা কাটা
আর শর বন হত তার খ্যাংরা ঝাঁটা

রজনীকান্ত সেনের "যদি কুমড়োর মত" অনুসরণে

হুগলির জেলে কাজী নজরুল যখন বন্দি ছিলেন তখন লিখেছিলেন "অভিনন্দন" নামক প্যারোডিটি। জেলের রাজনৈতিক বন্দী কাজী নজরুল ইসলামের এই রচনাটিকে বলা হত "সুপার বন্দনা"। আর্সটন ছিলেন তখন ওই জেলের জেলর। তিনি বন্দিদের সাথে খুব দূর ব্যবহার করতেন। অসম্মানজনক কথা বলতেন। খবরের কাগজ বা চিঠি লেখার কাগজ কিছুই তাদের দেওয়া হতো না। গলার কণ্ঠস্বরটিও ছিল অত্যন্ত কর্কশ। ব্যঙ্গ করে নজরুল তার নাম রেখেছিলেন "হর্সটোন"(horse tone)। অত্যাচারী এই জেলরকে চটিয়ে দেবার জন্য গানটি লেখা হয়েছিল এবং তাকে শুনিয়ে শুনিয়ে উচ্চস্বরে গাওয়া হতো।
অভিনন্দন

তোমারি জেলে পালিছ ঠেলে
তুমি ধন্য ধন্য হে।
আমারি এ গান তোমারি ধ্যান
তুমি ধন্য ধন্য হে।
রেখেছো সান্ত্রী পাহারা দোরে
আঁধার কক্ষে জামাই আদরে
বেধেছ শিকল প্রণয়ডোরে
তুমি ধন্য ধন্য হে।
আকাড়া চালের অন্ন লবণ
করেছ আমার রসনা লোভন
বুড়ো ডাঁটা ঘাঁটা লপসী- শোভন
তুমি ধন্য ধন্য হে।
(রবীন্দ্রনাথের তোমারি গেহে পালিছ স্নেহে অনুসরণে)
নজরুলের বিদ্রোহী কবিতার প্যারোডি সজনীকান্তের হাতে পড়ে হয়েছিল "ব্যাঙ"। ভাব কুমার প্রধান ছদ্মনামে সজনীকান্ত এই প্যারোডি রচনা করেছিলেন।
৮ইআশ্বিন ১৩৩১ "শনিবারের চিঠি" শারদীয় সংখ্যা প্রকাশিত হল "বিদ্রোহী"র প্যারোডি। তিনজন ছিলেন এর রচয়িতা। অশোক চট্টোপাধ্যায়, যোগানন্দ দাস ও সজনীকান্ত দাস।
কবিতাটির কয়েকটি পংক্তি:-

আমি বীর
আমি দুর্জয় দুর্ধর্ষ রুদ্র উচ্চ শির
আমি বীর
দুচোখে আমার দাবানল জলে
 জ্বল জ্বল জ্বল জ্বল
স্তব্ধ বিশ্ব ইঙ্গিতে ভ্রুকুটির
আমি বীর ,আমি বীর।

সজনীকান্ত দাস লিখলেন,

আমি ব্যাঙ

আমি ব্যাঙ
লম্বা আমার ঠ্যাং
ভৈরব রভসে বরষা আসিলে
ডাকিয়ে গ্যাঙোর‌ গ্যাঙ
আমি ব্যাঙ
আমি পথ হতে পথে দিয়ে চলি লাফ
শ্রাবণ নিশায় পরশে আমার সাহসিকা
অভিসারিকা
ডেকে ওঠে 'বাপ বাপ'।
আমি ডোবায় খানায় কাদায় ধুলায়
খাটিয়ার তলে কিংবা ব্যবহার হীন চুলায়
কদলী বৃক্ষের খোলেও কখনো রহি
ব্যাঙাচি রুপেতে বাঁদরের মতো লেজুরেও আমি সরি। (ক্রমশঃ)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours